সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মানবপ্রেমের বন্দনা: বাউলরা বাঁচুক, বাউল আসর টিকে থাকুক





সাম্প্রতিককালে বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশেও মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, আঞ্চলিকতাবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা চরম সংকট তৈরি করেছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কেঁপে উঠেছে বাংলাদেশ তথা সারা বিশ্ব। ধর্মের দোহাই দিয়ে সিরিয়া, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিনের মাটি আজ রক্তাক্ত, বোমায় প্রকম্পিত বিশ্বের অনেক অঞ্চল। হাজার হাজার ভিন্ন মতালম্বী, সাধারণ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে সিরিয়ার বুকে। সেখানে নিকৃষ্ট ভাবে হত্যা করা হয়েছে অবুঝ শিশুদের। অনেকে প্রাণের ভয়ে ছেড়েছে দেশ। সাম্প্রদায়িক হামলায় ধ্বংস প্রাপ্ত হয়েছে রামুর বুদ্ধ মন্দিরের মত দেশ, বিদেশের হাজারো দর্শনীয় স্থান। জাত ধর্মের অবমাননার দোহাই দিয়ে জঙ্গীদের হিংস্র হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন দেশের অনেক লেখক, প্রকাশক। ধর্মীয় উস্কানি দিয়ে সাধারণ গ্রামীণ মানুষদের কাছে এসব হত্যাকাণ্ড জায়েজ করার চেষ্টায় ও লিপ্ত একদল কুচক্রী মহল।

নিঃসন্দেহেই একটি প্রশ্ন থেকে যায়, কেন বা কি কারণে এসব মৌলবাদী গোষ্ঠী মাথা ঝাড়া দিয়ে বারবার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিংবা কোন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের অভাবে বার বার মৌলবাদীদের মরণ ছোবল ।

আজ গ্রাম গঞ্জে যাত্রা, পালা , ঘাটু গান হয় না ব্যাক্তিগত ভাবে আমি মনে করি গ্রামীণ সামজে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের অভাবে মৌলবাদীরা চারণ ভূমি হিসেবে বেঁছে নিয়েছে সাধারণ গ্রামীণ অঞ্চলকে। সেখানে তারা বারবার চাষ করার চেষ্টায় আছে জঙ্গিবাদ,সাম্প্রদায়িকতার মত চরম সংকট। আর সংকট তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে গ্রামীণ বিনোদনের অন্যতম ক্ষেত্র বাউলগানের বিস্তৃতি কমে যাওয়ার বিষয়টিও একটি অন্যতম কারণ ।

যশোরে কি হয়েছিল, কি ঘটেছিল সেদিন! যশোরের সদর উপজেলার দেয়াড়া ইউনিয়নের ডুমদিয়া গ্রামের আমবাগানে চলছিল বাউল গানের আসর। হঠাৎ হামলা, বোমায় প্রকম্পিত গোটা আমবাগান। হামলাকারীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপায় বাউল শিল্পী মুক্তার হোসেনকে। ঘটনাস্থলেই তিনি নিহত হন।

একদিকে বাউল, পালা গানের আসর হারিয়ে যেতে বসছে অন্য দিকে বাড়ছে ওয়াজ মাহফিল। যেখানে নির্লজ্জভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতি, কৃষ্টির উপর। অপরদিকে হচ্ছে গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাউল সাধুদের উপর হামলা। প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ এবং হিন্দু-মুসলিমের দ্বন্দ্বে সেতুবন্ধের ভূমিকায় অবতীর্ণ সেই বাউলদের উপরে বারবার হামলা হয়েছে, হামলা হয়েছে তাদের গানের আসরে। আমরা কি ভুলে গেয়েছি রাজবাড়ির কথা।, যশোরের কথা, চুয়াডাঙ্গার কথা। রাজবাড়ি, যশোর বা চুয়াডাঙ্গা নয় বাংলাদেশের আনাচে কানাচে এমন শত অঞ্চলে বাউল ফকিরদের আর্তনাদ।

এ ত গেল যশোরের কথা। রাজবাড়ির কথা আমরা ভুলে যাই নি। ২০১১ সালের ৫ এপ্রিল, রাজবাড়ির পাংশার সাধুসঙ্গ উপলক্ষে সমবেত ২৮ লালনপন্থী সাধু-গুরুর ওপর হামলা চালালো দুবৃর্ত্তরা। এই হামলার পর রাজবাড়ী রূপক হয়ে ধরা দিল বাংলায়। নিন্দার ঝড় উঠলো। প্রকাশ্যে আসলো বাউল-ফকিরদের ওপর নিপীড়ন খবর। সেখানকার মুফতি রিয়াজ, এবং তার পিছনে ঢিকা দেয়া ক্ষমতাসীন দলের নেতা কর্মীদের সম্পৃক্তা বেরিয়ে আসলো।

বাউলগানের আসরে যেখানে মানুষের, মানবতার, কল্যানের, অসাম্প্রদায়িকতার গীত হতো, তা লোপ পাওয়ায় মানুষ-বন্দনা সম্পর্কিত মতবাদ প্রচারে অনেকটা ভাটা পড়েছে। প্রায় নীরবে-নিভৃতে চোখের অলক্ষে হারিয়ে যেতে বসেছে উজ্জ্বল সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হওয়া মানবপ্রেমের বন্দনামূলক গানের ক্ষেত্রটি। অথচ এর রোধ ঠেকাতে আমরা অনেকটাই নির্বিকার ভূমিকা পালন করছি। যদি মানবমুখী এসব গানের বিস্তৃতি ও পরিসর বাড়ানো সম্ভব হতো তাহলে ধর্মের নামে যেসব কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস সমাজে প্রচলিত রয়েছে সেসব থেকে সহজেই উত্তরণ সম্ভব হতো।

এ ত গেল রাজবাড়ির কথা। কিছু দিন আগে একই ভাবে চুয়াডাঙ্গার সদর উপজেলার আলোকদিয়া ইউনিয়নের আকন্দবাড়িয়া গ্রামের বাউল উৎসবের আয়োজক জাকারিয়া সরদারকে কুপিয়ে হত্যা করল দুর্বৃত্তরা। এভাবে প্রতিদিন দেশের আনাচে কানাচে অনেক বাউল সাধু অত্যাচারিত হচ্ছেন, ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে তাদের হাতের একতারা বা দোতার।

এসব কোন হামলার বিচার কি হয়েছে। কোন বাউল বা বাউল শিল্পী বিচার পেয়েছেন, পাননি! হামলার মামলার নথি কোথায়? হিমঘরে নাকি ডিপ ফ্রিজে !! এসবের কোন সঠিক উত্তর কি আছে হর্তা কর্তা দের কাছে? নেই, নেই’ই।
বাউল, সহজিয়াদের উপর হামলা, হত্যার বিচার চাই ...

লেখক-- 
মারূফ অমিত (Chowdhury Maruf) 
সাংবাদিক এবং ব্লগার
বাউল গানের আসর


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাউল সাধক চান মিয়া এবং আমার কিছু উপলব্ধি

"রজনী হইসনা অবসান  আজ নিশিতে আসতে পারেবন্ধু কালাচাঁন।। কত নিশি পোহাইলোমনের আশা মনে রইলো রে কেন বন্ধু আসিলোনা জুড়ায়না পরান। আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন।। বাসর সাজাই আসার আশেআসবে বন্ধু নিশি শেষে দারূন পিরিতের বিষে ধরিল উজান। আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন।। মেঘে ঢাকা আঁধার রাতে কেমনে থাকি একা ঘরে সাধক চাঁনমিয়া কয় কানতে কানতে হইলাম পেরেশান আজ নিশিতে আসতে বন্দু কালাচাঁন।"    গভীর নিশিতে ধ্যান মগ্ন হয়ে কালাচাঁনের অপেক্ষা করছেন সাধক।  সাধক চান মিয়ার শিষ্য বাউল সিরাজউদ্দিনের মতে এটি একটি রাই বিচ্ছেদ। কৃষ্ণের অপেক্ষায় রাধা নিশি বা রাতকে অনুরোধ করছেন 'রাত' যেন না পোহায়  কারণ তার কালা চান যে কোন সময় আসতে পারে। শব্দগুচ্ছ গুলো থেকে সহজেই উপলব্ধি হয় সাধক নিজ দেহকে রাধা আর আত্মাকে কৃষ্ণের সাথে তুলনা করেছেন। দেহ আত্মার মিলন ঘটানোই ছিল সাধকের সাধনা।        বাউল সাধক চান মিয়া উপরোক্ত গানটি রচনা করেছেন। নেত্রকোনা জেলার খাটপুরা গ্রামে ১৩২৫ বঙ্গাব্দে সাধক চান মিয়ার জন্ম। পুরো নাম চান্দেজ্জামান আকন্দ হলেও বা...

বাউল, বাউলতত্ব এবং কিছু কথা

একজন ভদ্র বন্ধু বরের সাথে বাউল সম্প্রদায় নিয়ে বেশ তর্ক হলো রাতে। তর্কের সূত্রপাত ছিল বাউলরা ভাববাদী না বস্তুবাদী। ভাবলাম "বাউলতত্ত্ব"র আলোকে বাউলরা ভাববাদী নাকি বস্তুবাদী তা নিয়ে যৌক্তিক আলোচনা আবশ্যম্ভাবী। কয়েকটি ধারাবাহিক পর্ব লিখে নিজের মনোভাব বোঝানোর চেষ্টা করব।  শুরুতেই শক্তিনাথ ঝাঁ এর বস্তুবাদী বাউল বই থেকে কিছু কথা লিখতে চাই; বাস্তব জগত ও জীবনকে এরা কোন আনুমানিক যুক্তি বা আলৌকিক যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে নারাজ। জৈব রাসায়নিক ব্যাখায় এরা নারীর রজঃ এবং পুরুষের বিজে জীবন ও জগত সৃষ্টিকে ব্যাখা করে এবং চার ভূতকে প্রাকৃতিক সৃষ্টি মনে করে। এভাবে মানুষে, প্রকৃতিতে তৈরি করে প্রাণ, প্রাণী। অনুমান ভিত্তিক স্বর্গ, নরক, পরলোক, পুনর্জন্মাদি প্রত্যক্ষ প্রমাণাভাবে বাউল আগ্রাহ্য করে। মানুষ ব্যাতিরিক্ত ঈশ্বরও এরা মানে না। সৃষ্টির নিয়মকে জেনে যিনি নিজেকে পরিচালনা করতে শিখেছেন- তিনিই সাঁই। সুস্থ নিরোগ দীর্ঘজীবন এবং আনন্দকে অনুভব করার বাউল সাধনা এক আনন্দমার্গ।।  বাউলরা ভাববাদী না বস্তুবাদী এর অনেক সূক্ষ বিশ্লেষণ শক্তিনাথের বস্তুবাদী বাউল বইটির মধ্যে আলকপাত করা হয়েছে। সাধারণ সমাজে এ ধা...

ভাইবে রাধারমণ

তখন কলেজের ছাত্র। বাংলা বিভাগের প্রভাষক শ্রদ্ধেয় রেজা স্যারের সাথে খুবই ভালো সম্পর্ক। কলেজের প্রথম দিনই স্যারকে খুব পছন্দ। তারপর স্যারের সাথে গল্প, সমাজ, রাজনীতি, সাহিত্য নিয়ে আলোচনা। রীতিমত ফিজিক্স, বায়োলোজি ক্লাস ফাঁকি দিলেও বাংলা ক্লাস কখনই ফাঁকি দিতাম না। খুব উপভোগ করতাম স্যারের ক্লাস। হোস্টেল সুপার হিসেবে স্যার ( ওহী আলম রেজা) আমাদের সাথেই থাকতেন। আমরা আসার প্রায় নয় মাস পর স্যার এলেন সুপার হিসেবে। প্রতিদিন রাতে খাবার পরেই স্যারের রুমে গিয়ে আড্ডা হত, গানের আসর হত। স্যারের পিসিতে প্রায়ই গান শুনতাম আমরা। একদিন হঠাৎ করেই একটি গান স্যার প্লে করলেন 'আমার বন্ধু দয়াময় তোমারে দেখিবার মনে লয়। তোমারে না দেখলে রাধার জীবন কেমনে রয় বন্ধুরে।। কদম ডালে বইসারে বন্ধু ভাঙ্গ কদম্বের আগা। শিশুকালে প্রেম শিখাইয়া যৌবনকালে দাগা রে।। তমাল ডালে বইসারে বন্ধু বাজাও রঙের বাশি। সুর শুনিয়া রাধার মন হইলো যে উদাসি রে।। ভাইবে রাধা রমন বলে মনেতে ভাবিয়া। নিভা ছিল মনের আগুন কে দিলাই জ্বালাইয়া রে।' গানের কথাগুলো বেশ ভালো লেগে গেলো। পুর গানটি শুনে বুঝলাম গানটি সাধক রাধারম...