সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মাঝি নৌকা ভিড়াও

মাঝি নৌকা ভিড়াও- আবদুস সামাদ আজাদ। শিরোনামটি কবি, সাংবাদিক আবু হাসান শাহরিয়ারের কাছ থেকে ধার করা। আবদুস সামাদ আজাদকে নিয়ে অনেক গল্প প্রখ্যাত সাংবাদিক পীর হাবিবুর রহমানের কাছে শোনা।
এ অঞ্চলে জননেতা বললে এই নামটিই ভেসে উঠে। ৬৫ বছরের রাজনৈতিক জীবনে ৫১ বছরই তিনি ছিলেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। জন মানুষের সুখ-দুঃখের সারথি ছিলেন আবদুস সামাদ আজাদ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনীতিতে পাঠ নেয়া আবদুস সামাদ আজাদ ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সকল আন্দোলনে অগ্রপথিক।
সিলেটে আওয়ামী লীগের এক সমাবেশে মরহুম দেওয়ান ফরিদ গাজী বক্তব্য দিচ্ছিলেন-সিলেটে এক সাইকেলে করে ঘুরে ঘুরে দলকে সংগঠিত করেছেন। তিনি যখন সাইকেল চালাতেন তখন পেছনে বসতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেওয়ান ফরিদ গাজী যখন বক্তব্য দিচ্ছিলেন তখন মঞ্চে ঘুমাচ্ছিলেন বর্ষিয়াণ রাজনীতিবিদ আবদুস সামাদ আজাদ। মঞ্চে তাঁর ডাক পড়তেই তিনি সোজা দাড়িয়ে বললেন- একখান না, সাইকেল ছিল দুইটা। একটা বঙ্গবন্ধু চালাতেন একটা তিনি নিজে।
তাঁর কলাবাগনের বাসভবনে গভীর রাত পর্যন্ত কর্মীদের নিয়ে রাজনৈতিক আড্ডায় মেতে ঊঠতেন তিনি। রাতজাগা রাজনীতি নিয়ে তোফায়েল আহমদ একবার বলেছিলেন- রাত যত বাড়ে সামাদ আজাদ তত জাগেন। ৯৬ সালে নির্বাচনের সময় এক রাতে লিডারের উপশহরের বাসায় নেতারা বসেছেন। রাত ১১ টায় তার অনুসারীরা বললেন, আমাদের লিডারেরতো রাত মাত্র শুরু। অন্যদের চোখে তখন রাজ্যের ঘুম। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী বললেন, আমরা যারা নতুন তাদের জন্য কর্মশালার আয়োজন করুন। অনেক কিছু শেখার বাকি আছে। দেওয়ান ফরিদ গাজী লিডারকে দেখিয়ে বললেন, স্কুলের হেডমাস্টার তো আছেনই। স্কুল শুরু করলেই হয়। লিডার দেওয়ান ফীরদ গাজীকেইঙ্গিত করে বললেন, উনি মাস্টার হিসেবে জয়েন করলে আমি হেড মাস্টারের দায়িত্ব নিতে রাজি।
৯৯ সালের শেষ দিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের বাইরে যাওয়ার আগে বিভিন্ন জেলার ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়ে যান। তবে, সুনামগঞ্জের ব্যাপারে কিছু না বলায় আওয়ামী রীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নেত্রীকে সুনামগঞ্জের ব্যাপারে কিছু বলার অনুরোধ করেন। ওই সময় আবদুস সামাদ আজাদ কিছু না বললেও কিছুক্ষণ পরে তোফায়েল আহমদকে উদ্দেশ্য করে ভোলার কিছু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর নাম ধরে বলেন, তারা আসবে একটু বসতে হবে।
আবদুস সামাদ আজাদ যখন সুনামগঞ্জে রাজনীতি করতেন তখন তিনিই সিদ্ধান্ত নিতেন। কাকে দিয়ে রাজনীতি করাতে হবে তা ভাবতেন। বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আবদুস সামাদ আজাদকে নেতা মেনেই আওয়ামী লীগে এসেছিলেন।
আজীবন তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে কখনো রাজপথ, কখনো জেল জীবন কখনো আন্ডারগ্রাউন্ড। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন মিছিলের অগ্রভাগে। তাঁর রাজনৈতিক ও সামাজিক মান ছিল আকাশ ছোয়া।
সামাদ আজাদ অন্য কোন গ্রহের মানুষ ছিলেন না। তিনি প্রায়ই বলতেন, আমি গ্রাম থেকে উঠে আসা মানুষ। হাওর-বাওড় অধ্যুষিত সুনামগঞ্জ থেকে এসেছি। গ্রামের মানুষের জীবন-প্রচলন আমার চাইতে কে ভালো বুঝবে।
তিনি বলতেন ‘আমি তো বর্ধিত জীবন নিয়েই বেঁচে আছি। আমার সহযোদ্ধা তাজউদ্দিন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, কামরুজ্জামানের সহযাত্রী হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। ৩ নভেম্বর ’৭৫ ছিল আমার মৃত্যুদিবস। কিন্তু মহান করুনাময় আমাকে জালেমদের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন।
বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের এক চরম ক্রান্তি লগ্নে হাল ধরেছিলেন আব্দুস সামাদ আজাদ। জাতির জনক হত্যাকান্ড, জেল হত্যাকান্ড, সামরিক শাসনের দাঁতাল পেশীশক্তি যখন আওয়ামী লীগকে ভীষণ দুর্বল করে তুলেছিল, তখন আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই হয়ে পড়েছিলেন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সে সময়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন সামাদ আজাদ। তাঁর অসম ধৈর্য, প্রজ্ঞা, বিচণতার ফলেই ১৯৭৮-৭৯ সালের পর থেকে আওয়ামী লীগ প্রাণ পেতে শুরু করেছিল পুরোমাত্রায়। সে সময় গ্রামে গ্রামান্তরে তিনি আপামর জনসাধারণকে যে সাহসটি তার বক্তব্যে দিয়ে বেড়াতেন তা হচ্ছে, আওয়ামী লীগকে কেউ ষড়যন্ত্র করে নিশ্চিহ্ন করতে পারবে না। মুজিব হত্যার বিচার বাংলাদেশে হবেই। তাঁর সে স্বপ্ন যে বাস্তবতার পরশ পেয়েছে তা বাংলাদেশের জনগণ শ্রদ্ধার সাথেই স্মরণ করবেন।
আজীবন সংসদীয় গনতন্ত্রের জন্য লড়াই করে গেছেন আব্দুস সামাদ আজাদ। তিনি খুব গর্ব করতেন যে তাঁর হাত দিয়েই ১৯৯৬ সালে সংসদীয় গনতন্ত্রে পুনঃ প্রত্যাবর্তনের বিলটি সংসদে উপস্থাপিত হয়।
আব্দুস সামাদ আজাদ ছিলেন হাওর পারের মানুষ। হাওর পারের মানুষদের তিনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। তিনি বুঝেছিলেন তাদের অন্তরের কথা।
আজ স্থাপনার নামকরণ নিয়ে যখন খিস্তিখেউর করেন তাঁর হাঠুর সমান নেতারা তখন তাঁর আত্মা ক্রন্দন করে। তিনি যেন অজান্তেই বলে উঠেন-মাঝি নৌকা ভিড়াও- আমি আবদুস সামাদ আজাদ।

