নির্বাচন কারো কারো কাছে এখন কৌতুক। বেশির ভাগের কাছে অবশ্য কৌতূহল। কী হবে! ভোট দিনে হবে নাকি রাতে হবে? বিরোধী দল মাঝপথে বর্জন করবে?
সরকারি সমর্থকরা বলছেন, খুবই উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং ব্যাপক ভোটারের উপস্থিতিতে...যা তাঁরা সব সময় বলে থাকেন।
এক এলাকায় ভোটে খুবই খারাপ অবস্থা। কেউ ভোট দিতে পারছেন না। কেন্দ্র দখল করে রেখেছে গুণ্ডারা। প্রিসাইডিং অফিসার মহোদয় ওদের যথাসাধ্য সাহায্য-সহযোগিতা করছেন। স্বভাবতই ভোটার তমিজউদ্দিন ভোট দিতে পারলেন না। হতাশ হয়ে তিনি ভায়রাভাইকে ফোন করে নিজের দুঃখের কথা বলেন। ভায়রা শুনে বললেন, ‘বলো কী! তোমাদের এলাকায় এ রকম ভোট হচ্ছে?’
‘কেন, তোমাদের এলাকায় কি তোমরা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারছ?’
‘পারছি মানে...একেকজন ১০-১২টা করে ভোট দিচ্ছে। আমিই তো কয়েকটা দিয়ে খেতে এসেছি। খেয়ে গিয়ে আবার দেব। তুমি বরং চলে আসো। তোমাদের এলাকায় আরো যারা ভোট দিতে পারেনি ওদেরও নিয়ে আসো। এখানে ভোট দেওয়ার কোনো সমস্যা নেই।’
এ রকম নির্বিঘ্ন এবং ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার ভোট হলে অবশ্য আমাদের কোনো কথা নেই।
বিরোধী সমর্থকদের দাবি, সাজানো নির্বাচন হবে। ভোট হয়ে যাবে আগের রাতে। ভোটের দিন যা হবে তা হলো প্রহসন। লোক-দেখানো নাটক।
তাদের মতামত ধরলে ভোট আসলে হবে এ রকম। এক বিরোধী সমর্থক ভোটকেন্দ্রে গেছেন। তিনি আসলে গেছেন এ জন্য যে গিয়ে দেখবেন, ওখানে সরকারি দলের সমর্থকরা কেন্দ্র দখল করে রেখেছে। কেউ ভোট দিতে পারছে না। তিনি ছবি ওঠাবেন। তাঁদের দলের সংবাদ সম্মেলনের সময় ঠিক করে রাখা হয়েছে। ওখানে ভোটে কী কী অনিয়ম হয়েছে সেই সম্পর্কে বিস্তারিত বক্তব্য দেওয়া হবে। তিনি সেখানে উপস্থিত থেকে নিজের অভিজ্ঞতা শোনাবেন। দুঃসহ অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য তিনি পকেটে করে সাবধানে মোবাইলও লুকিয়ে এনেছেন। প্রামাণ্য ছবি তুলবেন। কেন্দ্রে গিয়ে অবাক হয়ে দেখলেন, মানুষ সুন্দর লাইন করে দাঁড়িয়েছে। তিনি ভাবলেন, লাইনটা লোক-দেখানো। লাইন আগাবে না। মজা দেখার জন্য লাইনে দাঁড়ালেন। আর দেখলেন, লাইন আগাচ্ছেও। ভাবলেন, লাইন আগাবে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রে কেউ ঢুকতে পারবে না। কী আশ্চর্য, কেন্দ্রে ঢুকেও যাচ্ছে। ভাবলেন, সামনে সব সরকারি দলের লোক দাঁড়ানো। ওদের ঢোকানো হচ্ছে। তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হবে না। দেওয়া হলো। ভাবলেন, ঢুকলেও তাঁকে ব্যালট দেওয়া হবে না। ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে যেন সাংবাদিকরা সমস্যা না করে। ভেতরে তো আর সাংবাদিক নেই। তাঁর হাতে ব্যালটও ধরিয়ে দেওয়া হলো। না, ব্যালট দিলেও ভোট দিতে পারবেন না। ওর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ওরা ওদের মার্কায় ভোট দেবে। কিন্তু এবারও অন্যথা। ওকে নির্বিঘ্নে ভোটের জায়গায় ঢুকতে দেওয়া হলো। তিনি চাইলেই এখন তাঁর পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে দিতে পারেন। না, এর মধ্যে কোনো কারসাজি আছে। এই কারসাজির অংশীদার হওয়া যাবে না। নিজের প্রার্থীকে ভোট দিলে তো এই ভোট মেনে নেওয়া। তিনি করলেন কী, সরকারি দলের প্রার্থীকেই ভোট দিয়ে দিলেন। রাতের বেলা ঘোষিত ফলে দেখা গেল, বিপুল ভোটে সরকারি দলের প্রার্থী জয়ী এবং কোথাও কোনো গোলমালের খবর নেই।
তিনি নেতাকে গিয়ে কানে কানে নিজের অভিজ্ঞতা বললেন। নেতা সঙ্গে সঙ্গেই সংবাদ সম্মেলন করে ভোট বাতিল দাবি করলেন। তাঁর দাবি, ‘এই ভোট তো অবৈধ। আমাদের সমর্থকরা সরকারি দলের লোককে ভোট দিয়েছে, কাজেই তিনি পেয়েছেন সব অবৈধ ভোট। এই ভোটে জয়ী লোককে নির্বাচিত বলা যায় না।’
এটা কৌতুক হয়তো; কিন্তু এখন বিরোধী দলের কাছে ভোট মানে একটা অনিয়মের প্রত্যাশা করা। ভাঙচুর-মারামারি। ওরা জেতার চেয়ে এসবের অপেক্ষায়ই থাকে বেশি। তারা বিপদেও আছে। ভোটে জিতে গেলে আবার আরেক সমস্যা। সরকার বলবে, প্রমাণ হয়ে গেল এ সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব। সত্যি বললে, নির্বাচনী রাজনীতিতে সরকারি দল এমন সব ফাঁদ তৈরি করে রাখে যে বিরোধীরা বুঝতেই পারে না। এটাও আসলে এখন একটা কৌতূহল হয়ে দাঁড়িয়েছে, সরকার আসলে নির্বাচন নিয়ে বিরোধীদের সঙ্গে খেলাটা কিভাবে খেলে।
আর তাই নির্বাচনটা আসলে কৌতূহলের। কৌতূহল পৃথিবীর সব নির্বাচনেরই অনিবার্য অনুষঙ্গ।
লিখা- মোস্তফা মামুন, কথা সাহিত্যিক
সরকারি সমর্থকরা বলছেন, খুবই উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং ব্যাপক ভোটারের উপস্থিতিতে...যা তাঁরা সব সময় বলে থাকেন।
এক এলাকায় ভোটে খুবই খারাপ অবস্থা। কেউ ভোট দিতে পারছেন না। কেন্দ্র দখল করে রেখেছে গুণ্ডারা। প্রিসাইডিং অফিসার মহোদয় ওদের যথাসাধ্য সাহায্য-সহযোগিতা করছেন। স্বভাবতই ভোটার তমিজউদ্দিন ভোট দিতে পারলেন না। হতাশ হয়ে তিনি ভায়রাভাইকে ফোন করে নিজের দুঃখের কথা বলেন। ভায়রা শুনে বললেন, ‘বলো কী! তোমাদের এলাকায় এ রকম ভোট হচ্ছে?’
‘কেন, তোমাদের এলাকায় কি তোমরা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারছ?’
‘পারছি মানে...একেকজন ১০-১২টা করে ভোট দিচ্ছে। আমিই তো কয়েকটা দিয়ে খেতে এসেছি। খেয়ে গিয়ে আবার দেব। তুমি বরং চলে আসো। তোমাদের এলাকায় আরো যারা ভোট দিতে পারেনি ওদেরও নিয়ে আসো। এখানে ভোট দেওয়ার কোনো সমস্যা নেই।’
এ রকম নির্বিঘ্ন এবং ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার ভোট হলে অবশ্য আমাদের কোনো কথা নেই।
বিরোধী সমর্থকদের দাবি, সাজানো নির্বাচন হবে। ভোট হয়ে যাবে আগের রাতে। ভোটের দিন যা হবে তা হলো প্রহসন। লোক-দেখানো নাটক।
তাদের মতামত ধরলে ভোট আসলে হবে এ রকম। এক বিরোধী সমর্থক ভোটকেন্দ্রে গেছেন। তিনি আসলে গেছেন এ জন্য যে গিয়ে দেখবেন, ওখানে সরকারি দলের সমর্থকরা কেন্দ্র দখল করে রেখেছে। কেউ ভোট দিতে পারছে না। তিনি ছবি ওঠাবেন। তাঁদের দলের সংবাদ সম্মেলনের সময় ঠিক করে রাখা হয়েছে। ওখানে ভোটে কী কী অনিয়ম হয়েছে সেই সম্পর্কে বিস্তারিত বক্তব্য দেওয়া হবে। তিনি সেখানে উপস্থিত থেকে নিজের অভিজ্ঞতা শোনাবেন। দুঃসহ অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য তিনি পকেটে করে সাবধানে মোবাইলও লুকিয়ে এনেছেন। প্রামাণ্য ছবি তুলবেন। কেন্দ্রে গিয়ে অবাক হয়ে দেখলেন, মানুষ সুন্দর লাইন করে দাঁড়িয়েছে। তিনি ভাবলেন, লাইনটা লোক-দেখানো। লাইন আগাবে না। মজা দেখার জন্য লাইনে দাঁড়ালেন। আর দেখলেন, লাইন আগাচ্ছেও। ভাবলেন, লাইন আগাবে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রে কেউ ঢুকতে পারবে না। কী আশ্চর্য, কেন্দ্রে ঢুকেও যাচ্ছে। ভাবলেন, সামনে সব সরকারি দলের লোক দাঁড়ানো। ওদের ঢোকানো হচ্ছে। তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হবে না। দেওয়া হলো। ভাবলেন, ঢুকলেও তাঁকে ব্যালট দেওয়া হবে না। ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে যেন সাংবাদিকরা সমস্যা না করে। ভেতরে তো আর সাংবাদিক নেই। তাঁর হাতে ব্যালটও ধরিয়ে দেওয়া হলো। না, ব্যালট দিলেও ভোট দিতে পারবেন না। ওর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ওরা ওদের মার্কায় ভোট দেবে। কিন্তু এবারও অন্যথা। ওকে নির্বিঘ্নে ভোটের জায়গায় ঢুকতে দেওয়া হলো। তিনি চাইলেই এখন তাঁর পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে দিতে পারেন। না, এর মধ্যে কোনো কারসাজি আছে। এই কারসাজির অংশীদার হওয়া যাবে না। নিজের প্রার্থীকে ভোট দিলে তো এই ভোট মেনে নেওয়া। তিনি করলেন কী, সরকারি দলের প্রার্থীকেই ভোট দিয়ে দিলেন। রাতের বেলা ঘোষিত ফলে দেখা গেল, বিপুল ভোটে সরকারি দলের প্রার্থী জয়ী এবং কোথাও কোনো গোলমালের খবর নেই।
তিনি নেতাকে গিয়ে কানে কানে নিজের অভিজ্ঞতা বললেন। নেতা সঙ্গে সঙ্গেই সংবাদ সম্মেলন করে ভোট বাতিল দাবি করলেন। তাঁর দাবি, ‘এই ভোট তো অবৈধ। আমাদের সমর্থকরা সরকারি দলের লোককে ভোট দিয়েছে, কাজেই তিনি পেয়েছেন সব অবৈধ ভোট। এই ভোটে জয়ী লোককে নির্বাচিত বলা যায় না।’
এটা কৌতুক হয়তো; কিন্তু এখন বিরোধী দলের কাছে ভোট মানে একটা অনিয়মের প্রত্যাশা করা। ভাঙচুর-মারামারি। ওরা জেতার চেয়ে এসবের অপেক্ষায়ই থাকে বেশি। তারা বিপদেও আছে। ভোটে জিতে গেলে আবার আরেক সমস্যা। সরকার বলবে, প্রমাণ হয়ে গেল এ সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব। সত্যি বললে, নির্বাচনী রাজনীতিতে সরকারি দল এমন সব ফাঁদ তৈরি করে রাখে যে বিরোধীরা বুঝতেই পারে না। এটাও আসলে এখন একটা কৌতূহল হয়ে দাঁড়িয়েছে, সরকার আসলে নির্বাচন নিয়ে বিরোধীদের সঙ্গে খেলাটা কিভাবে খেলে।
আর তাই নির্বাচনটা আসলে কৌতূহলের। কৌতূহল পৃথিবীর সব নির্বাচনেরই অনিবার্য অনুষঙ্গ।
লিখা- মোস্তফা মামুন, কথা সাহিত্যিক
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন