"রজনী হইসনা অবসান
আজ নিশিতে আসতে পারেবন্ধু কালাচাঁন।।
কত নিশি পোহাইলোমনের আশা মনে রইলো রে
কেন বন্ধু আসিলোনা জুড়ায়না পরান।
আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন।।
বাসর সাজাই আসার আশেআসবে বন্ধু নিশি শেষে
দারূন পিরিতের বিষে ধরিল উজান।
আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন।।
মেঘে ঢাকা আঁধার রাতে কেমনে থাকি একা ঘরে
সাধক চাঁনমিয়া কয় কানতে কানতে হইলাম পেরেশান
আজ নিশিতে আসতে বন্দু কালাচাঁন।"
গভীর নিশিতে ধ্যান মগ্ন হয়ে কালাচাঁনের অপেক্ষা করছেন সাধক। সাধক চান মিয়ার শিষ্য বাউল সিরাজউদ্দিনের মতে এটি একটি রাই বিচ্ছেদ। কৃষ্ণের অপেক্ষায় রাধা নিশি বা রাতকে অনুরোধ করছেন 'রাত' যেন না পোহায় কারণ তার কালা চান যে কোন সময় আসতে পারে। শব্দগুচ্ছ গুলো থেকে সহজেই উপলব্ধি হয় সাধক নিজ দেহকে রাধা আর আত্মাকে কৃষ্ণের সাথে তুলনা করেছেন। দেহ আত্মার মিলন ঘটানোই ছিল সাধকের সাধনা।
বাউল সাধক চান মিয়া উপরোক্ত গানটি রচনা করেছেন। নেত্রকোনা জেলার খাটপুরা গ্রামে ১৩২৫ বঙ্গাব্দে সাধক চান মিয়ার জন্ম। পুরো নাম চান্দেজ্জামান আকন্দ হলেও বাউল চান মিয়া নামে সুপরিচিত। পিতা মিয়া হোসেন আকন্দ। ছোটবেলা থেকেই বাউল গান বাজনার আকৃষ্ট ছিলেন। পিতা মাতার অনিহা সত্ত্বেও রঙ্গুমিয়া নামক গায়কের নিকট হতে গান চর্চা শুরু করেন। পরবর্তীতে তৈয়ব রাজ বাউলের কাছে সঙ্গীত সাধনা করেন। ১৫ বছর বয়সে গান রচনায় পারদর্শী হয়ে উঠেন। তাঁর লেখা প্রথম গান “বন্ধুর মুখের হাসিরে কত ভালবাসি রে”/ 'সুরেশ্বরী চান' গীতিকা বাউল কবি চান মিয়াঁ একটি অনবদ্য রচনা;
"কই গেলা গো সুরেশ্বরী এই জগতে এসেছিলা জানুবাবা নামটি ধরি ।।
আমিতো মুছাফির বেশে, ডাকিতেছি রওজায় বসে ।
দেখা দাওগো হেসে হেসে ভব জ্বালা বারন করি ।।
বেহেস্তে না যাইতে চাই, দোযকেরে নাহি ডরাই ।
আমি শুধু তোমাকে চাই দেখিতাম নয়ন ভরি ।।
তোমার নামে মধু ভরা মানুষ হইল খাইল যারা ।
দরওয়াজাতে আছি খাড়া পাইতে চরন তরী ।।
বাউল চান মিয়াঁ বলে, জালাল চান্দের চরন তোলে।
দয়া যদি লাগে দিলে দানকরিয়া যাও ফকিরি ।।
জামাই থুইয়া বউ গেল বিদেশে নবীন বয়সে ।।
দয়া মায়া নাইরে বউয়ের ফিরিয়া না আসে,
জামাই দুঃখে প্রতিবেশী নয়ন জলে ভাসে ।
আতর সুরমা দিয়া জামাই সাজল রঙ্গে রসে,
সাড়া শব্দ নাহি মুখে শিয়র নাই বালিশে ।।
জামাই সঙ্গে যাইতে কত সাজিল দেশে দেশে,
দোতলা এক মন্দিরেতে দিবে নিয়া নির্বাসে ।।
কত যুগ যুগান্তর থাকিবে এই বেশে,
চান মিয়াঁ জায়গা করিয় সুরেশ্বরীর দেশে ।।"
পর্যায়ক্রমে বাউল কবি রশিদ উদ্দিনের সান্নিধ্য পান এবং শিষ্যত্ব গ্রহন করেন। বাউল চান মিয়া একাগ্রচিত্তে ৪৫ বৎসর সঙ্গীত সাধনায় অতিবাহিত করেন। জীবনের পড়ন্ত লগ্নে পীর ক্বারী মহিউদ্দিন আল শেরপুরির কাছ থেকে খেলাফত প্রাপ্ত হন। বাউল কবি চান মিয়া তাঁর জীবদ্দশায় প্রায় হাজার তিনেক গান রচনা করেন। তাঁর সাধন সঙ্গিনীর নাম ছিল আয়রা চান। পাঁচ পুত্র, দুই কন্যা সন্তান ছিল। তন্মধ্যে পুত্র বাউল আজাদ মিয়া অত্র অঞ্চলে প্রসিদ্ধ একজন বাউল সাধক। বাংলা ২৮শে শ্রাবণ ১৩৯৯ সনে এই মহান সাধক দেহ ত্যাগ করেন। যতদূর জানি, রজনী হইসনা অবসান’ এই গানটি নিয়ে নেত্রকোনা অঞ্চলে বিতর্ক আছে। বাউল সাধক চান মিয়ার ছেলে বাউল আজাদ মিয়াকে নিয়ে। বাউল আজাদ মিয়া দাবি করেন এই গানটি তার রচিত ও সুরকরা তাঁর দাবী বারি সিদ্দিকী এই গানের কথা ও সুর বিকৃত করেছেন এবং গানের শেষ অন্তরায় তার নামের পরিবর্তে সাধক চান মিয়ার নাম উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সাধক চান মিয়ার শিষ্য সিরাজ উদ্দিন পাঠানের মতে চান মিয়াঁর মৃত্যুর পর তার ছেলে বাউল আজাদ মিয়া তার প্রকাশিত গানের বইয়ে চান মিয়ার রচিত অসংখ্য গান নিজের নামে প্রকাশ করেছেন।
রজনী হইসনা অবসান গানটি আমার খুব'ই প্রিয়। বর্তমানে খ্যাতিমান কন্ঠশিল্পী বারী সিদ্দিকীর কণ্ঠে ধারণ করা এই গানটি প্রতিদিন'ই বেশ কয়েকবার শুনি। গানটির এই লাইনটি 'সাধক চাঁনমিয়া কয় কানতে কানতে হইলাম পেরেশান' আমার কাছে খুব প্রিয়। অচেনা,অজানা কোন এক ভাবনায় আমারও নিশি কাটে। নিদ্রাহীন পোহানো নিশিতে প্রায়'ই চোখের পানি ফেলি। গানের কথা গুলোর সাথে নিজের জীবনের মিল খুঁজি। নিস্তব্ধ নিদ্রাহীন প্রতি রাতে এই গানের সুরে গা ভাসিয়ে দেই ,ডুবে যাই কোন এক ভব সাগরে ............
সাদক চানমিয়ার নিজ কন্টে গান কি নেই
উত্তরমুছুন