লিখেছেন- ওহী আলম রেজা (ohee alom reza), সাংবাদিক (journalist)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাউল সাধক চান মিয়া এবং আমার কিছু উপলব্ধি

"রজনী হইসনা অবসান  আজ নিশিতে আসতে পারেবন্ধু কালাচাঁন।। কত নিশি পোহাইলোমনের আশা মনে রইলো রে কেন বন্ধু আসিলোনা জুড়ায়না পরান। আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন।। বাসর সাজাই আসার আশেআসবে বন্ধু নিশি শেষে দারূন পিরিতের বিষে ধরিল উজান। আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন।। মেঘে ঢাকা আঁধার রাতে কেমনে থাকি একা ঘরে সাধক চাঁনমিয়া কয় কানতে কানতে হইলাম পেরেশান আজ নিশিতে আসতে বন্দু কালাচাঁন।"    গভীর নিশিতে ধ্যান মগ্ন হয়ে কালাচাঁনের অপেক্ষা করছেন সাধক।  সাধক চান মিয়ার শিষ্য বাউল সিরাজউদ্দিনের মতে এটি একটি রাই বিচ্ছেদ। কৃষ্ণের অপেক্ষায় রাধা নিশি বা রাতকে অনুরোধ করছেন 'রাত' যেন না পোহায়  কারণ তার কালা চান যে কোন সময় আসতে পারে। শব্দগুচ্ছ গুলো থেকে সহজেই উপলব্ধি হয় সাধক নিজ দেহকে রাধা আর আত্মাকে কৃষ্ণের সাথে তুলনা করেছেন। দেহ আত্মার মিলন ঘটানোই ছিল সাধকের সাধনা।        বাউল সাধক চান মিয়া উপরোক্ত গানটি রচনা করেছেন। নেত্রকোনা জেলার খাটপুরা গ্রামে ১৩২৫ বঙ্গাব্দে সাধক চান মিয়ার জন্ম। পুরো নাম চান্দেজ্জামান আকন্দ হলেও বা...

বাউল, বাউলতত্ব এবং কিছু কথা

একজন ভদ্র বন্ধু বরের সাথে বাউল সম্প্রদায় নিয়ে বেশ তর্ক হলো রাতে। তর্কের সূত্রপাত ছিল বাউলরা ভাববাদী না বস্তুবাদী। ভাবলাম "বাউলতত্ত্ব"র আলোকে বাউলরা ভাববাদী নাকি বস্তুবাদী তা নিয়ে যৌক্তিক আলোচনা আবশ্যম্ভাবী। কয়েকটি ধারাবাহিক পর্ব লিখে নিজের মনোভাব বোঝানোর চেষ্টা করব।  শুরুতেই শক্তিনাথ ঝাঁ এর বস্তুবাদী বাউল বই থেকে কিছু কথা লিখতে চাই; বাস্তব জগত ও জীবনকে এরা কোন আনুমানিক যুক্তি বা আলৌকিক যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে নারাজ। জৈব রাসায়নিক ব্যাখায় এরা নারীর রজঃ এবং পুরুষের বিজে জীবন ও জগত সৃষ্টিকে ব্যাখা করে এবং চার ভূতকে প্রাকৃতিক সৃষ্টি মনে করে। এভাবে মানুষে, প্রকৃতিতে তৈরি করে প্রাণ, প্রাণী। অনুমান ভিত্তিক স্বর্গ, নরক, পরলোক, পুনর্জন্মাদি প্রত্যক্ষ প্রমাণাভাবে বাউল আগ্রাহ্য করে। মানুষ ব্যাতিরিক্ত ঈশ্বরও এরা মানে না। সৃষ্টির নিয়মকে জেনে যিনি নিজেকে পরিচালনা করতে শিখেছেন- তিনিই সাঁই। সুস্থ নিরোগ দীর্ঘজীবন এবং আনন্দকে অনুভব করার বাউল সাধনা এক আনন্দমার্গ।।  বাউলরা ভাববাদী না বস্তুবাদী এর অনেক সূক্ষ বিশ্লেষণ শক্তিনাথের বস্তুবাদী বাউল বইটির মধ্যে আলকপাত করা হয়েছে। সাধারণ সমাজে এ ধা...

ভাইবে রাধারমণ

তখন কলেজের ছাত্র। বাংলা বিভাগের প্রভাষক শ্রদ্ধেয় রেজা স্যারের সাথে খুবই ভালো সম্পর্ক। কলেজের প্রথম দিনই স্যারকে খুব পছন্দ। তারপর স্যারের সাথে গল্প, সমাজ, রাজনীতি, সাহিত্য নিয়ে আলোচনা। রীতিমত ফিজিক্স, বায়োলোজি ক্লাস ফাঁকি দিলেও বাংলা ক্লাস কখনই ফাঁকি দিতাম না। খুব উপভোগ করতাম স্যারের ক্লাস। হোস্টেল সুপার হিসেবে স্যার ( ওহী আলম রেজা) আমাদের সাথেই থাকতেন। আমরা আসার প্রায় নয় মাস পর স্যার এলেন সুপার হিসেবে। প্রতিদিন রাতে খাবার পরেই স্যারের রুমে গিয়ে আড্ডা হত, গানের আসর হত। স্যারের পিসিতে প্রায়ই গান শুনতাম আমরা। একদিন হঠাৎ করেই একটি গান স্যার প্লে করলেন 'আমার বন্ধু দয়াময় তোমারে দেখিবার মনে লয়। তোমারে না দেখলে রাধার জীবন কেমনে রয় বন্ধুরে।। কদম ডালে বইসারে বন্ধু ভাঙ্গ কদম্বের আগা। শিশুকালে প্রেম শিখাইয়া যৌবনকালে দাগা রে।। তমাল ডালে বইসারে বন্ধু বাজাও রঙের বাশি। সুর শুনিয়া রাধার মন হইলো যে উদাসি রে।। ভাইবে রাধা রমন বলে মনেতে ভাবিয়া। নিভা ছিল মনের আগুন কে দিলাই জ্বালাইয়া রে।' গানের কথাগুলো বেশ ভালো লেগে গেলো। পুর গানটি শুনে বুঝলাম গানটি সাধক রাধারম...