একটু পরেই শুরু হবে বাসর। দু'জনের ভেতরে অনেক উত্তেজনা। গোলাপ, গাঁদা জড়ানো পুষ্প ভরা লাল বেনারসী পরে বসে আছেন নববধূ। কখন আসবে সে, ঘোমটার নিচের দৃষ্টি পলক দরজার কিনারায়। সুগন্ধি মাখা, বেশ প্রফুল্ল মনে পাঞ্জাবি পাজামা পরা বর এলেন ঘরে। গুটিসুটি করে লাগিয়ে দিলেন দরজা, হেঁটে হেঁটে চলছেন নতুন প্রেয়সীর কিনারায়। বেকগ্রাউন্ডে বেজে চলছে মধুর সুর।
এমন দৃশ্য আমরা মুভি সিনেমা, টেলিফিল্ম, নাটকে প্রায়ই দেখি। একটি মধুর রোমান্টিক সুর বেজে চলছে। এগুলো হচ্ছে প্রখ্যাত সানাই বাদক ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খানের বাজানো সানাই এর বিভিন্ন রাগ। সিনেমা টেলিফিল্ম নাটক ইত্যাদি বিয়ের শুটে, কনের বিদায়ের শুটে বা বাসর ঘরে শুট নেবার পর ব্যাকগ্রাউন্ডে ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খানের সানাই এর রাগ ব্যবহার করা হয়।
মূলত বিয়ে বাসর নিয়ে কথা বলছি না। বলছি ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খানকে নিয়ে। উস্তাদ বিসমিল্লাহ খানের একটি কথা আমার খুব পছন্দ-- যে সঙ্গীত শোনার বিষয়, দেখার বা দেখাবার নয়। আসলে সঙ্গীত সুর এমন এক জিনিস যে উপলব্ধি করতে হয়,
সেটাতেই ভেতরে দাগ কাটে।
হ্যাঁ ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খানের কথা বলছি। অনেকেই আমরা যার সানাই এর রাগ শুনে হারিয়ে যাই নিজের বাসরে, বাসর স্মৃতিতে। সেই মধুরাতএর কথা মনে হলে যে সুর কানে ভাসে সেটা ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খানের সানাই এর রাগ। ভারত তথা উপমহাদেশের উচ্চাঙ্গ শাস্ত্রীয় সঙ্গীত জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান। সানাইকে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বাদনের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে ওস্তাদ উপাধিতে ভূষিত হন এই অমর শিল্পী। আট দশকের বেশি সময় ধরে অনবদ্য সানাই বাদনে তিনি মুগ্ধ করেছেন ভারতবর্ষসহ বিশ্বের কোটি দর্শকের হৃদয়।
ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান ও সানাই। এ দুটো নাম যেন একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। ডাক নাম কামরুদ্দিন হলেও জন্মের পর তার দাদা তাকে দেখে বিসমিল্লাহ বলার পর থেকে সেটাই তার মূল নামের অংশ হয়ে যায়। ১৯১৬ সালের ২১ মার্চ সঙ্গীতজ্ঞ পরিবারে তার জন্ম হওয়ায় সুর মিশেছিলো তার রক্তে রন্ধ্রে। ৬ বছর বয়স থেকেই বারাণসির বিশ্বনাথ মন্দিরের সানাই বাদক ওস্তাদ বিলায়াতুর কাছ থেকে তালিম নেয়া শুরু করেন তিনি। ১৯৩৭ সালে কলকাতার সর্বভারতীয় সুর সম্মেলনে সানাই বাজিয়ে উঠে আসেন আলোচনায়।
১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতের লাল কেল্লায় অনুষ্ঠিত প্রথম প্রজাতন্ত্র দিবসে অনবদ্য কাফি রাগের মূর্ছনায় বিসমিল্লাহ খান মোহিত করেন ভারতবর্ষকে। তার সানাই ছাড়া ভারতের স্বাধীনতা দিবসে দূরদর্শনের অনুষ্ঠান যেন কল্পনাই করা যায় না।চলচ্চিত্রে সানাই বাজানোর পাশাপাশি বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের জলসাঘরেও অভিনয় করেছেন তিনি। পরবর্তীতে গৌতম ঘোষ তার জীবন ও কর্ম নিয়ে নির্মাণ করেন প্রামাণ্যচিত্র মিটিং অ্য মাইলস্টোন।
ইউরোপ, আফ্রিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশের রাজধানী শহরে অসামান্য সঙ্গীত প্রতিভায় কোটি দর্শকের হৃদয় জয় করেছেন এই শিল্পী। সঙ্গীত ভুবনে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ভারতরত্ন, পদ্মভূষণ, পদ্মশ্রীসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হন। এছাড়া বারানসি হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ও শান্তি নিকেতন তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রী প্রদান করে।
এতো সুনাম ও অর্জন সত্ত্বেও খুবই সাধারণ জীবন যাপন করতেন বিসমিল্লাহ খান। হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতির এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। বারাণসির ছোট এক বাসায় কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনের প্রায় পুরো সময়। ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার দূরে থাক, তিনি চড়তেন রিকসায়। ২০০৬ সালের ২১ আগস্ট ৯০ বছর বয়সে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান এই কিংবদন্তি। তাঁর মৃত্যুতে একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালন করে ভারত।
ভারতের একজন অসাম্প্রদায়িক নাম ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান। ভারতবাসীর মুখ থেকেই শোনা, ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান একজন শিয়া মুসলমান হয়ে সনাতন ধর্মের বিদ্যার দেবী স্বরস্বতী দেবীর পূজা করতেন। অনেক ভারতীয় তাকে ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এপিজে আবুল কালামের মত বিশ্বাসের সাথে মিলান। সংগীতজ্ঞের মতে, বিশ্বাস নয়, মূলত একজন সাম্প্রদায়িক বিষ ফোঁড়ারকে মুছে দিতে জ্ঞান অন্বেষণে মানুষকে জাগ্রত করতে এটি একটি অভিনব পথা ছিল উনার।
সবকিছু যে সুখের তা নয় এর মাঝে কিছু হতাশার ব্যাপারো আছে। ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর। ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খানের পুত্র কাজিম হুসেনের বাড়ি থেকে চুরি হয়ে গিয়েছিলো পাঁচটি সানাই। এগুলোর হদিস আজও মেলেনি। এই সানাইগুলির মধ্যে চারটি রূপোর এবং একটি কাঠের সানাই। যে সানাই গুলো চুরি হয়ে গিয়েছিলো সেগুলোর মধ্যে ঠের সানাইটি দিয়েই মহরমের ৫ম ও ৭ম দিবসে উস্তাদ বিসমিল্লাহ খান সুরের মুর্চ্ছনা সৃষ্টি করতেন।
আসলে চোর কি আর জানত কি চুরি করলো। চোর কি আর ধর্মের কাহিনী মানে? আর ধর্মের কাহিনীতে চোরের কি আছে সবই ভাবার বিষয়। কষ্টদায়ক ব্যাপার এটাই রবি ঠাকুরের নোবেল, বিসমিল্লাহ'র সানাই হয়ত বোঝিনা আমরা। বোঝলে কি আর চোরের ঝুলির বোঝা হত এসব!
যাই হোক যা বলছিলাম, ২১ মার্চ ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খানের ১০২ তম জন্মদিন। ২১ সে আসলেন সেই ২১ এই চলে গিয়েছিলেন তিনি। ২১ মার্চ ১৯১৬ - ২১ আগস্ট ২০০৬। সানাই চুরি হলেও মন থেকে চুরি হোননি বিসমিল্লাহ। সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ডে সানাই এর মধুর সুরের মত মনের গ্রাউন্ডেও আছেন, থাকবেন ওস্তাদ বিসমিল্লাহ।
লিখেছেন: মারূফ অমিত, অনলাইন এক্টিভিস্ট
এমন দৃশ্য আমরা মুভি সিনেমা, টেলিফিল্ম, নাটকে প্রায়ই দেখি। একটি মধুর রোমান্টিক সুর বেজে চলছে। এগুলো হচ্ছে প্রখ্যাত সানাই বাদক ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খানের বাজানো সানাই এর বিভিন্ন রাগ। সিনেমা টেলিফিল্ম নাটক ইত্যাদি বিয়ের শুটে, কনের বিদায়ের শুটে বা বাসর ঘরে শুট নেবার পর ব্যাকগ্রাউন্ডে ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খানের সানাই এর রাগ ব্যবহার করা হয়।
মূলত বিয়ে বাসর নিয়ে কথা বলছি না। বলছি ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খানকে নিয়ে। উস্তাদ বিসমিল্লাহ খানের একটি কথা আমার খুব পছন্দ-- যে সঙ্গীত শোনার বিষয়, দেখার বা দেখাবার নয়। আসলে সঙ্গীত সুর এমন এক জিনিস যে উপলব্ধি করতে হয়,
সেটাতেই ভেতরে দাগ কাটে।
হ্যাঁ ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খানের কথা বলছি। অনেকেই আমরা যার সানাই এর রাগ শুনে হারিয়ে যাই নিজের বাসরে, বাসর স্মৃতিতে। সেই মধুরাতএর কথা মনে হলে যে সুর কানে ভাসে সেটা ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খানের সানাই এর রাগ। ভারত তথা উপমহাদেশের উচ্চাঙ্গ শাস্ত্রীয় সঙ্গীত জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান। সানাইকে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বাদনের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে ওস্তাদ উপাধিতে ভূষিত হন এই অমর শিল্পী। আট দশকের বেশি সময় ধরে অনবদ্য সানাই বাদনে তিনি মুগ্ধ করেছেন ভারতবর্ষসহ বিশ্বের কোটি দর্শকের হৃদয়।
ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান ও সানাই। এ দুটো নাম যেন একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। ডাক নাম কামরুদ্দিন হলেও জন্মের পর তার দাদা তাকে দেখে বিসমিল্লাহ বলার পর থেকে সেটাই তার মূল নামের অংশ হয়ে যায়। ১৯১৬ সালের ২১ মার্চ সঙ্গীতজ্ঞ পরিবারে তার জন্ম হওয়ায় সুর মিশেছিলো তার রক্তে রন্ধ্রে। ৬ বছর বয়স থেকেই বারাণসির বিশ্বনাথ মন্দিরের সানাই বাদক ওস্তাদ বিলায়াতুর কাছ থেকে তালিম নেয়া শুরু করেন তিনি। ১৯৩৭ সালে কলকাতার সর্বভারতীয় সুর সম্মেলনে সানাই বাজিয়ে উঠে আসেন আলোচনায়।
১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতের লাল কেল্লায় অনুষ্ঠিত প্রথম প্রজাতন্ত্র দিবসে অনবদ্য কাফি রাগের মূর্ছনায় বিসমিল্লাহ খান মোহিত করেন ভারতবর্ষকে। তার সানাই ছাড়া ভারতের স্বাধীনতা দিবসে দূরদর্শনের অনুষ্ঠান যেন কল্পনাই করা যায় না।চলচ্চিত্রে সানাই বাজানোর পাশাপাশি বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের জলসাঘরেও অভিনয় করেছেন তিনি। পরবর্তীতে গৌতম ঘোষ তার জীবন ও কর্ম নিয়ে নির্মাণ করেন প্রামাণ্যচিত্র মিটিং অ্য মাইলস্টোন।
ইউরোপ, আফ্রিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশের রাজধানী শহরে অসামান্য সঙ্গীত প্রতিভায় কোটি দর্শকের হৃদয় জয় করেছেন এই শিল্পী। সঙ্গীত ভুবনে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ভারতরত্ন, পদ্মভূষণ, পদ্মশ্রীসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হন। এছাড়া বারানসি হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ও শান্তি নিকেতন তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রী প্রদান করে।
এতো সুনাম ও অর্জন সত্ত্বেও খুবই সাধারণ জীবন যাপন করতেন বিসমিল্লাহ খান। হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতির এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। বারাণসির ছোট এক বাসায় কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনের প্রায় পুরো সময়। ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার দূরে থাক, তিনি চড়তেন রিকসায়। ২০০৬ সালের ২১ আগস্ট ৯০ বছর বয়সে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান এই কিংবদন্তি। তাঁর মৃত্যুতে একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালন করে ভারত।
ভারতের একজন অসাম্প্রদায়িক নাম ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান। ভারতবাসীর মুখ থেকেই শোনা, ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান একজন শিয়া মুসলমান হয়ে সনাতন ধর্মের বিদ্যার দেবী স্বরস্বতী দেবীর পূজা করতেন। অনেক ভারতীয় তাকে ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এপিজে আবুল কালামের মত বিশ্বাসের সাথে মিলান। সংগীতজ্ঞের মতে, বিশ্বাস নয়, মূলত একজন সাম্প্রদায়িক বিষ ফোঁড়ারকে মুছে দিতে জ্ঞান অন্বেষণে মানুষকে জাগ্রত করতে এটি একটি অভিনব পথা ছিল উনার।
সবকিছু যে সুখের তা নয় এর মাঝে কিছু হতাশার ব্যাপারো আছে। ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর। ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খানের পুত্র কাজিম হুসেনের বাড়ি থেকে চুরি হয়ে গিয়েছিলো পাঁচটি সানাই। এগুলোর হদিস আজও মেলেনি। এই সানাইগুলির মধ্যে চারটি রূপোর এবং একটি কাঠের সানাই। যে সানাই গুলো চুরি হয়ে গিয়েছিলো সেগুলোর মধ্যে ঠের সানাইটি দিয়েই মহরমের ৫ম ও ৭ম দিবসে উস্তাদ বিসমিল্লাহ খান সুরের মুর্চ্ছনা সৃষ্টি করতেন।
আসলে চোর কি আর জানত কি চুরি করলো। চোর কি আর ধর্মের কাহিনী মানে? আর ধর্মের কাহিনীতে চোরের কি আছে সবই ভাবার বিষয়। কষ্টদায়ক ব্যাপার এটাই রবি ঠাকুরের নোবেল, বিসমিল্লাহ'র সানাই হয়ত বোঝিনা আমরা। বোঝলে কি আর চোরের ঝুলির বোঝা হত এসব!
যাই হোক যা বলছিলাম, ২১ মার্চ ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খানের ১০২ তম জন্মদিন। ২১ সে আসলেন সেই ২১ এই চলে গিয়েছিলেন তিনি। ২১ মার্চ ১৯১৬ - ২১ আগস্ট ২০০৬। সানাই চুরি হলেও মন থেকে চুরি হোননি বিসমিল্লাহ। সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ডে সানাই এর মধুর সুরের মত মনের গ্রাউন্ডেও আছেন, থাকবেন ওস্তাদ বিসমিল্লাহ।
লিখেছেন: মারূফ অমিত, অনলাইন এক্টিভিস্ট
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন