বাউল কবিদের গান শুনতে খুবই পছন্দ করি। বাউল ফকিরদের জীবন ধারা পছন্দের। বাউল গানগুলো আমার নিত্যদিনের সঙ্গী। নীলাভ বিষাদ, চাপা দুঃখ, আনন্দ, হৈ- হৈ- হৈ হুল্লোড়ের সময় গানগুলোর সাথে স্বভাবতই মিতালী গড়ি, গানগুলোর সুরের মূর্ছনায় ডুবিয়ে দেই নিজেকে। ফকির লালন সাঁই, শাহ আব্দুল করিম, হাসন রাজা, উকিল মুন্সী, দূরবীন শাহ, বিজয় সরকার, বাউল চান মিয়া সহ অজস্র বাউল ফকিরদের রচিত গানের শ্রোতা আমি।
এমন কিছু গান আছে যেগুলো চুপচাপ নিদ্রাহীন একা রাতে নিজেকে নতুন করে গড়তে শিখায়- ভেঙ্গে দেয়, আবার নিজেকে নিজের মত করে গড়তে শিখায়। ছোট্ট একটি ঘটনা বলা যায়, গত কয়েকদিন আগে বিশ্ব বন্ধু দিবসে তরুণ চিত্রশিল্পী আব্দুল বাতিন ভাইয়ের স্কুল অফ লিবারেট আর্ট’এ গিয়েছিলাম আড্ডা দিতে। সেখান থেকে হুটহাট প্লানে চলে গেলাম উনার বাসায়। কবি স্বজল ছত্রী, বাতিন ভাই এবং আমি আড্ডা মারলাম লম্বা সময়। ক্লান্ততা রোধে রাত আনুমানিক তিনটার দিকে যখন উনার বিছানায় বিশ্রাম নিচ্ছি তখন হঠাৎ উনার বেডের ডান পাশের দেয়ালে চোখ পড়তেই থমকে গেলাম। কফিনে শুয়ে থাকা এক মরদেহের ছবি। চারপাশে অন্ধকারে ঘিরে থাকা সামান্য কিছু আলো পড়েছে মৃতদেহের মুখের উপর। ছবিটি অদ্ভুত সুন্দর এবং ভয়ানক। চুপচাপ ছবিটির দিকে চেয়ে থাকলাম অনেকক্ষণ।
উঠে এসে নিকোটিন গিলতে গিলতে বাতিন ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম ছবিটি সম্পর্কে। ছবিটি সম্পর্কে শুধু এটুকুই বললেন এটা তিনি নিজে এবং এটাই তার শেষ পরিণতি। সাথে সাথেই মনে পড়ে গেল বাউল সৈয়দ আব্দুল লতিফের লিখা //দম গেলে আর দিন পাবে না, মুর্শিদের কথা শোন// এবং গিয়াস উদ্দিন আহমেদের //মরিলে কান্দিস না আমার দায়// গানের কথা গুলো।
কথা গুলো এ কারণে বললাম কারণ ছবিটির অন্তঃসারের সাথে নিজের অনেক মিল খুঁজে পাই। নিদ্রাহীন একা পূর্ণিমার রাতে চুপচাপ শুয়ে প্রায়শ’ই ভাবি আমি মারা গেছি। সাদা কাপড় জড়িয়ে আমার সুদীর্ঘ লম্বা দেহকে শুইয়ে রাখা আছে ঘরের কোণায়। আবছা অন্ধকারে বসে আছেন প্রিয়জনরা। কেউ কাঁদছে, কেউ বা সমাহিত পরিকল্পনায় মহা ব্যস্ত। কেউবা বাসার চিলেকোঠায় দাঁড়িয়ে নীলাভ বিষাদ নিয়ে আমাকে নিয়ে করছে স্মৃতিচারণ। কেউ করছে মহা আফসোস আবার কেউ অভিমান ভরা বুক নিয়ে দিচ্ছে হাজারো বকা।
// মরিলে কান্দিস না আমার দায়
রে যাদু ধন মরিলে কান্দিস না আমার দায়
মরিলে কান্দিস না আমার দায়।
সুরা ইয়াসীন পাঠ করিও বসিয়া কাছায়
যাইবার কালে বাঁচি যেন শয়তানের ধোঁকায়
রে যাদু ধন মরিলে কান্দিস না আমার দায়।
বুক বান্ধিয়া কাছে বইসা গোছল করাইবা
কান্দনের বদলে মুখে কলমা পড়িবা
রে যাদু ধন মরিলে কান্দিস না আমার দায়।
কাফন পিন্দাইয়া আতর গোলাপ দিয়া গায়
তেলাওয়াতের ধ্বনি যেন ঘরে শোনা যায়
রে যাদু ধন মরিলে কান্দিস না আমার দায়।
কাফন পড়িয়া যদি কান্দো আমার দায়
মসজিদে বসিয়া কাইন্দো আল্লা’রই দরগায়
রে যাদু ধন মরিলে কান্দিস না আমার দায়। //
গানটি আমার খুব প্রিয়। শুধু আমার নয় অসংখ্য তরুণ-তরুণী, বৃদ্ধ, যুবা, সাহিত্যিক, কলামিস্ট, গল্পকার ঔপন্যাসিকের গানটি খুব প্রিয়। নন্দিত সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তার ‘চলে যায় বসন্তের দিন’ বইটির উৎসর্গ পত্রে লিখেছিলেন- ”আমার একটি খুব প্রিয় গান আছে, গিয়াসউদ্দিন সাহেবের লেখা মরণ সঙ্গী – মরিলে কান্দিস না আমার দায়।”
মরিলে কান্দিস না আমার গানটি আমরা অনেকেই অনেকবার শুনেছি। কিন্তু অনেকেই জানি না গানটির গীতিকার গিয়াস উদ্দিন আহমদ সম্পর্কে। ফকির লালন সাঁই, রবি ঠাকুর বা অন্যান্য বাউল কবিদের মত তার বিশাল জনগোষ্ঠীর উত্তরসূরি নেই বলে হয়ত এখনো পর্দার অন্তরালে পড়ে আছেন এই গিয়াস উদ্দিন নামক এই সৃষ্টিশীল গীত-কবি।
গিয়াস উদ্দিন আহমদ। জন্ম ১৪ আগস্ট ১৯৩৫ সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার শিবনগরে। বাবা ফতেহ উল্লাহ এবং মাতা আমুরতা বিবি। তার সবগুলো গানই ধারণ করে সিলেট অঞ্চলের গানের বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে। তার গান বহন করে চলেছে তার অঞ্চল আর পূর্বসূরিদের যোগ্য উত্তরাধিকার। তিনি লিখেছেন মুর্শিদি, মারফতি, সরি, মর্সিয়া, কীর্তন, বিয়ের গান, মজুফি গান (পীর আউলিয়া কেন্দ্রিক গান)। অবশ্যই তার সবগুলো গানই লোকগান ঘরানার। সব লোকগানের মতোই তার গানগুলোর মধ্যেও রয়েছে সহজ বাক্য বিন্যাস আর সাম্প্রতিকতার ছোঁয়া। প্রত্যেক অঞ্চলেই নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি আবহমান কাল ধরেই স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। সিলেট অঞ্চলে ঠিক তেমন’ই। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, সিলেট অঞ্চলের গানগুলোতে কাজ করে পাঁচটি প্রভাব। শ্রী চৈতন্যের সন্ন্যাসী, শাহজালালের মারফতি সুফি, মাজারকেন্দ্রিক মজুফি মতবাদ, পাহাড়ের অন্তর্মুখিতা এবং হাওরের আর্দ্রতা। এই অঞ্চলে কখনো কীর্তনি ঢংয়ে মারফতি গান কিংবা কখনো মারফতি ঢংয়ে কীর্তন গাওয়া হয়। বিষণ্ণতা এবং নিঃসঙ্গতা সিলেট অঞ্চলের গানের এক প্রধান বৈশিষ্ট্য। হযরত শাহজালালের সন্ন্যাসবাদী সুফি ধারা এবং শ্রী চৈতন্যের সন্ন্যাসের প্রভাবই এর কারণ।
গীতিকার গিয়াস উদ্দিন আহমেদের উস্তাদ ছিলেন আছদ উল্লাহ। হাজার খানিকের উপরে গান রচনা করেছেন তিনি। তার প্রকাশিত চারটি গানের বইয়ের মধ্যে মরিলে কান্দিস না আমার দায়’ ১৯৯৬ সালে এবং ‘শেষ বিয়ার সানাই’-২০০৫ সালে প্রকাশিত হয়। তাছাড়া ‘ভোটের বয়ান এবং ইত্যাদি’ ও ‘কর্ণে শুনাইও বন্ধুর নাম’ নামক তার দুটি গ্রন্থ রয়েছে। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে গীতিকার হিসেবে বেতারে স্বীকৃতি পাওয়া এই গীতিকার বাংলাদেশ টেলিভিশনের “ক” শ্রেণীর গীতিকার ছিলেন।
সাম্প্রতিক সময়ের লোক গিয়াস উদ্দিন আহমদ সংগঠক পর্যায়ের ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি ছাতক প্রেস ক্লাবের সভাপতি এবং ছাতক খেলাঘর নামক ধূমপান বিরোধী সংগঠনের সংগঠক ছিলেন। মরিলে কান্দিস না আমার দায় এবং, ‘সিলেট প্রথম আজান ধ্বনি বাবায় দিয়াছে’ তার উল্লেখ যোগ্য দুটি গান। ২০০১ সালে মহাকবি সৈয়দ সুলতান সাহিত্য ও গবেষণা পরিষদ তাকে ‘মরমি সাহিত্য পুরস্কার’, ১৯৮৯ সালে প্রবাসী বাংলাদেশী সম্মাননা, শাপলা শিল্পীগোষ্ঠী সম্মাননা এবং সর্বশেষ ২০০৫ সালে নীলম সংগীতালয় সম্মাননা পুরস্কারে ভূষিত হোন।
১৬ এপ্রিল ২০০৫ সালে সবাইকে না কাঁদার অছিয়ত করে নিজে চলে যান না ফেরার দেশে। ছাতকের শিবনগর জামে মসজিদ সংলগ্ন পারিবারিক গোরস্থান তাকে চিরনিদ্রায় সমাহিত করা হয়।
পরিশেষে বলছি,আমরা সবাই গান শুনি। বর্তমানে বিলাস বহুল বাদ্য যন্ত্র ব্যবহার এবং কিছু প্রদর্শনবাদী শিল্পীদের কারণে হারাচ্ছে সঙ্গীতের মূল সুর, বিকৃত হচ্ছে গানের কথা, এমনকি গানে মজে থাকা গীতিকারের আত্মকথা। কবিতার পাঠকরা যেমন একজন কবিকে, কবির ভাবকে টিকিয়ে রাখতে পারেন ঠিক তেমনি গানের শ্রোতা, শিল্পীরা বাঁচিয়ে রাখতে পারেন একজন সঙ্গীত স্রষ্টার আত্মকথাকে, ভাব ধারাকে। গান শ্রবণের পাশাপাশি গানের সুরকার, গীতিকার, গানটি সৃষ্টির ইতিহাস অবশ্যই আমাদের জানা উচিৎ।
ছবিঃ গীতিকার গিয়াস উদ্দিন আহমদ

এমন কিছু গান আছে যেগুলো চুপচাপ নিদ্রাহীন একা রাতে নিজেকে নতুন করে গড়তে শিখায়- ভেঙ্গে দেয়, আবার নিজেকে নিজের মত করে গড়তে শিখায়। ছোট্ট একটি ঘটনা বলা যায়, গত কয়েকদিন আগে বিশ্ব বন্ধু দিবসে তরুণ চিত্রশিল্পী আব্দুল বাতিন ভাইয়ের স্কুল অফ লিবারেট আর্ট’এ গিয়েছিলাম আড্ডা দিতে। সেখান থেকে হুটহাট প্লানে চলে গেলাম উনার বাসায়। কবি স্বজল ছত্রী, বাতিন ভাই এবং আমি আড্ডা মারলাম লম্বা সময়। ক্লান্ততা রোধে রাত আনুমানিক তিনটার দিকে যখন উনার বিছানায় বিশ্রাম নিচ্ছি তখন হঠাৎ উনার বেডের ডান পাশের দেয়ালে চোখ পড়তেই থমকে গেলাম। কফিনে শুয়ে থাকা এক মরদেহের ছবি। চারপাশে অন্ধকারে ঘিরে থাকা সামান্য কিছু আলো পড়েছে মৃতদেহের মুখের উপর। ছবিটি অদ্ভুত সুন্দর এবং ভয়ানক। চুপচাপ ছবিটির দিকে চেয়ে থাকলাম অনেকক্ষণ।
উঠে এসে নিকোটিন গিলতে গিলতে বাতিন ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম ছবিটি সম্পর্কে। ছবিটি সম্পর্কে শুধু এটুকুই বললেন এটা তিনি নিজে এবং এটাই তার শেষ পরিণতি। সাথে সাথেই মনে পড়ে গেল বাউল সৈয়দ আব্দুল লতিফের লিখা //দম গেলে আর দিন পাবে না, মুর্শিদের কথা শোন// এবং গিয়াস উদ্দিন আহমেদের //মরিলে কান্দিস না আমার দায়// গানের কথা গুলো।
কথা গুলো এ কারণে বললাম কারণ ছবিটির অন্তঃসারের সাথে নিজের অনেক মিল খুঁজে পাই। নিদ্রাহীন একা পূর্ণিমার রাতে চুপচাপ শুয়ে প্রায়শ’ই ভাবি আমি মারা গেছি। সাদা কাপড় জড়িয়ে আমার সুদীর্ঘ লম্বা দেহকে শুইয়ে রাখা আছে ঘরের কোণায়। আবছা অন্ধকারে বসে আছেন প্রিয়জনরা। কেউ কাঁদছে, কেউ বা সমাহিত পরিকল্পনায় মহা ব্যস্ত। কেউবা বাসার চিলেকোঠায় দাঁড়িয়ে নীলাভ বিষাদ নিয়ে আমাকে নিয়ে করছে স্মৃতিচারণ। কেউ করছে মহা আফসোস আবার কেউ অভিমান ভরা বুক নিয়ে দিচ্ছে হাজারো বকা।
// মরিলে কান্দিস না আমার দায়
রে যাদু ধন মরিলে কান্দিস না আমার দায়
মরিলে কান্দিস না আমার দায়।
সুরা ইয়াসীন পাঠ করিও বসিয়া কাছায়
যাইবার কালে বাঁচি যেন শয়তানের ধোঁকায়
রে যাদু ধন মরিলে কান্দিস না আমার দায়।
বুক বান্ধিয়া কাছে বইসা গোছল করাইবা
কান্দনের বদলে মুখে কলমা পড়িবা
রে যাদু ধন মরিলে কান্দিস না আমার দায়।
কাফন পিন্দাইয়া আতর গোলাপ দিয়া গায়
তেলাওয়াতের ধ্বনি যেন ঘরে শোনা যায়
রে যাদু ধন মরিলে কান্দিস না আমার দায়।
কাফন পড়িয়া যদি কান্দো আমার দায়
মসজিদে বসিয়া কাইন্দো আল্লা’রই দরগায়
রে যাদু ধন মরিলে কান্দিস না আমার দায়। //
গানটি আমার খুব প্রিয়। শুধু আমার নয় অসংখ্য তরুণ-তরুণী, বৃদ্ধ, যুবা, সাহিত্যিক, কলামিস্ট, গল্পকার ঔপন্যাসিকের গানটি খুব প্রিয়। নন্দিত সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তার ‘চলে যায় বসন্তের দিন’ বইটির উৎসর্গ পত্রে লিখেছিলেন- ”আমার একটি খুব প্রিয় গান আছে, গিয়াসউদ্দিন সাহেবের লেখা মরণ সঙ্গী – মরিলে কান্দিস না আমার দায়।”
মরিলে কান্দিস না আমার গানটি আমরা অনেকেই অনেকবার শুনেছি। কিন্তু অনেকেই জানি না গানটির গীতিকার গিয়াস উদ্দিন আহমদ সম্পর্কে। ফকির লালন সাঁই, রবি ঠাকুর বা অন্যান্য বাউল কবিদের মত তার বিশাল জনগোষ্ঠীর উত্তরসূরি নেই বলে হয়ত এখনো পর্দার অন্তরালে পড়ে আছেন এই গিয়াস উদ্দিন নামক এই সৃষ্টিশীল গীত-কবি।
গিয়াস উদ্দিন আহমদ। জন্ম ১৪ আগস্ট ১৯৩৫ সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার শিবনগরে। বাবা ফতেহ উল্লাহ এবং মাতা আমুরতা বিবি। তার সবগুলো গানই ধারণ করে সিলেট অঞ্চলের গানের বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে। তার গান বহন করে চলেছে তার অঞ্চল আর পূর্বসূরিদের যোগ্য উত্তরাধিকার। তিনি লিখেছেন মুর্শিদি, মারফতি, সরি, মর্সিয়া, কীর্তন, বিয়ের গান, মজুফি গান (পীর আউলিয়া কেন্দ্রিক গান)। অবশ্যই তার সবগুলো গানই লোকগান ঘরানার। সব লোকগানের মতোই তার গানগুলোর মধ্যেও রয়েছে সহজ বাক্য বিন্যাস আর সাম্প্রতিকতার ছোঁয়া। প্রত্যেক অঞ্চলেই নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি আবহমান কাল ধরেই স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। সিলেট অঞ্চলে ঠিক তেমন’ই। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, সিলেট অঞ্চলের গানগুলোতে কাজ করে পাঁচটি প্রভাব। শ্রী চৈতন্যের সন্ন্যাসী, শাহজালালের মারফতি সুফি, মাজারকেন্দ্রিক মজুফি মতবাদ, পাহাড়ের অন্তর্মুখিতা এবং হাওরের আর্দ্রতা। এই অঞ্চলে কখনো কীর্তনি ঢংয়ে মারফতি গান কিংবা কখনো মারফতি ঢংয়ে কীর্তন গাওয়া হয়। বিষণ্ণতা এবং নিঃসঙ্গতা সিলেট অঞ্চলের গানের এক প্রধান বৈশিষ্ট্য। হযরত শাহজালালের সন্ন্যাসবাদী সুফি ধারা এবং শ্রী চৈতন্যের সন্ন্যাসের প্রভাবই এর কারণ।
গীতিকার গিয়াস উদ্দিন আহমেদের উস্তাদ ছিলেন আছদ উল্লাহ। হাজার খানিকের উপরে গান রচনা করেছেন তিনি। তার প্রকাশিত চারটি গানের বইয়ের মধ্যে মরিলে কান্দিস না আমার দায়’ ১৯৯৬ সালে এবং ‘শেষ বিয়ার সানাই’-২০০৫ সালে প্রকাশিত হয়। তাছাড়া ‘ভোটের বয়ান এবং ইত্যাদি’ ও ‘কর্ণে শুনাইও বন্ধুর নাম’ নামক তার দুটি গ্রন্থ রয়েছে। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে গীতিকার হিসেবে বেতারে স্বীকৃতি পাওয়া এই গীতিকার বাংলাদেশ টেলিভিশনের “ক” শ্রেণীর গীতিকার ছিলেন।
সাম্প্রতিক সময়ের লোক গিয়াস উদ্দিন আহমদ সংগঠক পর্যায়ের ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি ছাতক প্রেস ক্লাবের সভাপতি এবং ছাতক খেলাঘর নামক ধূমপান বিরোধী সংগঠনের সংগঠক ছিলেন। মরিলে কান্দিস না আমার দায় এবং, ‘সিলেট প্রথম আজান ধ্বনি বাবায় দিয়াছে’ তার উল্লেখ যোগ্য দুটি গান। ২০০১ সালে মহাকবি সৈয়দ সুলতান সাহিত্য ও গবেষণা পরিষদ তাকে ‘মরমি সাহিত্য পুরস্কার’, ১৯৮৯ সালে প্রবাসী বাংলাদেশী সম্মাননা, শাপলা শিল্পীগোষ্ঠী সম্মাননা এবং সর্বশেষ ২০০৫ সালে নীলম সংগীতালয় সম্মাননা পুরস্কারে ভূষিত হোন।
১৬ এপ্রিল ২০০৫ সালে সবাইকে না কাঁদার অছিয়ত করে নিজে চলে যান না ফেরার দেশে। ছাতকের শিবনগর জামে মসজিদ সংলগ্ন পারিবারিক গোরস্থান তাকে চিরনিদ্রায় সমাহিত করা হয়।
পরিশেষে বলছি,আমরা সবাই গান শুনি। বর্তমানে বিলাস বহুল বাদ্য যন্ত্র ব্যবহার এবং কিছু প্রদর্শনবাদী শিল্পীদের কারণে হারাচ্ছে সঙ্গীতের মূল সুর, বিকৃত হচ্ছে গানের কথা, এমনকি গানে মজে থাকা গীতিকারের আত্মকথা। কবিতার পাঠকরা যেমন একজন কবিকে, কবির ভাবকে টিকিয়ে রাখতে পারেন ঠিক তেমনি গানের শ্রোতা, শিল্পীরা বাঁচিয়ে রাখতে পারেন একজন সঙ্গীত স্রষ্টার আত্মকথাকে, ভাব ধারাকে। গান শ্রবণের পাশাপাশি গানের সুরকার, গীতিকার, গানটি সৃষ্টির ইতিহাস অবশ্যই আমাদের জানা উচিৎ।
ছবিঃ গীতিকার গিয়াস উদ্দিন আহমদ

মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন