একজন ভদ্র বন্ধু বরের সাথে বাউল সম্প্রদায় নিয়ে বেশ তর্ক হলো রাতে। তর্কের সূত্রপাত ছিল বাউলরা ভাববাদী না বস্তুবাদী। ভাবলাম "বাউলতত্ত্ব"র আলোকে বাউলরা ভাববাদী নাকি বস্তুবাদী তা নিয়ে যৌক্তিক আলোচনা আবশ্যম্ভাবী। কয়েকটি ধারাবাহিক পর্ব লিখে নিজের মনোভাব বোঝানোর চেষ্টা করব।
শুরুতেই শক্তিনাথ ঝাঁ এর বস্তুবাদী বাউল বই থেকে কিছু কথা লিখতে চাই; বাস্তব জগত ও জীবনকে এরা কোন আনুমানিক যুক্তি বা আলৌকিক যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে নারাজ। জৈব রাসায়নিক ব্যাখায় এরা নারীর রজঃ এবং পুরুষের বিজে জীবন ও জগত সৃষ্টিকে ব্যাখা করে এবং চার ভূতকে প্রাকৃতিক সৃষ্টি মনে করে। এভাবে মানুষে, প্রকৃতিতে তৈরি করে প্রাণ, প্রাণী। অনুমান ভিত্তিক স্বর্গ, নরক, পরলোক, পুনর্জন্মাদি প্রত্যক্ষ প্রমাণাভাবে বাউল আগ্রাহ্য করে। মানুষ ব্যাতিরিক্ত ঈশ্বরও এরা মানে না। সৃষ্টির নিয়মকে জেনে যিনি নিজেকে পরিচালনা করতে শিখেছেন- তিনিই সাঁই। সুস্থ নিরোগ দীর্ঘজীবন এবং আনন্দকে অনুভব করার বাউল সাধনা এক আনন্দমার্গ।।
বাউলরা ভাববাদী না বস্তুবাদী এর অনেক সূক্ষ বিশ্লেষণ শক্তিনাথের বস্তুবাদী বাউল বইটির মধ্যে আলকপাত করা হয়েছে। সাধারণ সমাজে এ ধারনা এখনো প্রতিনিয়ত জন্ম নিচ্ছে যে বাউল মানেই ভাববাদী এক দন্ডায়মান ব্যক্তি। পূর্বে থেকে আজ পর্যন্ত এ ধারণা প্রান্তিক সমাজে এখনো পোষ্য। কিন্তু ফকির লালন, কুবির গো সাঁই, লালশশী, দুদ্দু শাহ, পাঞ্জু শাহ, জালাল উদ্দিন খাঁ কিংবা শাহ আব্দুল করিমের গানে বস্তুবাদী ভাবনা ফিরে এসেছে।
বাউল শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে মতান্তর রয়েছে। কেউ বলেন 'বাতুল' থেকে 'বাউল' হয়েছে, কারো মতে 'বজ্রী' থেকে কিংবা 'বজ্রকুল' থেকে বাউল শব্দটি এসেছে। কেউ কেউ বলেন 'আউল' শব্দ থেকে 'বাউল হয়েছে। ইতিহাসবিদদের মতে, সতেরো শতকে বাংলাদেশে বাউল মতের উদ্ভব হয়। এ মতের প্রবর্তক হলেন আউল চাঁদ ও মাধববিবি। বীরভদ্র নামে এক বৈষ্ণব মহাজন সেই সময়ে একে জনপ্রিয় করে তোলেন।
বাউলদের বস্তুবাদের ছেঁকে নিতে হবে মারফতের মাধ্যমে। মারফত জানতে হয় মুর্শিদের মাধ্যমে। মুর্শিদ হলো সেই শক্তির আঁধার, যিনি শিষ্যকে সরল-গরল, ভালো- মন্দের ভেদ প্রভেদ বুঝিয়ে দেন। মুর্শিদ শিষ্যকে বাউলের গোপনীয় গুহ্যতত্ত্ব সম্পর্কে ধারণা দেন। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, বাউল মতবাদ একটি মানস পুরাণ। দেহের আধারে যে চেতনা বিরাজ করছে, সে-ই আত্মা । এই আত্মার খোজ বা সন্ধানই হচ্ছে বাউল মতবাদের প্রধান লক্ষ। বাউলরা আল্লা, ঈশ্বর কিংবা সৃষ্টিকর্তাকে নিরাকার মানতে নারাজ। ঈশ্বর নামক শক্তিকে তারা সাকার হিসেবেই মানেন। যেমন ভাটির পুরুষ শাহ আব্দুল করিম বলেছেন; "আমি কখনোই আসমানি খোদাকে মান্য করি না। মানুষের মধ্যে যে খোদা বিরাজ করে আমি তার চরণেই পূজো দেই। বাউল করিমের এ কোথায় স্পষ্ট ভাবেই প্রকাশ হয় যে বাউলরা নিরাকার সৃষ্টিকর্তা মানতে নারাজ। বাউলদের বিশ্বাস মানুষের মধ্যে সৃষ্টিকর্তা আসীন, তাই মানুষ ভোজলেই ঈশ্বরের নৈকট্য সম্ভব। এ প্রসঙ্গে ড. আহমেদ শরিফ তার বাউলতত্ত্ব গ্রন্থে লিখেছেন; বিভিন্ন মতবাদের মিশ্রণে গড়ে উঠেছে বাউল মত। হিন্দু-মুসলমানের মিলনে হয়েছে বাউল সম্প্রদায়। তাই পরমত সহিষ্ণুতা, অসাম্প্রদায়িকতা, গ্রহণশীলতা, বোধের বিচিত্রিতা, মনে বব্যাপকতা ও উদার সদাশয়তা এদের বৈশিষ্ট্য। মানুষ নির্বিশেষকে এমন উদার দৃষ্টিতে দেখা যে জীবন বোধের দারা সম্ভব, তার উৎস যে ধর্মমত-মরমীয়বাদ তা কখনো তুচ্ছ হতে পারে না। মুসলমান বাউলদের হিন্দু গুরু বা হিন্দু বাউলদের মুসলমান গুরু এমন প্রায়'ই দেখা যায়।
বাউল তত্ত্বের রয়েছে কয়েক ধাপ আদর্শ। গুরুবাদ, শাস্ত্রহীন সাধনা, দেহতত্ত্ব, মনের মানুষ, রুপ স্বরূপ তত্ত্ব হচ্ছে বাউল তত্ত্বের আদর্শ সমূহ।
১। গুরুবাদ - গুরু হচ্ছেন শিক্ষক, পরামর্শদাতা, পথ প্রদর্শক, মুর্শিদ। তিনি মানব গুরু এবং পরম পুরুষ দুই-ই। তাকে ঘিরেই গুরুতত্ত্ব । যেমন গুরু সম্পর্কে লালনের সহজ সরল স্বীকারোক্তি -- //যেই মুর্শিদ সেই তো রাসুল, ইহাতে নাই কোন ভুল,খোদাও সেই হয়; লালন কয় না এমন কথা, কোরানে কয়।।'
'মুর্শিদ বিনে কি ধন আছে রে এই জগতে?মুর্শিদ চরন সুধা, পান করিলে হবে ক্ষুধা; করোনা দেলে দ্বিধা।যে মুর্শিদ, সেই খোদা //
২। শাস্ত্রহীন সাধনা - বাউলরা মনে করে আনুষ্ঠানিক ধর্মীয় আচার পালন করে 'মনের মানুষ' পাওয়া যায়না। রীতি নীতি বিধান- বিহিতে কিছু নেই। তাই লালন গেয়েছিলেন-
//কার বা আমি কেবা আমার, আসল বস্তু ঠিক নাহি তার,বৈদিক মেঘে ঘোর অন্ধকার, উদয় হয়না দিনমণি //। //সত্য কাজে কেউ নাই রাজি সবই দেখি তা না না নাজাত গেলো জাত গেলো বলে এ কি আজব কারখানা//। //বেদ বিধির আগোচর সদাই কৃষ্ণপদ্ম নিত্য উদয়,লালন বলে মনের দ্বিধায় কেউ দেখেও দেখেনা //
৩। দেহতত্ত্ব - বাউল সাধকদের সাধনা দেহে উপর আশ্রয় করে গড়ে উঠে। কারন ঈশ্বর দেবতা সবই কাল্পনিক, মানুষের বিশ্বাস বিশেষ। সাধারন মানুষের জন্য এগুলো প্রতীক মাত্র। আসলে 'পরম পুরুষ' বাস করেন শরীরে।
তাই শরীরের সাধন শ্রেষ্ঠ সাধন। বৈষ্ণব কবি চণ্ডীদাস বলেছেন --//সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই//
৪। মনের মানুষ - মনের মানুষ হচ্ছে দেহস্থিত আত্মা। আত্মাই বহুনামের মানুষ - ভবের মানুষ, রসিক মানুষ, সোনার মানুষ, আলেক সাঁই ইত্যাদি। লালন তাকে স্মরণ করেন - //এই মানুষে আছেরে মন,যারে বলে মানুষ রতন।লালন বলে পেয়ে সে ধন, পারলাম নারে চিনিতে//
৫। রুপ-স্বরূপ তত্ত্ব - দেহ বা কান্তি চেতনাই সব। রুপ হচ্ছে নারী বা প্রকৃতি আর স্বরূপ হচ্ছে নর বা পুরুষ। রুপ এবং স্বরূপ এর দৈহিক মিলনেই সাধন সম্পূর্ণ হতে পারে। রুপ - সরূপ এর ভবের তাৎপর্য বুঝার জন্য হলেও তাদের মিলনের প্রয়োজন।
মূল বাউল তত্ব এর কোন জাত বিচার নেই। শ্রেণীহীন সহজ সরল জীবনের অভিসারী বাউলরা একেশ্বরবাদী, ত্যাগের আদর্শবাদী। কিন্তু সেই একেশ্বরবাদী সত্ত্বা মানেই আল্লাহ, ভগবান, ঈশ্বর কিংবা প্রচালিত কোন সৃষ্টিকর্তা হতেই হবে এমন কোন বাধ্য নিয়ম নেই, অনেক বাউল-ই Mysticism বা অতীন্দ্রিয়বাদে বা অদৃশ্য সত্ত্বায় বিশ্বাসী যাকে কোন নিদিষ্ট সৃষ্টিকর্তার আওতায় ফেলাকে এক অর্থে অসম্ভব ব্যাপার। কোন কোন বাউল সম্প্রদয়ের মতে, বাউল সাধনায় 'দেহ সাধনা' প্রধান বলেই নর-নারীর আঙ্গিক মিলন অপরিহার্য। এ হচ্ছে যুগল সাধনা। যুগল সাধনা দুই প্রকার - স্বকীয়া এবং পরকীয়া। তবে পরকীয়া বেশি প্রার্থিত। বাউলদের মতে 'পঞ্চরস' পান না করলে প্রকৃত সাধক হওয়া যায়না। যুগল সাধনার ক্ষেত্রে মুসলমান বাউল স্বকীয়া তথা স্ত্রীকেই সাধারণত সাধন-সঙ্গিনী করে।।
পরিশেষে বলা যায়, দম সাধনা- শ্বাস প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রন করে তত্ত্ব ধারণ করাই হচ্ছে বাউলদের মূল মতবাদ।
শুরুতেই শক্তিনাথ ঝাঁ এর বস্তুবাদী বাউল বই থেকে কিছু কথা লিখতে চাই; বাস্তব জগত ও জীবনকে এরা কোন আনুমানিক যুক্তি বা আলৌকিক যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে নারাজ। জৈব রাসায়নিক ব্যাখায় এরা নারীর রজঃ এবং পুরুষের বিজে জীবন ও জগত সৃষ্টিকে ব্যাখা করে এবং চার ভূতকে প্রাকৃতিক সৃষ্টি মনে করে। এভাবে মানুষে, প্রকৃতিতে তৈরি করে প্রাণ, প্রাণী। অনুমান ভিত্তিক স্বর্গ, নরক, পরলোক, পুনর্জন্মাদি প্রত্যক্ষ প্রমাণাভাবে বাউল আগ্রাহ্য করে। মানুষ ব্যাতিরিক্ত ঈশ্বরও এরা মানে না। সৃষ্টির নিয়মকে জেনে যিনি নিজেকে পরিচালনা করতে শিখেছেন- তিনিই সাঁই। সুস্থ নিরোগ দীর্ঘজীবন এবং আনন্দকে অনুভব করার বাউল সাধনা এক আনন্দমার্গ।।
বাউলরা ভাববাদী না বস্তুবাদী এর অনেক সূক্ষ বিশ্লেষণ শক্তিনাথের বস্তুবাদী বাউল বইটির মধ্যে আলকপাত করা হয়েছে। সাধারণ সমাজে এ ধারনা এখনো প্রতিনিয়ত জন্ম নিচ্ছে যে বাউল মানেই ভাববাদী এক দন্ডায়মান ব্যক্তি। পূর্বে থেকে আজ পর্যন্ত এ ধারণা প্রান্তিক সমাজে এখনো পোষ্য। কিন্তু ফকির লালন, কুবির গো সাঁই, লালশশী, দুদ্দু শাহ, পাঞ্জু শাহ, জালাল উদ্দিন খাঁ কিংবা শাহ আব্দুল করিমের গানে বস্তুবাদী ভাবনা ফিরে এসেছে।
বাউল শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে মতান্তর রয়েছে। কেউ বলেন 'বাতুল' থেকে 'বাউল' হয়েছে, কারো মতে 'বজ্রী' থেকে কিংবা 'বজ্রকুল' থেকে বাউল শব্দটি এসেছে। কেউ কেউ বলেন 'আউল' শব্দ থেকে 'বাউল হয়েছে। ইতিহাসবিদদের মতে, সতেরো শতকে বাংলাদেশে বাউল মতের উদ্ভব হয়। এ মতের প্রবর্তক হলেন আউল চাঁদ ও মাধববিবি। বীরভদ্র নামে এক বৈষ্ণব মহাজন সেই সময়ে একে জনপ্রিয় করে তোলেন।
বাউলদের বস্তুবাদের ছেঁকে নিতে হবে মারফতের মাধ্যমে। মারফত জানতে হয় মুর্শিদের মাধ্যমে। মুর্শিদ হলো সেই শক্তির আঁধার, যিনি শিষ্যকে সরল-গরল, ভালো- মন্দের ভেদ প্রভেদ বুঝিয়ে দেন। মুর্শিদ শিষ্যকে বাউলের গোপনীয় গুহ্যতত্ত্ব সম্পর্কে ধারণা দেন। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, বাউল মতবাদ একটি মানস পুরাণ। দেহের আধারে যে চেতনা বিরাজ করছে, সে-ই আত্মা । এই আত্মার খোজ বা সন্ধানই হচ্ছে বাউল মতবাদের প্রধান লক্ষ। বাউলরা আল্লা, ঈশ্বর কিংবা সৃষ্টিকর্তাকে নিরাকার মানতে নারাজ। ঈশ্বর নামক শক্তিকে তারা সাকার হিসেবেই মানেন। যেমন ভাটির পুরুষ শাহ আব্দুল করিম বলেছেন; "আমি কখনোই আসমানি খোদাকে মান্য করি না। মানুষের মধ্যে যে খোদা বিরাজ করে আমি তার চরণেই পূজো দেই। বাউল করিমের এ কোথায় স্পষ্ট ভাবেই প্রকাশ হয় যে বাউলরা নিরাকার সৃষ্টিকর্তা মানতে নারাজ। বাউলদের বিশ্বাস মানুষের মধ্যে সৃষ্টিকর্তা আসীন, তাই মানুষ ভোজলেই ঈশ্বরের নৈকট্য সম্ভব। এ প্রসঙ্গে ড. আহমেদ শরিফ তার বাউলতত্ত্ব গ্রন্থে লিখেছেন; বিভিন্ন মতবাদের মিশ্রণে গড়ে উঠেছে বাউল মত। হিন্দু-মুসলমানের মিলনে হয়েছে বাউল সম্প্রদায়। তাই পরমত সহিষ্ণুতা, অসাম্প্রদায়িকতা, গ্রহণশীলতা, বোধের বিচিত্রিতা, মনে বব্যাপকতা ও উদার সদাশয়তা এদের বৈশিষ্ট্য। মানুষ নির্বিশেষকে এমন উদার দৃষ্টিতে দেখা যে জীবন বোধের দারা সম্ভব, তার উৎস যে ধর্মমত-মরমীয়বাদ তা কখনো তুচ্ছ হতে পারে না। মুসলমান বাউলদের হিন্দু গুরু বা হিন্দু বাউলদের মুসলমান গুরু এমন প্রায়'ই দেখা যায়।
বাউল তত্ত্বের রয়েছে কয়েক ধাপ আদর্শ। গুরুবাদ, শাস্ত্রহীন সাধনা, দেহতত্ত্ব, মনের মানুষ, রুপ স্বরূপ তত্ত্ব হচ্ছে বাউল তত্ত্বের আদর্শ সমূহ।
১। গুরুবাদ - গুরু হচ্ছেন শিক্ষক, পরামর্শদাতা, পথ প্রদর্শক, মুর্শিদ। তিনি মানব গুরু এবং পরম পুরুষ দুই-ই। তাকে ঘিরেই গুরুতত্ত্ব । যেমন গুরু সম্পর্কে লালনের সহজ সরল স্বীকারোক্তি -- //যেই মুর্শিদ সেই তো রাসুল, ইহাতে নাই কোন ভুল,খোদাও সেই হয়; লালন কয় না এমন কথা, কোরানে কয়।।'
'মুর্শিদ বিনে কি ধন আছে রে এই জগতে?মুর্শিদ চরন সুধা, পান করিলে হবে ক্ষুধা; করোনা দেলে দ্বিধা।যে মুর্শিদ, সেই খোদা //
২। শাস্ত্রহীন সাধনা - বাউলরা মনে করে আনুষ্ঠানিক ধর্মীয় আচার পালন করে 'মনের মানুষ' পাওয়া যায়না। রীতি নীতি বিধান- বিহিতে কিছু নেই। তাই লালন গেয়েছিলেন-
//কার বা আমি কেবা আমার, আসল বস্তু ঠিক নাহি তার,বৈদিক মেঘে ঘোর অন্ধকার, উদয় হয়না দিনমণি //। //সত্য কাজে কেউ নাই রাজি সবই দেখি তা না না নাজাত গেলো জাত গেলো বলে এ কি আজব কারখানা//। //বেদ বিধির আগোচর সদাই কৃষ্ণপদ্ম নিত্য উদয়,লালন বলে মনের দ্বিধায় কেউ দেখেও দেখেনা //
৩। দেহতত্ত্ব - বাউল সাধকদের সাধনা দেহে উপর আশ্রয় করে গড়ে উঠে। কারন ঈশ্বর দেবতা সবই কাল্পনিক, মানুষের বিশ্বাস বিশেষ। সাধারন মানুষের জন্য এগুলো প্রতীক মাত্র। আসলে 'পরম পুরুষ' বাস করেন শরীরে।
তাই শরীরের সাধন শ্রেষ্ঠ সাধন। বৈষ্ণব কবি চণ্ডীদাস বলেছেন --//সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই//
৪। মনের মানুষ - মনের মানুষ হচ্ছে দেহস্থিত আত্মা। আত্মাই বহুনামের মানুষ - ভবের মানুষ, রসিক মানুষ, সোনার মানুষ, আলেক সাঁই ইত্যাদি। লালন তাকে স্মরণ করেন - //এই মানুষে আছেরে মন,যারে বলে মানুষ রতন।লালন বলে পেয়ে সে ধন, পারলাম নারে চিনিতে//
৫। রুপ-স্বরূপ তত্ত্ব - দেহ বা কান্তি চেতনাই সব। রুপ হচ্ছে নারী বা প্রকৃতি আর স্বরূপ হচ্ছে নর বা পুরুষ। রুপ এবং স্বরূপ এর দৈহিক মিলনেই সাধন সম্পূর্ণ হতে পারে। রুপ - সরূপ এর ভবের তাৎপর্য বুঝার জন্য হলেও তাদের মিলনের প্রয়োজন।
মূল বাউল তত্ব এর কোন জাত বিচার নেই। শ্রেণীহীন সহজ সরল জীবনের অভিসারী বাউলরা একেশ্বরবাদী, ত্যাগের আদর্শবাদী। কিন্তু সেই একেশ্বরবাদী সত্ত্বা মানেই আল্লাহ, ভগবান, ঈশ্বর কিংবা প্রচালিত কোন সৃষ্টিকর্তা হতেই হবে এমন কোন বাধ্য নিয়ম নেই, অনেক বাউল-ই Mysticism বা অতীন্দ্রিয়বাদে বা অদৃশ্য সত্ত্বায় বিশ্বাসী যাকে কোন নিদিষ্ট সৃষ্টিকর্তার আওতায় ফেলাকে এক অর্থে অসম্ভব ব্যাপার। কোন কোন বাউল সম্প্রদয়ের মতে, বাউল সাধনায় 'দেহ সাধনা' প্রধান বলেই নর-নারীর আঙ্গিক মিলন অপরিহার্য। এ হচ্ছে যুগল সাধনা। যুগল সাধনা দুই প্রকার - স্বকীয়া এবং পরকীয়া। তবে পরকীয়া বেশি প্রার্থিত। বাউলদের মতে 'পঞ্চরস' পান না করলে প্রকৃত সাধক হওয়া যায়না। যুগল সাধনার ক্ষেত্রে মুসলমান বাউল স্বকীয়া তথা স্ত্রীকেই সাধারণত সাধন-সঙ্গিনী করে।।
পরিশেষে বলা যায়, দম সাধনা- শ্বাস প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রন করে তত্ত্ব ধারণ করাই হচ্ছে বাউলদের মূল মতবাদ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন