মসজিদটি তৈরি হয়েছিল এক রাতেই। জ্বিন-পরীরা সারারাত জেগে এই মসজিদ বানিয়েছে। অনেক রকমের কারুকার্যময় অলংকরণ ও পুরু দেয়াল গড়তে গড়তে রাত শেষ হয়ে যায়। দিনের আলোয় জ্বিন-পরীরা থাকে না, তাই গম্বুজের কাজ শুরু না করেই তারা চলে যায়। অসম্পূর্ণ থেকে যায় মসজিদটি- ঠাকুরগাঁওয়ের প্রাচীন মসজিদ সম্পর্কে প্রচলিত আছে এমনই লোককাহিনী।
ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়া মসজিদ
বছর খানেক আগে মজার এ গল্প শুনে হেসে উড়িয়ে দিলেও আগ্রহ জন্মেছিল একবার মসজিদটি দেখার। মাস দুয়েক আগে আসাদগেটে ঠাকুরগাঁয়ের ইতিহাস বিষয়ক এক আলোচনায় ব্যারিস্টার সাদিক ভাই সেই মসজিদ বিষয়ে কথা তুললেন। তিনি অনেক কিছুই জানালেন মসজিদ সম্পর্কে। অবাক হলাম জেনে যে মসজিদটি সাদিক ভাইদের পারিবারিক! আমার আগ্রহের কথা জেনে তিনি একটি ফোন নাম্বার দিয়ে বললেন যোগাযোগ করতে। নাম্বারটি ছিল শাহিদ চৌধুরীর। যিনি মসজিদটি পুনঃনির্মাণের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন।
ঠাকুরগাঁও গিয়েই প্রথমে শাহিদ চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলে সময় নির্ধারণ করে নিলাম। বেশ আন্তরিকতার সাথেই তিনি বালিয়ার চৌধুরী পরিবারে আমন্ত্রণ জানালেন। পরদিনই আমার সঙ্গী হলো রনি আর নির্ণয়। এরাও মসজিদটির ব্যাপারে বেশ কৌতূহলী। ঠাকুরগাঁও জেলাশহর থেকে উত্তর দিকে পঞ্চগড় মহাসড়ক ধরে দশ কিলোমিটার এগিয়ে গেলেই ভুল্লি বাজার। ভুল্লিবাজারে শাহিদ চৌধুরীর দেখা পেয়ে গেলাম। সুঠাম দেহ আর ফ্রেঞ্চ কাট দাড়িতে দারুণ স্মার্ট তিনি। হাসিমুখে স্বাগত জানালেন আমাদের।
তার গাড়িতেই চেপে বসলাম। চলতি পথে জেনে নিলাম শাহিদ চৌধুরী সম্পর্কে। স্কাউট ব্যাক্তিত্ব। দেশ বিদেশ ঘুরেছেন। এলাকার ইতিহাস নিয়ে কাজ করেন। ছবি তোলার হাতও দারুণ।
বাজার থেকে ডান দিকে তিন কিলোমিটার দূরে বালিয়া গ্রাম। সরু রাস্তা হলেও পাকা। দু’পাশে ঘন গাছ। গাড়ি ঠিক মসজিদের প্রবেশ মুখে এসে থামল। হাতের ডানে তাকিয়েই মনে হলো যেন মোঘল স্থাপত্যের নিদর্শন সমৃদ্ধ কোনও এলাকায় এসে পরেছি। গাছগাছালি ঘেরা লালচে স্থাপনা। উচু গম্বুজ উঁকি দিচ্ছে।
ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়া মসজিদ
ছায়াঘেরা শান্ত পরিবেশ। সদর দরজা, খোলা চত্বর আর মূল দালান তথা নামাজ ঘর- এই তিন অংশে মসজিদ কমপ্লেক্স। মোঘল স্থাপনার সঙ্গে বেশ সাদৃশ্যপূর্ণ। আমরা প্রথমে মসজিদের বাইরের দিকটি ঘুরে দেখছি। শাহিদ চৌধুরী জানালেন, মসজিদটি আগে এরকম ছিল না। ঘন জঙ্গলে চারপাশ পরিপূর্ণ ছিল। দেয়ালে শ্যাওলা, ইটের ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন রকমের জংলি গাছ উঁকি দিত। ছাদ, গম্বুজ অথবা দরজা জানালা ছিল না। তাই বৃষ্টিতে ভেতরটা বেশ স্যাঁতস্যাঁতে থাকতো। ভেতরে ছিল সাপের বসবাস। ‘আমরাই এই মসজিদের ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে এটিকে নামাজ আদায়ের উপযুক্ত করে তুলি। সেটা শুরু হয় ২০০৫ সালে। প্রায় পাঁচ বছর পর ২০১০ সালে মসজিদটি উদ্বোধন করা হয়’- বলেন শাহিদ চৌধুরী।
ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়া মসজিদ
জানলাম স্বনামধন্য ভাস্কর কামরুজ্জামান স্বাধীন এই চৌধুরী বংশেরই সন্তান। মূলত তিনিই মসজিদটির পুনঃনির্মানের পরিকল্পনা করেন। ভগ্ন দশা থেকে মসজিদটিকে বর্তমান এই রূপ দিতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে।
এবার মসজিদ দেখতে মনোযোগী হলাম। কোনও পিলার নেই মসজিদটিতে। ৪২ ইঞ্চি প্রশস্ত দেয়ালের উপরে দাঁড়িয়ে আছে সুন্দর এই মসজিদ। দেয়ালের চাইতে নিচের দিকের প্রশস্ততা অনেক বেশি। ভিত্তি পর্যন্ত এই প্রশস্ততা বেড়েছে। প্ল্যাটফর্মের দেয়াল একেবারে নিচের দিকে ৭৪ ইঞ্চি চওড়া। মাটির নিচে সেটি আরও বেশি। আয়তাকার এই মসজিদ উত্তর দক্ষিণে ৬৯ ফুট ২ ইঞ্চি আর পূর্ব পশ্চিমে ৬২ ফুট ৬ ইঞ্চি দীর্ঘ। তবে মূল ভবনটি ১৭ ইঞ্চি প্রশস্ত।
ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়া মসজিদ
মসজিদ নির্মাণে হাতে তৈরি ইটের সঙ্গে চুন সুরকীর ব্যবহার করা হয়েছে। অলংকৃত নকশাগুলো ঘণ্টা, আমলকি, কলস, বাটি, পদ্ম আকৃতির। যা অত্যন্ত সুনিপুণভাবে বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করা। দেয়ালে কোনও রকমের আস্তরণ নেই। পুরনো অবয়বের সাথে সামঞ্জস্য রেখে উপরে নির্মাণ করা হয়েছে তিনটি সুউচ্চ গম্বুজ। মসজিদের প্রধান ফটকটির দৈর্ঘ্য ২১ ফুট আর প্রস্থ ৯ ফুট। বিশাল আকৃতির সদর দরজাটিই এই মসজিদের অনন্য বৈশিষ্ট্য। এ রকম ফটকওয়ালা মসজিদ এই অঞ্চলে চোখে পড়বে না দ্বিতীয়টি।
ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়া মসজিদ
দুই গম্বুজবিশিষ্ট প্রবেশপথটি একটি স্বতন্ত্র স্থাপনা। মসজিদের ইতিহাস জানতে চাইলাম শাহিদ চৌধুরীর কাছে। তিনি জানান, মহারাজ নৃপেন্দ্র নারায়ণের অধিনস্থ শালবাড়ি পরগণার স্থানীয় বালিয়ার জমিদার কন্যা গুলমতি চৌধুরানীই মূলত এই মসজিদের নির্মাতা। তবে সমস্ত কর্মকাণ্ড তদারকি করতেন তার স্বামী মেহের বক্স চৌধুরী। মেহের বক্স চৌধুরীর পূর্বপুরুষ মোঘলদের সাথে এই এলাকায় আসেন বলে জানা যায়। তার আগ্রহেই ১৮৬০ সালের দিকে মসজিদ নির্মাণে এগিয়ে আসেন গুলমতি চৌধুরানী। ১৯০৫ সালে মেহের বক্স চৌধুরী মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত মসজিদের কাজ চলে। পরবর্তিতে নানা কারণে মসজিদটির কাজ আর এগোয়নি।
