সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ভাইবে রাধারমণ

তখন কলেজের ছাত্র। বাংলা বিভাগের প্রভাষক শ্রদ্ধেয় রেজা স্যারের সাথে খুবই ভালো সম্পর্ক। কলেজের প্রথম দিনই স্যারকে খুব পছন্দ। তারপর স্যারের সাথে গল্প, সমাজ, রাজনীতি, সাহিত্য নিয়ে আলোচনা। রীতিমত ফিজিক্স, বায়োলোজি ক্লাস ফাঁকি দিলেও বাংলা ক্লাস কখনই ফাঁকি দিতাম না। খুব উপভোগ করতাম স্যারের ক্লাস।
হোস্টেল সুপার হিসেবে স্যার ( ওহী আলম রেজা) আমাদের সাথেই থাকতেন। আমরা আসার প্রায় নয় মাস পর স্যার এলেন সুপার হিসেবে। প্রতিদিন রাতে খাবার পরেই স্যারের রুমে গিয়ে আড্ডা হত, গানের আসর হত। স্যারের পিসিতে প্রায়ই গান শুনতাম আমরা। একদিন হঠাৎ করেই একটি গান স্যার প্লে করলেন
'আমার বন্ধু দয়াময়
তোমারে দেখিবার মনে লয়।
তোমারে না দেখলে রাধার
জীবন কেমনে রয় বন্ধুরে।।
কদম ডালে বইসারে বন্ধু
ভাঙ্গ কদম্বের আগা।
শিশুকালে প্রেম শিখাইয়া
যৌবনকালে দাগা রে।।
তমাল ডালে বইসারে বন্ধু
বাজাও রঙের বাশি।
সুর শুনিয়া রাধার মন
হইলো যে উদাসি রে।।
ভাইবে রাধা রমন বলে
মনেতে ভাবিয়া।
নিভা ছিল মনের আগুন
কে দিলাই জ্বালাইয়া রে।'
গানের কথাগুলো বেশ ভালো লেগে গেলো। পুর গানটি শুনে বুঝলাম গানটি সাধক রাধারমণ দত্তের লিখা। সেদিন থেকেই জানতে শুরু করলাম ভাইবে রাধারমণ কে।
রাধারমণ দত্ত। পুরো নাম রাধারমণ দত্ত পুরকায়স্থ। যাকে আমরা ভাইবে রাধারমণ হিসেবেই চিনি, জানি। লোকসংগীতের পুরোধা লোককবি রাধারমন দত্ত জন্ম গ্রহণ করেন ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে ১২৪১বাংলায় সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার আতুয়জান পরগনার কেশবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা রাধামাধব দত্ত এবং মাতা সুর্বণা দেবীও ছিলেন বিদগ্ধ ব্যাক্তি। বিভিন্ন তথ্য ঘেঁটে জানা যায়, শ্রীহট্ট বা সিলেট অঞ্চলের পঞ্চখণ্ডে ত্রিপুরাধিপতি ধর্ম ফাঁ কর্তৃক সপ্তম শতকে মিথিলা হতে আনিত প্রসিদ্ধ পাঁচ ব্রাহ্মণের মধ্যে আনন্দ শাস্ত্রী নামক বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব রাধারমণ দত্তের পুর্ব পুরুষ ছিলেন বলে অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধির ঐতিহাসিক গ্রন্থ শ্রীহট্টের ইতিবৃত্তে পাওয়া যায়। আনন্দ শাস্ত্রীর প্রৌপুত্র নিধিপতি শাস্ত্রীর পুত্র ভানু নারয়ন নামক ব্যক্তি তত্কালিন মণুকুল প্রদেশে "ইটা" নামক রাজ্যের স্থপতি। উক্ত ভানু নারায়ণের চার পুত্রের মধ্যে রামচন্দ্র নারায়ণ বা ব্রহ্ম নারাণের এক পুত্র ছিলেন প্রভাকর। মুঘল সেনাপতি খোয়াজ উসমান দ্বারা ইটা রাজ্য অধিকৃত হলে, এই রাজ বংশের লোকগণ পালিয়ে গিয়ে আশে পাশের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় গ্রহন করেন । এ সময় প্রভাকর দত্ত তার পিতার সাথে আলিসারকুল চলে যান এবং সেখানে কিছু দিন বসবাস করার পর জগন্নাথপুর রাজ্যে এসে আশ্রয় নেন। কিছু দিন পর জগন্নাথপুর রাজ্যের তত্কালীন অধিপতি রাজা বিজয় সিংহের অনুমতিক্রমে প্রভাকর জগন্নাথপুরের নিকটস্থ কেশবপুর গ্রামে বাড়ী নির্মাণ করে সেখানে বসবাস করেন । পরবর্তিতে রাজা বিজয় সিংহ প্রভাকরের পুত্র সম্ভুদাস দত্তকে মন্ত্রী পদে নিয়োগ দেন। অতপর বানিয়াচংয়ের রাজা গোবিন্দ খা বা হবিব খার সাথে বিবাদে জগন্নাথপুর রাজ বংশের বিপর্য্যয়ের কারণ, রাজআশ্রীত কর্মচারিরাও দৈন্য দশায় পতিত হন । এ সময় সম্ভুদাস দত্তের পুত্র রাধামাদব দত্ত অন্যের দ্বারাস্থ না হয়ে, অনন্যচিত্তে সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করেন। রাধা মাধব দত্ত সংস্কৃত ভাষায় জয়দেবের বিখ্যাত গ্রন্থ গীত গোবিন্দ' বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন । এছাড়া তার রচিত ভ্রমর গীতিকা, ভারত সাবিত্রী, সূর্যব্রত পাঁচালি, পদ্ম-পুরাণ ও কৃষ্ণলীলা গীতিকাব্য উল্লেখযোগ্য। এই প্রসিদ্ধ কবি রাধামাধব দত্তই ছিলেন রাধারমণ দত্তের পিতা।
কিশোর বয়স থেকেই রাধরমণ সৃষ্টিত্বত্ত নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় উপাসনার প্রধান অবলম্বন সংগীতের সংগে তাঁর পরিচয় ছিল শৈশব থেকেই। ১২৫০ বঙ্গাব্দে রাধারমণ পিতৃহারা হবার পর পিতার রচিত গ্রন্থ গুলো আদর্শ হিসেবে তাঁর অন্তরে স্থান করে নেন। খ্যাতিমান লোককবি জয়দেবের 'গীতগৌবিন্দ' এর বাংলা অনুবাদ করেছিলেন তার পিতা রাধামাধব দত্ত। কিশোর থেকেই সাধক রাধারমণ দত্ত সৃষ্টিকর্তার স্বরূপ অনুসন্ধানে মনোনিবেশে করেন। গ্রামের সহজ সরল জীবন, শান্ত কোলাহলমুক্ত সমাজ আর পূজা-পার্বণে নানাবিধ অনুষ্ঠান তাকে আলোড়িত করে। নদীর বয়ে চলা, পালতোলা নৌকার উজান ভাটিতে যাওয়া, অবিরাম বৃষ্টি, বিশাল নীল আকাশ, পূর্ণিমার চাঁদ সবই তার ছেলেবেলার মধুর স্মৃতি। সাধনার জন্য তিনি বিভিন্ন সাধুসন্তের আদেশ উপদেশ অরে অরে পালন করতেন। এই ধারাবাহিকতায় তিনি মৌলভীবাজার এর ঢেউপাশা গ্রামের সাধক রঘুনাথ গোস্বামীর সাধন ভজনের কথা জ্ঞাত হয়ে তিনি তার শিষ্যত্ব গ্রহণ গ্রহণ করেন। শাক্ত, বৈষ্ণব, শৈব মতবাদেও উপর ব্যাপক পড়াশুনা করেন। সবশেষে তিনি সহজিয়া মতে সাধন ভজন করেন। এজন্য তিনি বাড়ির পাশে নলুয়ার হাওরের একটি উন্মুক্ত স্থানে পর্ণকুঠির তৈরী করে সেখানে সাধন ভজন করতে থাকেন। তিনি কৃষ্ণভাবে বিভোর হয়ে রাধাকৃষ্ণ প্রেমলীলা নিয়ে লোকগান রচনা করেন। তিনি ভজন সংগীতে বিভোর হয়ে গান রচানা করে নিজেই তা গাইতেন। তাঁর মুখের বাণীতে তাঁর শিষ্যগণ তা কাগজে লিখে রাখতেন। তাঁর নিজ হাতে রচিত গানের কোন পান্ডুলিপি নেই। কারণ তিনি তাৎনিকভাবে ভাবরসে বিভোর হয়ে গীতরচনা করতেন। কবি রাধারমণের পুরো পরিবারের পারিবারিক জীবন ধারায় বৈষ্ণব ও সুফীবাদেও প্রবল প্রভাব ছিল।
স্বভাবতই রাধারমণের জন্মস্থান বৃহত্তর সুনামগঞ্জ লোক সংস্কৃতিতে অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী এলাকা। এখানকার মাটিতে বহু লোককবি গীতিকার সাধু-সন্ত, সন্যাসী জন্ম গ্রহণ করেছেন এবং তাদের অমর রচনা বাণীতে বাংলার লোক সংস্কৃতিকে পরিপুর্ণ করে গড়ে তোলেছেন। সাধক গণ তাদের নিজ নিজ ধারায় মরমী সংগীতে কৃতিত্বের স্বার রেখেছেন। সেই সাধু সন্তদের মধ্যে মরমী কবি হাসন রাজা থেকে তিনি প্রায় ১৪/১৫ বছরের বড় ছিলেন। লোকমুখে শোনা যায়, হাছনরাজা রাধারমনকে তার সুনামগঞ্জের বাড়িতে দাওয়াত করে ছিলেন। লোককবিতার ভাষায় তিনি আহবান করেছিলেন ‘রাধারমন আছো কেমন, হাছন রাজা জানতে চায়।’ পত্র প্রাপ্তির পরে রাধারমন তার বাড়িতে যাওয়ার প্রস্ততি নিয়েও কি একটা অসুবিধায় যেতে পারেন নি। এ নিয়ে সাধকের একটি গান ও আছে ‘গানের সেরা রাজা হাছন, পেলাম না তার চরণ দর্শন, বিফলে দিন গেল গইয়া।’
বিভিন্ন সংগ্রাহকদের মতে, রাধারমন গানের সংখ্যা তিন হাজারেরও উপরে। তিনি তত্ত্ব সঙ্গীত, দেহতত্ত্ব, ভক্তিমূলক, অনুরাগ, প্রেম, ভজন, বিরহ, ধামাইলসহ নানা ধরণের গান রচনা করেছেন। বাংলার গ্রামবাংলার বিয়েশাদীতে রাধারমনের ধামাইল গান খুব জনপ্রিয়। ধামাইল এক প্রকার গান যা সমবেত নারীকণ্ঠে বিয়ের অনুষ্ঠানে গীত হয়। বিশেষত সিলেট অঞ্চলে একসময় ধামাইল গান ছাড়া বিয়ের অনুষ্ঠান পূর্ণতা পেত না। প্রতি গ্রামেই তখন ধামাইল গান গাওয়ার জন্য সংঘবদ্ধ মহিলাদের দল থাকতো। বাড়ির মা-কাকিরাও ধামাইল গান জানতেন। ধামাইল গাওয়ার রীতি অন্য গান থেকে কিছুটা ভিন্ন। মেয়েরা ঘরের ভেতর কিংবা বাড়ির উঠোনে গোল হয়ে প্রথমে দাঁড়ান। তারপর একজন গান শুরু করলে অন্যরাও কণ্ঠ মিলিয়ে হাততালি দিতে দিতে গোলাকার বৃত্তের মতো নেচে নেচে চক্কর দিয়ে দিয়ে গান গেয়ে যান। একটি গান শেষ হলে দলের মধ্য থেকে কোনো একজন নতুন আরেকটি গান শুরু করেন। বিয়ের তিন-চার দিন আগ থেকেই এভাবে বিয়ে বাড়িতে ধামাইল গান চলত। সাধক রাধারমণের রচিত বাউল ও ধামাইল গান সিলেটের আঙ্গিনা পেরিয়ে পুরো বাংলাদেশ ও সারা বিশ্বেও স্থান করে নিয়েছে।
সাধক রাধারমণ দত্তের বহুল প্রচলিত গানগুলোর মাঝে রয়েছে- ‘ভাইবে রাধারমণ বলে প্রেমানলে অঙ্গ জ্বলে গো’, কুঞ্জ সাজাও গিয়া, শ্যামকালিয়া সোনা বন্ধুরে, কঠিন শ্যামের বাঁশিরে, আজ যেন রে সুবল, জলে গিয়েছিলাম সই, ভ্রমর কইও গিয়া, ও আমি কার কারণে, কালায় প্রাণটি নিল, প্রাণ সখিরে, আমার বন্ধু দয়াময়, কারে দেখাবো মনের দুঃখ, আমার গলার হার, আমি রব না রব না, বিনোদিনী গো তোর, গুরু কাঙলে পানিয়া, ও রসিক নাইয়া, দেহতরী ছাইড়া দিলাম, দয়াল গুরু বিনে বন্ধু, আজি চিত্রপাট বিশাখে, শ্যামল বরণ রূপে, বল গো বল গো সখি, নিশীথে জাগিয়া, আমারে আসিবার কথা কইয়া ইত্যাদি। দুই বাংলার বেতার ও টেলিভিশনে রাধারমনের গান প্রায়স প্রচারিত হচ্ছে। বাংলা চলচ্চিত্রে রাধারমণের বেশ কিছু গান সংযোজিত হয়েছে। //ভ্রমর কইও গিয়া শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদেও অনলে অঙ্গ যায় জ্বলিয়ারে ভ্রমর কইও গিয়া// তাঁর একটি জনপ্রিয় গান।
সুরের দ্বারা মানুষের মনে নিজেকে ঠাইঁ করে নেয়া রাধারমনের গানের বেশ কিছু গানের বই বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। অধ্যাপক যতীন্দ্র মোহন ভট্টাচার্য প্রথমে রাধারমণ দত্তের গান সংগ্রহের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এছাড়া গুরু সদয়দত্ত, ডঃ নির্মলেন্দু ভৌমিক,আব্দুল গফফার চৌধুরী, কেতকীরঞ্জন গুন,মুহাম্মদ আব্দুল হাই, অধ্যাপক মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন, হুছন আলী, সৈয়দ মুরতাজা আলী, নরেশ চন্দ্র পাল, যামিনী কান্ত র্শমা, মুহম্মদ আসদ্দর আলী, মাহমুদা খাতুন, ডঃ বিজন বিহারী পুরকাস্থ, সৈয়দ মুস্তফা কামাল, মোঃ আজিজুল হক চুন্নু, জাহানারা খাতুন, নরেন্দ্র কুমার দত্ত চৌধুরী, অধ্যাপক সুধীর চন্দ্র পাল, অধ্যাপক দেওয়ান মোঃ আজরফ ,শামসুর করিম কয়েস সহ আরও বিদগ্ধজন রাধারমণ দত্তের গান সংগ্রহ কওে রেখেছেন। মুন্সী আশরাফ হোসেন সাহিত্যরত্ন ‘রাধারমন সঙ্গীত‘ নামে ও সুনামগঞ্জের মরহুম আব্দুল হাই ‘ভাইবে রাধারমন বলে’ নামে বই প্রকাশ করেছেন। প্রখ্যাত লোক তত্ত্ববিদ চৌধুরী গোলাম আকবর রাধারমনের প্রায় চল্লিশ বছরের সংগ্রহের গানগুলো নিয়ে সিলেট মদন মোহন কলেজ সাহিত্য পরিষদের মাধ্যমে একটি বই প্রকাশ করেন। এতে তার তিন শতাধিক লোকগান স্থান পায়। রাধারমনের বেশ কিছু গান বাংলা একাডেমীর সংগ্রহেও রয়েছে।
ব্যক্তি জীবনে রাধারমন দত্ত ছিলেন তিন পুত্রের জনক। তার দ্বিতীয় ও তৃতীয় পুত্রসহ স্ত্রী একযুগে মারা গেলে তার ভাবান্তর ঘটে এবং তার মনে বৈরাগ্য ভাবের সৃষ্টি হয়। সেই থেকেই তিনি সংসার ত্যাগী যোগীর মতো সাধন ভজনে মগ্ন হয়ে যান। তার প্রথম পুত্র বিপীন বিহারী দত্ত তখন তার মামার বাড়িতে মৌলভীবাজারের ভুজবল গ্রামে যান এবং সেখানে স্থায়ী বসবাস করেন। তার বংশধরেরা বর্তমানে সেখানে বসবাস করছেন। টানা ৩২ বছর তিনি ঈশ্বরের সাধনা করেছেন।
রাধারমন দত্ত ৮২ বছর বয়সে ১৩২২ বাংলার ২৬ কার্তিক ১৯১৫ খ্রীস্টাব্দে শুক্রবার শুকাষষ্ঠি তিথিতে পরলোকে গমন করেন। হিন্দুরীতি অনুযায়ী তাকে দাহ না করে বৈষ্ণব মতবাদ অনুযায়ী জগন্নাথপুর উপজেলার কেশবপুর গ্রামে তার মরদেহ সমাহিত করা হয়।
তার মৃত্যুর পর কেশরবপুর গ্রামের নরসিং মালাকারের স্ত্রী নিদুমনি দাস রাধারমনের সমাধিতে দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে সেবায়িতের কাজ করেছেন। বর্তমানে কেশবপুর গ্রামের রম্নু মালাকারের স্ত্রী অনিতা রাণী মালাকার রাধা রমন মন্দিরের দেখাশুনার কাজ করছেন।
পরিশেষে এটাই বলা যায় সাধক রাধারমণ দত্ত ছিলেন একজন সুর স্রষ্টা, দার্শনিক, মহাত্মা। কালের ধারায় মরমী এ সাধকের কথা, সুর, ধ্যান সাধনার সারকথা টিকে থাকুক আমাদের সমাজে, দেশে। ছড়িয়ে পড়ুক এ বিশাল পৃথিবীর বুকে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাউল সাধক চান মিয়া এবং আমার কিছু উপলব্ধি

"রজনী হইসনা অবসান  আজ নিশিতে আসতে পারেবন্ধু কালাচাঁন।। কত নিশি পোহাইলোমনের আশা মনে রইলো রে কেন বন্ধু আসিলোনা জুড়ায়না পরান। আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন।। বাসর সাজাই আসার আশেআসবে বন্ধু নিশি শেষে দারূন পিরিতের বিষে ধরিল উজান। আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন।। মেঘে ঢাকা আঁধার রাতে কেমনে থাকি একা ঘরে সাধক চাঁনমিয়া কয় কানতে কানতে হইলাম পেরেশান আজ নিশিতে আসতে বন্দু কালাচাঁন।"    গভীর নিশিতে ধ্যান মগ্ন হয়ে কালাচাঁনের অপেক্ষা করছেন সাধক।  সাধক চান মিয়ার শিষ্য বাউল সিরাজউদ্দিনের মতে এটি একটি রাই বিচ্ছেদ। কৃষ্ণের অপেক্ষায় রাধা নিশি বা রাতকে অনুরোধ করছেন 'রাত' যেন না পোহায়  কারণ তার কালা চান যে কোন সময় আসতে পারে। শব্দগুচ্ছ গুলো থেকে সহজেই উপলব্ধি হয় সাধক নিজ দেহকে রাধা আর আত্মাকে কৃষ্ণের সাথে তুলনা করেছেন। দেহ আত্মার মিলন ঘটানোই ছিল সাধকের সাধনা।        বাউল সাধক চান মিয়া উপরোক্ত গানটি রচনা করেছেন। নেত্রকোনা জেলার খাটপুরা গ্রামে ১৩২৫ বঙ্গাব্দে সাধক চান মিয়ার জন্ম। পুরো নাম চান্দেজ্জামান আকন্দ হলেও বা...

বাউল, বাউলতত্ব এবং কিছু কথা

একজন ভদ্র বন্ধু বরের সাথে বাউল সম্প্রদায় নিয়ে বেশ তর্ক হলো রাতে। তর্কের সূত্রপাত ছিল বাউলরা ভাববাদী না বস্তুবাদী। ভাবলাম "বাউলতত্ত্ব"র আলোকে বাউলরা ভাববাদী নাকি বস্তুবাদী তা নিয়ে যৌক্তিক আলোচনা আবশ্যম্ভাবী। কয়েকটি ধারাবাহিক পর্ব লিখে নিজের মনোভাব বোঝানোর চেষ্টা করব।  শুরুতেই শক্তিনাথ ঝাঁ এর বস্তুবাদী বাউল বই থেকে কিছু কথা লিখতে চাই; বাস্তব জগত ও জীবনকে এরা কোন আনুমানিক যুক্তি বা আলৌকিক যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে নারাজ। জৈব রাসায়নিক ব্যাখায় এরা নারীর রজঃ এবং পুরুষের বিজে জীবন ও জগত সৃষ্টিকে ব্যাখা করে এবং চার ভূতকে প্রাকৃতিক সৃষ্টি মনে করে। এভাবে মানুষে, প্রকৃতিতে তৈরি করে প্রাণ, প্রাণী। অনুমান ভিত্তিক স্বর্গ, নরক, পরলোক, পুনর্জন্মাদি প্রত্যক্ষ প্রমাণাভাবে বাউল আগ্রাহ্য করে। মানুষ ব্যাতিরিক্ত ঈশ্বরও এরা মানে না। সৃষ্টির নিয়মকে জেনে যিনি নিজেকে পরিচালনা করতে শিখেছেন- তিনিই সাঁই। সুস্থ নিরোগ দীর্ঘজীবন এবং আনন্দকে অনুভব করার বাউল সাধনা এক আনন্দমার্গ।।  বাউলরা ভাববাদী না বস্তুবাদী এর অনেক সূক্ষ বিশ্লেষণ শক্তিনাথের বস্তুবাদী বাউল বইটির মধ্যে আলকপাত করা হয়েছে। সাধারণ সমাজে এ ধা...