সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

শহীদ মিনারের বিচিত্রিতা

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন চোখ খুলে দিয়েছিলো বাঙালি জাতির। সেই ফুটে ওঠা চোখে পরবর্তীতে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে বাঙালি।সিলেট মদনমোহন কলেজে শহীদ মিনারের নির্মাণশৈলীতে তাই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বাঙালির চোখ খুলে দেওয়ার বিষয়টি। এই শহীদ মিনারের নাম- ‘দৃষ্টিপাত’। ছোট বড় ১২টি জানালা দিয়ে তৈরি এই শহীদ মিনারের স্থাপত্যশৈলী বেশ আগেই নজর কাঁড়ে সিলেটবাসীর।

১৯৬৭ সালে মদনমোহন কলেজে সিলেট জেলার প্রথম শহীদ মিনার স্থাপিত হয়। সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার তৈরি করার আগে এই শহীদ মিনারে সবাই শ্রদ্ধা জানাতেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতাবিরোধীরা শহীদ মিনারটি ভেঙে ফেলে। ১৯৭২ সালে কলেজ ছাত্র সংসদ ভাঙা শহীদ মিনারটি পুনর্নির্মাণ করে। ২০১২ সালে স্থপতি রাজন দাশের নকশায় সিলেট সিটি করপোরেশনের অর্থায়নে প্রায় ১৯ লাখ টাকা ব্যয়ে নতুন স্থাপত্যশৈলীতে এই শহীদ মিনারকে আরও নান্দনিক করা হয়।
মদনমোহন কলেজের শহীদ মিনার ‘দৃষ্টিপাত’ নিয়ে স্থপতি রাজন দাশ বলেন, বিজ্ঞজনরা বলেন বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে বাঙালি জাতির চোখ ফুটেছিল। এই আন্দোলনের কারণে পরবর্তীতে দেশ স্বাধীনের আন্দোলনে সফল হয়েছিল বাঙালি জাতি। তাই এই শহীদ মিনারের নকশা করার সময় আমাদের কনসেপ্ট ছিল ভাষার সাথে চোখের উপমা প্রকাশ করা। আর জানালাকে আমরা দেয়ালের চোখ বলি। তাই জানালা দিয়ে বাঙালি জাতির প্রথম চোখ ফোটানো দৃশ্যমান করা হয় শহীদ মিনারের স্থাপত্যশৈলীতে। এই জন্যই এই শহীদ মিনারের নাম দেওয়া হয় ‘দৃষ্টিপাত’।

কেবল এই একটি নয়, সিলেটে শহীদ মিনারগুলোর নির্মাণে দেখা গেছে বিষয় ও ভাবনার বৈচিত্র এবং অপরূপ নির্মাণশেলী। ভাবনার ঐই ভিন্নতা অনন্যরূপ দিয়েছে স্মৃতির মিনারগুলোকে।

সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার
১৯৮৯ সালের ৩ ডিসেম্বর প্রবীণ নাট্য ব্যক্তিত্ব হেমচন্দ্র ভট্টাচার্যের সভাপতিত্বে প্রান্তিক মিলনায়তনে রাজনীতিবিদ, ছাত্র, যুব ও শ্রমিক নেতা, সাংবাদিক, আইনজীবী, সংস্কৃতি ও নাট্যকর্মীসহ সকল স্তরের মানুষের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সিলেট শহরের চৌহাট্টাস্থ শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের পাশে সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওই সালের ৫ ডিসেম্বর থেকে শিল্পী শামসুল ইসলামের নকশা অনুসারে সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়।

পরবর্তীতে ২০১৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তৌহিদি জনতার মিছিল থেকে সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে হামলা চালায় জামায়াত-শিবির। তাদের তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শহীদ মিনার।এরপর সিলেটের সংস্কৃতি কর্মীদের শহীদ মিনার নতুন করে নির্মাণের দাবির প্রেক্ষিতে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের নির্দেশে, শহীদ মিনার পুনর্নির্মাণের কাজ শুরু করে সিলেট সিটি করপোরেশন।
২০১৪ সালে ১০ ডিসেম্বর প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয়ে পুনর্নির্মিত এই শহীদ মিনারের নান্দনিক রূপ দেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষক শুভজিৎ চৌধুরী। জাতীয় শহীদ মিনারের আদলে তৈরি করা এই শহীদ মিনার এখন সিলেটের সকল আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। সেই থেকেই দূরদূরান্ত থেকে মানুষজন আসেন দৃষ্টিনন্দন এই শহীদ মিনার দেখার জন্য।  

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শহীদ মিনার
বর্ণমালার বন্ধনায় সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি অনুষদের মধ্যখানের টিলার ওপর নির্মিত হয়েছে শহীদ মিনার। সূর্য উঠা থেকে অস্ত যাওয়া এর মধ্যেই হয় সূর্যের আলোর সাথে বর্ণমালার লুকোচুরি খেলা। সিকৃবির এই শহীদ মিনারে নাম ‘সূর্যালোকে বর্ণমালা’। এর নকশা করেছেন স্থপতি রাজন দাশ। জ্বলে ওঠা সূর্যের কিরণে ছোট, বড় বর্ণমালা উপভোগ করেন সিকৃবির শিক্ষার্থী শিক্ষকসহ সর্বস্তরের মানুষজন। শুধু ২১শে ফেব্রুয়ারিতে নয়, সারা বছরই সিলেটের  মানুষজন ‘সূর্যালোকে বর্ণমালা’ দেখতে সিকৃবি ক্যাম্পাসে যান।
‘সূর্যালোকে বর্ণমালা’ নিয়ে স্থপতি রাজন দাশ বলেন, বাংলা ভাষার জন্যই ভাষা আন্দোলনের সৃষ্টি। ভাষার সাথে বর্ণমালার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। তাই  সূর্যের আলোর নিচে বর্ণমালার বাগান তৈরি করতে চেয়েছি। সেই জন্যই বাংলা বর্ণমালাকে পুঁজি করে এই শহীদ মিনারের কনসেপ্ট তৈরি করেছি।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শহীদ মিনার
৫৮ ফুট উঁচু টিলায় ৬ হাজার ৮শ’ ৮৬ বর্গফুট জায়গা সারি সারি গাছের মাঝখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার। টিলার উপরে জাতীয় শহীদ মিনারের আদলে করা এই শহীদ মিনারের অন্যতম আকর্ষণ হলো ৯৯টি ধাপের সুদীর্ঘ সিঁড়ি। তবে মনোরম পরিবেশ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মিলে এই শহীদ মিনারকে করেছে আরও আকর্ষণীফেব্রুয়ারি তৎকালীন স্পীকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী এই শহীদ মিনারের ভিত্তি প্রস্থর স্থাপন করেছিলেন। এরপর ওই বছর সেপ্টেম্বর মাসে প্রায় ৩৩ লাখ টাকা ব্যয়ে এই শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়।

লিখেছেনঃ শাকিলা

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাউল সাধক চান মিয়া এবং আমার কিছু উপলব্ধি

"রজনী হইসনা অবসান  আজ নিশিতে আসতে পারেবন্ধু কালাচাঁন।। কত নিশি পোহাইলোমনের আশা মনে রইলো রে কেন বন্ধু আসিলোনা জুড়ায়না পরান। আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন।। বাসর সাজাই আসার আশেআসবে বন্ধু নিশি শেষে দারূন পিরিতের বিষে ধরিল উজান। আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন।। মেঘে ঢাকা আঁধার রাতে কেমনে থাকি একা ঘরে সাধক চাঁনমিয়া কয় কানতে কানতে হইলাম পেরেশান আজ নিশিতে আসতে বন্দু কালাচাঁন।"    গভীর নিশিতে ধ্যান মগ্ন হয়ে কালাচাঁনের অপেক্ষা করছেন সাধক।  সাধক চান মিয়ার শিষ্য বাউল সিরাজউদ্দিনের মতে এটি একটি রাই বিচ্ছেদ। কৃষ্ণের অপেক্ষায় রাধা নিশি বা রাতকে অনুরোধ করছেন 'রাত' যেন না পোহায়  কারণ তার কালা চান যে কোন সময় আসতে পারে। শব্দগুচ্ছ গুলো থেকে সহজেই উপলব্ধি হয় সাধক নিজ দেহকে রাধা আর আত্মাকে কৃষ্ণের সাথে তুলনা করেছেন। দেহ আত্মার মিলন ঘটানোই ছিল সাধকের সাধনা।        বাউল সাধক চান মিয়া উপরোক্ত গানটি রচনা করেছেন। নেত্রকোনা জেলার খাটপুরা গ্রামে ১৩২৫ বঙ্গাব্দে সাধক চান মিয়ার জন্ম। পুরো নাম চান্দেজ্জামান আকন্দ হলেও বা...

বাউল, বাউলতত্ব এবং কিছু কথা

একজন ভদ্র বন্ধু বরের সাথে বাউল সম্প্রদায় নিয়ে বেশ তর্ক হলো রাতে। তর্কের সূত্রপাত ছিল বাউলরা ভাববাদী না বস্তুবাদী। ভাবলাম "বাউলতত্ত্ব"র আলোকে বাউলরা ভাববাদী নাকি বস্তুবাদী তা নিয়ে যৌক্তিক আলোচনা আবশ্যম্ভাবী। কয়েকটি ধারাবাহিক পর্ব লিখে নিজের মনোভাব বোঝানোর চেষ্টা করব।  শুরুতেই শক্তিনাথ ঝাঁ এর বস্তুবাদী বাউল বই থেকে কিছু কথা লিখতে চাই; বাস্তব জগত ও জীবনকে এরা কোন আনুমানিক যুক্তি বা আলৌকিক যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে নারাজ। জৈব রাসায়নিক ব্যাখায় এরা নারীর রজঃ এবং পুরুষের বিজে জীবন ও জগত সৃষ্টিকে ব্যাখা করে এবং চার ভূতকে প্রাকৃতিক সৃষ্টি মনে করে। এভাবে মানুষে, প্রকৃতিতে তৈরি করে প্রাণ, প্রাণী। অনুমান ভিত্তিক স্বর্গ, নরক, পরলোক, পুনর্জন্মাদি প্রত্যক্ষ প্রমাণাভাবে বাউল আগ্রাহ্য করে। মানুষ ব্যাতিরিক্ত ঈশ্বরও এরা মানে না। সৃষ্টির নিয়মকে জেনে যিনি নিজেকে পরিচালনা করতে শিখেছেন- তিনিই সাঁই। সুস্থ নিরোগ দীর্ঘজীবন এবং আনন্দকে অনুভব করার বাউল সাধনা এক আনন্দমার্গ।।  বাউলরা ভাববাদী না বস্তুবাদী এর অনেক সূক্ষ বিশ্লেষণ শক্তিনাথের বস্তুবাদী বাউল বইটির মধ্যে আলকপাত করা হয়েছে। সাধারণ সমাজে এ ধা...

ভাইবে রাধারমণ

তখন কলেজের ছাত্র। বাংলা বিভাগের প্রভাষক শ্রদ্ধেয় রেজা স্যারের সাথে খুবই ভালো সম্পর্ক। কলেজের প্রথম দিনই স্যারকে খুব পছন্দ। তারপর স্যারের সাথে গল্প, সমাজ, রাজনীতি, সাহিত্য নিয়ে আলোচনা। রীতিমত ফিজিক্স, বায়োলোজি ক্লাস ফাঁকি দিলেও বাংলা ক্লাস কখনই ফাঁকি দিতাম না। খুব উপভোগ করতাম স্যারের ক্লাস। হোস্টেল সুপার হিসেবে স্যার ( ওহী আলম রেজা) আমাদের সাথেই থাকতেন। আমরা আসার প্রায় নয় মাস পর স্যার এলেন সুপার হিসেবে। প্রতিদিন রাতে খাবার পরেই স্যারের রুমে গিয়ে আড্ডা হত, গানের আসর হত। স্যারের পিসিতে প্রায়ই গান শুনতাম আমরা। একদিন হঠাৎ করেই একটি গান স্যার প্লে করলেন 'আমার বন্ধু দয়াময় তোমারে দেখিবার মনে লয়। তোমারে না দেখলে রাধার জীবন কেমনে রয় বন্ধুরে।। কদম ডালে বইসারে বন্ধু ভাঙ্গ কদম্বের আগা। শিশুকালে প্রেম শিখাইয়া যৌবনকালে দাগা রে।। তমাল ডালে বইসারে বন্ধু বাজাও রঙের বাশি। সুর শুনিয়া রাধার মন হইলো যে উদাসি রে।। ভাইবে রাধা রমন বলে মনেতে ভাবিয়া। নিভা ছিল মনের আগুন কে দিলাই জ্বালাইয়া রে।' গানের কথাগুলো বেশ ভালো লেগে গেলো। পুর গানটি শুনে বুঝলাম গানটি সাধক রাধারম...