লিখা- সামিউল্লাাহ, সাংবাদ কর্মী
ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়া মসজিদ
বছর খানেক আগে মজার এ গল্প শুনে হেসে উড়িয়ে দিলেও আগ্রহ জন্মেছিল একবার মসজিদটি দেখার। মাস দুয়েক আগে আসাদগেটে ঠাকুরগাঁয়ের ইতিহাস বিষয়ক এক আলোচনায় ব্যারিস্টার সাদিক ভাই সেই মসজিদ বিষয়ে কথা তুললেন। তিনি অনেক কিছুই জানালেন মসজিদ সম্পর্কে। অবাক হলাম জেনে যে মসজিদটি সাদিক ভাইদের পারিবারিক! আমার আগ্রহের কথা জেনে তিনি একটি ফোন নাম্বার দিয়ে বললেন যোগাযোগ করতে। নাম্বারটি ছিল শাহিদ চৌধুরীর। যিনি মসজিদটি পুনঃনির্মাণের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন।
ঠাকুরগাঁও গিয়েই প্রথমে শাহিদ চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলে সময় নির্ধারণ করে নিলাম। বেশ আন্তরিকতার সাথেই তিনি বালিয়ার চৌধুরী পরিবারে আমন্ত্রণ জানালেন। পরদিনই আমার সঙ্গী হলো রনি আর নির্ণয়। এরাও মসজিদটির ব্যাপারে বেশ কৌতূহলী। ঠাকুরগাঁও জেলাশহর থেকে উত্তর দিকে পঞ্চগড় মহাসড়ক ধরে দশ কিলোমিটার এগিয়ে গেলেই ভুল্লি বাজার। ভুল্লিবাজারে শাহিদ চৌধুরীর দেখা পেয়ে গেলাম। সুঠাম দেহ আর ফ্রেঞ্চ কাট দাড়িতে দারুণ স্মার্ট তিনি। হাসিমুখে স্বাগত জানালেন আমাদের।
তার গাড়িতেই চেপে বসলাম। চলতি পথে জেনে নিলাম শাহিদ চৌধুরী সম্পর্কে। স্কাউট ব্যাক্তিত্ব। দেশ বিদেশ ঘুরেছেন। এলাকার ইতিহাস নিয়ে কাজ করেন। ছবি তোলার হাতও দারুণ।
বাজার থেকে ডান দিকে তিন কিলোমিটার দূরে বালিয়া গ্রাম। সরু রাস্তা হলেও পাকা। দু’পাশে ঘন গাছ। গাড়ি ঠিক মসজিদের প্রবেশ মুখে এসে থামল। হাতের ডানে তাকিয়েই মনে হলো যেন মোঘল স্থাপত্যের নিদর্শন সমৃদ্ধ কোনও এলাকায় এসে পরেছি। গাছগাছালি ঘেরা লালচে স্থাপনা। উচু গম্বুজ উঁকি দিচ্ছে।
ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়া মসজিদ
ছায়াঘেরা শান্ত পরিবেশ। সদর দরজা, খোলা চত্বর আর মূল দালান তথা নামাজ ঘর- এই তিন অংশে মসজিদ কমপ্লেক্স। মোঘল স্থাপনার সঙ্গে বেশ সাদৃশ্যপূর্ণ। আমরা প্রথমে মসজিদের বাইরের দিকটি ঘুরে দেখছি। শাহিদ চৌধুরী জানালেন, মসজিদটি আগে এরকম ছিল না। ঘন জঙ্গলে চারপাশ পরিপূর্ণ ছিল। দেয়ালে শ্যাওলা, ইটের ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন রকমের জংলি গাছ উঁকি দিত। ছাদ, গম্বুজ অথবা দরজা জানালা ছিল না। তাই বৃষ্টিতে ভেতরটা বেশ স্যাঁতস্যাঁতে থাকতো। ভেতরে ছিল সাপের বসবাস। ‘আমরাই এই মসজিদের ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে এটিকে নামাজ আদায়ের উপযুক্ত করে তুলি। সেটা শুরু হয় ২০০৫ সালে। প্রায় পাঁচ বছর পর ২০১০ সালে মসজিদটি উদ্বোধন করা হয়’- বলেন শাহিদ চৌধুরী।
ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়া মসজিদ
জানলাম স্বনামধন্য ভাস্কর কামরুজ্জামান স্বাধীন এই চৌধুরী বংশেরই সন্তান। মূলত তিনিই মসজিদটির পুনঃনির্মানের পরিকল্পনা করেন। ভগ্ন দশা থেকে মসজিদটিকে বর্তমান এই রূপ দিতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে।
এবার মসজিদ দেখতে মনোযোগী হলাম। কোনও পিলার নেই মসজিদটিতে। ৪২ ইঞ্চি প্রশস্ত দেয়ালের উপরে দাঁড়িয়ে আছে সুন্দর এই মসজিদ। দেয়ালের চাইতে নিচের দিকের প্রশস্ততা অনেক বেশি। ভিত্তি পর্যন্ত এই প্রশস্ততা বেড়েছে। প্ল্যাটফর্মের দেয়াল একেবারে নিচের দিকে ৭৪ ইঞ্চি চওড়া। মাটির নিচে সেটি আরও বেশি। আয়তাকার এই মসজিদ উত্তর দক্ষিণে ৬৯ ফুট ২ ইঞ্চি আর পূর্ব পশ্চিমে ৬২ ফুট ৬ ইঞ্চি দীর্ঘ। তবে মূল ভবনটি ১৭ ইঞ্চি প্রশস্ত।
ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়া মসজিদ
মসজিদ নির্মাণে হাতে তৈরি ইটের সঙ্গে চুন সুরকীর ব্যবহার করা হয়েছে। অলংকৃত নকশাগুলো ঘণ্টা, আমলকি, কলস, বাটি, পদ্ম আকৃতির। যা অত্যন্ত সুনিপুণভাবে বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করা। দেয়ালে কোনও রকমের আস্তরণ নেই। পুরনো অবয়বের সাথে সামঞ্জস্য রেখে উপরে নির্মাণ করা হয়েছে তিনটি সুউচ্চ গম্বুজ। মসজিদের প্রধান ফটকটির দৈর্ঘ্য ২১ ফুট আর প্রস্থ ৯ ফুট। বিশাল আকৃতির সদর দরজাটিই এই মসজিদের অনন্য বৈশিষ্ট্য। এ রকম ফটকওয়ালা মসজিদ এই অঞ্চলে চোখে পড়বে না দ্বিতীয়টি।
ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়া মসজিদ
দুই গম্বুজবিশিষ্ট প্রবেশপথটি একটি স্বতন্ত্র স্থাপনা। মসজিদের ইতিহাস জানতে চাইলাম শাহিদ চৌধুরীর কাছে। তিনি জানান, মহারাজ নৃপেন্দ্র নারায়ণের অধিনস্থ শালবাড়ি পরগণার স্থানীয় বালিয়ার জমিদার কন্যা গুলমতি চৌধুরানীই মূলত এই মসজিদের নির্মাতা। তবে সমস্ত কর্মকাণ্ড তদারকি করতেন তার স্বামী মেহের বক্স চৌধুরী। মেহের বক্স চৌধুরীর পূর্বপুরুষ মোঘলদের সাথে এই এলাকায় আসেন বলে জানা যায়। তার আগ্রহেই ১৮৬০ সালের দিকে মসজিদ নির্মাণে এগিয়ে আসেন গুলমতি চৌধুরানী। ১৯০৫ সালে মেহের বক্স চৌধুরী মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত মসজিদের কাজ চলে। পরবর্তিতে নানা কারণে মসজিদটির কাজ আর এগোয়নি।
লিখা- সামিউল্লাাহ, সাংবাদ কর্মী
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন