সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মা'য়ের দিনলিপি

"আর যাই করিস বাবা মানুষের কোন ক্ষতি করিস না, মানুষ সবাই সমান। মানুষকে সম্মান করিস"

আমি আমার মায়ের কথা বলছি। এই কথাগুলো আমার আপনার, পৃথিবীর প্রত্যেক মায়ের কথা। মনটা খুব একটা ভালো নয়। রাত ১.৫৮ বাজে,চুপচাপ বসে আছি। হঠাৎ করেই মায়ের প্রেসার ফল্ট। চুপচাপ ঘুমাচ্ছেন। মোটামুটি সুস্থ থাকেন, কিন্তু আজ হঠাত করেই অসুস্থ। নিজ হাতে ওষুধ খাওয়ালাম , ভাবছিলাম বাসায় ফিরে গল্প করব টুকটাক, তা আর হয় নাই। কতক্ষণ হাত মালিশ করে দিলাম পাশে বসে। ঘুমাচ্ছেন এবার।
মায়ের কথা বলছি তাই একটু ইমোশনাল। কানে বেজে চলছে "আমি খুঁজেছি তোমায় মাগো" গানটি। এই মানুষটির কথা বলে ত কয়েক হাজার পৃষ্ঠা লিখেও শেষ করা যাবেনা। শুধু আমার কেন, আপনাদের সবার মায়ের কথা যদি নিজ নিজ ভাবে বলতে শুরু করেন তবে শেষ হবে না।

জন্ম থেকেই দেখে আসছি এই মানুষটির ব্যস্ততা। দম ফালানোর সময় নেই তাঁর। স্কুল, স্কুলের বাচ্চারা, সংসার, মেহমান, রান্নাবান্না  করতে করতেই রাত ১১ টা। এরপর ঘুমালে মনে হয় যেন আর কোন হুঁশ নেই উনার। সকাল বেলা কাক ডাকা ভোরে ঘুম ভাঙ্গার পর থেকেই দৌড় ঝাপ শুরু। রাতে দরজা লক করা নিষেধ। ওয়াশরুমে যে কয়বার যাবেন দেখে যাবেন এসে কি করি। সকালের রান্না বানা করে বাবা, ভাই, আমি সবাইকে একে একে বিদায় করে নিজে স্কুলে যাবার জন্য রেডি। সকাল দুপুরের রান্না একসাথেই সকালেই করা। স্কুলের জন্য আয়োজন। ঝড় বৃষ্টি, কুয়াশা তুফান ডিঙিয়ে স্কুলে যাওয়া।

পড়ন্ত বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে যেন ক্লান্ত। বাসায় যেই থাকি না কেন এসেই স্কুলের বা দিনের টুকটাক গল্প। এক কাপ চা খেতে খেতে সবার খোঁজ নেওয়া। বাসায় মেহমান এলেত আর উপায় নেই। ১ মিনিটো না বসে সব ক্লান্তি ভুলে আবারো আয়োজন। এই এক মানুষের উপর সব। কেউ নেই এসব সামলানোর।

প্রায় ছোয় ফুট লম্বা এই মানবী কম যান না সবকিছুতে। আমাদের কারর মা'ই কম নন। সবাই স্পেশাল। সেই ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ এয়ার (কেবিন ক্রু) তে হইছিল উনার জব। সমস্যার কারণে যেতে পারলেন না। মুক্তিযোদ্ধার মেয়ে  ৮৭ ইংরেজীতে সরাসরি পেয়ে গেলেন প্রাইমারীতে চাকুরী। সেই থেকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁর। দুই ছেলে, সাধের ৯ বছর প্রেম করে পাওয়া স্বামী (আমার বাবা) নিয়ে বেশ আছেন। বাসায় যতগুলো বই সংগ্রহে আছে আমি সব গুলোর খবর বলতে পারিনা, তিনি পারেন। আমি আমার মা বলে বাড়িয়ে বলছি না এখনো রেগুলার বাংলা এবং ইংলিশ ডিকশেনারি থাকে উনার বেডের পাশে। সুযোগ পেলেই টুকটাক চোখ বুলান। বাসায় আসা অনেক বন্ধুরাই প্রায়ই বলে, কিরে মহাপন্ডিত এখন রাজনীতির বই বাদ দিয়ে ডিকশেনারি পড়িস!" যখন বলি মায়ের কথা বলি তখন অনেকেই চমকায়। আমার মা তিনি <3

কম বোঝেন না রাজনীতি। ৮০ দশকের অনেক রাজিনীতির ইতিহাস তার মুখস্ত। প্রায়ই বলেন, তরা কি করিস এখন , আমরা যেভাবে মিছিল দিয়েছি তোরা তা দেখিস ঈ নাই। মুজিববাদী ছাত্রলীগের রাজনীতি, তৎকালীন জাসদ ছাত্রলীগের রাজনীতি তার মুখস্ত। মাঝখানে যখন হেফাজতের ভাংচুরের লংমার্চ হল তখন একদিন মাকে বললাম, মোল্লারা কি চায় দেখছ নি? চাকরি বাকরি ত আর করতে পারবা না! মা উত্তর দিলেন, 'আগামী ১ হাজার বছরেও তারা কিছু করতে পারলে বলিস। আল্লা বিল্লাহ আমরাও করি। শিখাইছ না আমাকে।' কথায়ই বুঝেছিলাম কতখানি কনফিডেন্স নিয়ে বলেছিলেন। কয়েক আগের ১ টা ঘটনা বলি। পাশে বসে কয়েকটা পুরোনো ফাইল ঘাঁটছিলাম। হটাত করেই পেট্রোল বোমার আগুনের পরা কয়েকটা ছবি সামনে। দেখি দেখি বলে টেনে নিলেন। বীভৎস ছবি দেখে চোখ খানা লাল, জিজ্ঞেস করলাম কি হইছে? বললেন, কি আর হবে! কত মায়ের বুক যে খালি করলো ভীমরতিরা। ভাব্লাম প্রেসার হয়ত ফল্ট করবে। কাজ মাজ বাদ দিয়ে অন্য প্রসঙ্গ তুলে দিলাম। কোন মতে হালকা হল ব্যাপারটা।

পকেট খরচের জন্য সন্ধ্যায় হাত পাততেই হয়। বকাবকি করে ১ শ অথবা পঞ্চাশ রেগুলার ত দেবেনই। প্রচুর সিগারেট খাই জানেন। কিন্তু উনার ভিন্ন টেকনিক তা ছাড়ানোর জন্য। বকাবকি করবেন না, চিল্লাবেন না। বিভিন্ন কর্মশালা থেকে আনা ধূমপানের ক্ষতিকর দিকের লিফলেট গুলো হাতে তুলে দেবেন। বীভৎস কিছু ছবি দেখিয়ে ভয় দেখাবেন। মাঝে মধ্যে হাসি  উনার সিগারেট দমনের টেকনিক দেখে। পৃথিবীর এই একমাত্র মানুষ চোখ দেখেই বলে দিতে পারেন কি হচ্ছে, কি করেছি। ছোট ঘটনা বলে শেষ করব, কয়েকদিন আগে গিয়েছিলাম শ্রীমঙ্গল। আসা যাওয়া প্রায় দুইশ কিলো মোটর বাইকে রাইড। বেশী টেনশন করেন বলে বলছিলাম পাশের ইউনিয়নে যাচ্ছি কাজে। বাসায় রাতে ফেরার পর জিজ্ঞেস করলেন, মুচকি হেসে গেছিলি কৈ? বললাম ঘিলাছড়া। বললেন, মানুষ ৩ ঘন্টা হুন্ডা চালিয়ে ঘিলাছড়া যায়? কই গেসিলি মৌলভীবাজার না শ্রীমঙ্গল ? ধরা খেয়ে গেলাম, বললাম জানলা ক্যামনে ? বললেন, তর চোখ মুখ আর চুলের ধুলায় বলতেছে লং জার্নি করছিস। পুরাই টাস্কি খেয়ে চুপ মারলাম। এই হচ্ছেন মা <3

বলে শেষ করতে পারবনা। তারপরেও বললাম, কেউ বকা দেবেন না লম্বা লিখার জন্যি। ভালো লাগছে না তাই একটু লিখলাম। সবার মা'ই এরকম। কোন মা'ই কম নন, বরং যার যার জন্য বেশি। আজ মা দিবস। কিছু দিতে পারব না, করতেও পারব না। তবুও বললাম আই লাভ ইউ মা <3 সবার মাকে'ই শ্রদ্ধা। খুব খারাপ লাগছে, ইমশোনাল হয়ে গেছি।  আবারো বিশ্ব মা দিবসে সব মা'কে অজস্র শ্রদ্ধা ... <3

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাউল সাধক চান মিয়া এবং আমার কিছু উপলব্ধি

"রজনী হইসনা অবসান  আজ নিশিতে আসতে পারেবন্ধু কালাচাঁন।। কত নিশি পোহাইলোমনের আশা মনে রইলো রে কেন বন্ধু আসিলোনা জুড়ায়না পরান। আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন।। বাসর সাজাই আসার আশেআসবে বন্ধু নিশি শেষে দারূন পিরিতের বিষে ধরিল উজান। আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন।। মেঘে ঢাকা আঁধার রাতে কেমনে থাকি একা ঘরে সাধক চাঁনমিয়া কয় কানতে কানতে হইলাম পেরেশান আজ নিশিতে আসতে বন্দু কালাচাঁন।"    গভীর নিশিতে ধ্যান মগ্ন হয়ে কালাচাঁনের অপেক্ষা করছেন সাধক।  সাধক চান মিয়ার শিষ্য বাউল সিরাজউদ্দিনের মতে এটি একটি রাই বিচ্ছেদ। কৃষ্ণের অপেক্ষায় রাধা নিশি বা রাতকে অনুরোধ করছেন 'রাত' যেন না পোহায়  কারণ তার কালা চান যে কোন সময় আসতে পারে। শব্দগুচ্ছ গুলো থেকে সহজেই উপলব্ধি হয় সাধক নিজ দেহকে রাধা আর আত্মাকে কৃষ্ণের সাথে তুলনা করেছেন। দেহ আত্মার মিলন ঘটানোই ছিল সাধকের সাধনা।        বাউল সাধক চান মিয়া উপরোক্ত গানটি রচনা করেছেন। নেত্রকোনা জেলার খাটপুরা গ্রামে ১৩২৫ বঙ্গাব্দে সাধক চান মিয়ার জন্ম। পুরো নাম চান্দেজ্জামান আকন্দ হলেও বা...

বাউল, বাউলতত্ব এবং কিছু কথা

একজন ভদ্র বন্ধু বরের সাথে বাউল সম্প্রদায় নিয়ে বেশ তর্ক হলো রাতে। তর্কের সূত্রপাত ছিল বাউলরা ভাববাদী না বস্তুবাদী। ভাবলাম "বাউলতত্ত্ব"র আলোকে বাউলরা ভাববাদী নাকি বস্তুবাদী তা নিয়ে যৌক্তিক আলোচনা আবশ্যম্ভাবী। কয়েকটি ধারাবাহিক পর্ব লিখে নিজের মনোভাব বোঝানোর চেষ্টা করব।  শুরুতেই শক্তিনাথ ঝাঁ এর বস্তুবাদী বাউল বই থেকে কিছু কথা লিখতে চাই; বাস্তব জগত ও জীবনকে এরা কোন আনুমানিক যুক্তি বা আলৌকিক যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে নারাজ। জৈব রাসায়নিক ব্যাখায় এরা নারীর রজঃ এবং পুরুষের বিজে জীবন ও জগত সৃষ্টিকে ব্যাখা করে এবং চার ভূতকে প্রাকৃতিক সৃষ্টি মনে করে। এভাবে মানুষে, প্রকৃতিতে তৈরি করে প্রাণ, প্রাণী। অনুমান ভিত্তিক স্বর্গ, নরক, পরলোক, পুনর্জন্মাদি প্রত্যক্ষ প্রমাণাভাবে বাউল আগ্রাহ্য করে। মানুষ ব্যাতিরিক্ত ঈশ্বরও এরা মানে না। সৃষ্টির নিয়মকে জেনে যিনি নিজেকে পরিচালনা করতে শিখেছেন- তিনিই সাঁই। সুস্থ নিরোগ দীর্ঘজীবন এবং আনন্দকে অনুভব করার বাউল সাধনা এক আনন্দমার্গ।।  বাউলরা ভাববাদী না বস্তুবাদী এর অনেক সূক্ষ বিশ্লেষণ শক্তিনাথের বস্তুবাদী বাউল বইটির মধ্যে আলকপাত করা হয়েছে। সাধারণ সমাজে এ ধা...

ভাইবে রাধারমণ

তখন কলেজের ছাত্র। বাংলা বিভাগের প্রভাষক শ্রদ্ধেয় রেজা স্যারের সাথে খুবই ভালো সম্পর্ক। কলেজের প্রথম দিনই স্যারকে খুব পছন্দ। তারপর স্যারের সাথে গল্প, সমাজ, রাজনীতি, সাহিত্য নিয়ে আলোচনা। রীতিমত ফিজিক্স, বায়োলোজি ক্লাস ফাঁকি দিলেও বাংলা ক্লাস কখনই ফাঁকি দিতাম না। খুব উপভোগ করতাম স্যারের ক্লাস। হোস্টেল সুপার হিসেবে স্যার ( ওহী আলম রেজা) আমাদের সাথেই থাকতেন। আমরা আসার প্রায় নয় মাস পর স্যার এলেন সুপার হিসেবে। প্রতিদিন রাতে খাবার পরেই স্যারের রুমে গিয়ে আড্ডা হত, গানের আসর হত। স্যারের পিসিতে প্রায়ই গান শুনতাম আমরা। একদিন হঠাৎ করেই একটি গান স্যার প্লে করলেন 'আমার বন্ধু দয়াময় তোমারে দেখিবার মনে লয়। তোমারে না দেখলে রাধার জীবন কেমনে রয় বন্ধুরে।। কদম ডালে বইসারে বন্ধু ভাঙ্গ কদম্বের আগা। শিশুকালে প্রেম শিখাইয়া যৌবনকালে দাগা রে।। তমাল ডালে বইসারে বন্ধু বাজাও রঙের বাশি। সুর শুনিয়া রাধার মন হইলো যে উদাসি রে।। ভাইবে রাধা রমন বলে মনেতে ভাবিয়া। নিভা ছিল মনের আগুন কে দিলাই জ্বালাইয়া রে।' গানের কথাগুলো বেশ ভালো লেগে গেলো। পুর গানটি শুনে বুঝলাম গানটি সাধক রাধারম...