বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পের সার্থক স্রষ্টা৷ বাংলা সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে রবীন্দ্রনাথ নেই। সাহিত্যের নানা আঙ্গিক নিয়ে তিনি পরীক্ষা করেছেন। ছোটগল্প তাঁর সেই বিচিত্রমুখী প্রতিভার অভিজ্ঞান৷
জীবনের সমগ্র রুপ নিয়ে নয়, ছোটগল্প জীবনের খন্ডাংশ নিয়ে রচিত৷ এখানে প্রতিফলিত হয় ছোট ছোট সুখ-দুঃখ, দৈনন্দিন জীবন প্রণালি। সাধারণ ও মধ্যবিত্তের মানবীয় ও সামাজিক টানাপোড়েনের কাহিনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘অপরিচিতা’ গল্প উনিশ- বিশ শতকের সমাজ জীবনের প্রতিচ্ছবি।
‘অপরিচিতা’ গল্পের নায়ক অনুপম। নায়ক হলেও তার মধ্যে নায়কোচিত গুণতো নেইই, পুরুষোচিত গুণেরও অভাব ছিল। শিক্ষিত হলেও সে ছিল ব্যক্তিত্বহীন। অন্যদিকে নারী চরিত্র কল্যাণী ও তার বাবা শম্ভুনাথ সেন ছিলেন ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন। অন্যায়কে প্রশ্রয় দেন নি কখনো, মাথা নত করেন নি। গল্পে অনুপমের লোভী মামার অশোভন আচরণ তৎকালীন বাঙালি সমাজকে প্রতিফলিত করেছে।
গল্পের শুরুতে অনুপমের পরিচয় পাওয়া যায়, অনুপম দেখতে সুশ্রী ছিল। কিন্তু গুণহীনতার কারণে শিক্ষক তাকে শিমুল ফুল ও মাকাল ফলের সাথে তুলনা করতেন। পিতার মৃত্যুর পর মায়ের স্নেহেই অনুপম বড় হয়। অনুগত সন্তান বলেই কখনো মাতৃআজ্ঞার বাইরে যাওয়ার সুযোগ তার ছিল না। কিন্তু তার আসল অভিভাবক ছিলেন মামা। যিনি অনুপমদের সংসারের সবকিছুর ভার কাঁধে নিয়েছিলেন।
অনুপমের বন্ধু হরিশ কানপুরে কাজ করতো। ছুটিতে কলকাতা এসে প্রথমে অনুপমের বিয়ের প্রস্তাবটা দেয়। কল্যাণী নামের মেয়েটির চেহারা ও গুনের কথা শোনার পর থেকে অনুপমের শরীর মন আলোর ছায়া বুনতে লাগল। কন্যাকে আশীর্বাদের জন্য অনুপমের পিসতুতো ভাই বিনুদাদাকে পাঠানো হল। বিনুদাদা এসে বললেন, ” মন্দ নয় হে! খাঁটি সোনা বটে! ”
হরিশের সুপারিশে বিয়ের দিন তারিখ দেনা পাওনা পাকাপাকি হয়ে গেল।
হরিশের সুপারিশে বিয়ের দিন তারিখ দেনা পাওনা পাকাপাকি হয়ে গেল।
কনের বাবা শম্ভুনাথ ছিলেন অত্যন্ত ঠান্ডা প্রকৃতির মানুষ। যাকে বাইরে দেখে ভেতরের চিত্রটা বোঝা মুশকিল। বিয়ের দিন শম্ভুনাথ বাবুর বন্ধু উকিল বাবু বরপক্ষকে স্বাগত জানালেন।
বিয়ের আসরে স্বর্ণ নিয়ে অনুপমের মামার বাড়াবাড়ি রকমের আচরণে শম্ভুনাথ অপমান বোধ করেন। স্যাকরাকে নিয়ে গিয়ে মামা যখন কনের সমস্ত গহনা খুলে নিয়ে বিয়ের আগেই পরীক্ষা করে দেখানোর জন্য কনের পিতাকে আদেশ দেন তখনো অনুপমের ব্যক্তিসত্বা মামার এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারেনি।
বিয়ের আসরে স্বর্ণ নিয়ে অনুপমের মামার বাড়াবাড়ি রকমের আচরণে শম্ভুনাথ অপমান বোধ করেন। স্যাকরাকে নিয়ে গিয়ে মামা যখন কনের সমস্ত গহনা খুলে নিয়ে বিয়ের আগেই পরীক্ষা করে দেখানোর জন্য কনের পিতাকে আদেশ দেন তখনো অনুপমের ব্যক্তিসত্বা মামার এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারেনি।
শম্ভুনাথ এক কথার মানুষ। কন্যার গা থেকে সমস্ত গহনা খুলে নিয়ে অনুপমের মামার আনা স্যাকরাকে দিয়ে পরীক্ষা করে প্রমাণ করলেন তিনি মেয়ের গহনায় ভেজাল মেশাননি বা কম দেননি। উল্টো দেখা গেল- বরপক্ষের দেওয়া আশীর্বাদের যে দুল দেওয়া হয়েছিল তাতে সোনার ভাগ কম ছিল।
বিবাহের লগ্নের আগেই পাত্রপক্ষকে পেটপুরে খাইয়ে দিয়ে শম্ভুনাথ বাবু বললেন, ‘ আমার কন্যার গহনা আমি চুরি করিব, এ কথা যারা মনে করে তাদের হাতে আমি কন্যা দিতে পারি না।
গল্পটি এখানে শেষ হতে পারত৷ কিন্তু পরের দৃশ্যটি বেশ রোমাঞ্চকর। বাড়ি ফিরে সবাই রেগে আগুন। বরযাত্রীরা এই বলিয়া কপাল চাপড়াইতে লাগিল যে, ” বিবাহ হইলনা অথচ আমাদের ফাঁকি দিয়া খাওয়াইয়া দিল- পাকযন্ত্রটাকে সমস্ত অন্নসুদ্ধ সেখানে টান মারিয়া ফেলিয়া আসিতে পারিলে তবে আফসোস মিটিত”!
গল্পটি এখানে শেষ হতে পারত৷ কিন্তু পরের দৃশ্যটি বেশ রোমাঞ্চকর। বাড়ি ফিরে সবাই রেগে আগুন। বরযাত্রীরা এই বলিয়া কপাল চাপড়াইতে লাগিল যে, ” বিবাহ হইলনা অথচ আমাদের ফাঁকি দিয়া খাওয়াইয়া দিল- পাকযন্ত্রটাকে সমস্ত অন্নসুদ্ধ সেখানে টান মারিয়া ফেলিয়া আসিতে পারিলে তবে আফসোস মিটিত”!
বিয়ের চুক্তিভঙ্গ ও মানহানির জন্য অনুপমের মামা মামলা করার চিন্তা করলেন। তবে, হিতৈষিরা বুঝাইয়া দিল, তাহা হইলে তামাশার যেটুকু বাকি আছে তাহা পুরা হইবে। আলাপের সময় কল্যাণীর কাছে অনুপমের একটি ছবি দেওয়া হয়েছিল। অনুপমের ধারনা নিশ্চয়,” সে ছবি তার কোনো একটি বাক্সের মধ্যে লুকানো আছে।
একলা ঘরে দরজা বন্ধ করিয়া এক- একদিন নিরালা দুপুর বেলায় সে কি সেটি খুলিয়া দেখে না। যখন ঝুঁকিয়া পড়িয়া দেখে তখন ছবিটির উপরে কি তার মুখের দুই ধার দিয়া এলোচুল আসিয়া পড়ে না। হঠাৎ বাহিরে কারও পায়ের শব্দ পাইলে সে কি তাড়াতাড়ি সুগন্ধি আচলের মধ্যে ছবিটি লুকাইয়া ফেলে না। ”
দিন যায়, মাস যায়। অনুপমের মামা লজ্জায় বিয়ে নিয়ে আর কথা তুলেন না। অনুপমের মায়ের ইচ্ছা ছিল,অপমানের কথা যখন মানুষ ভুলে যাবে তখন বিয়ের চেষ্টা করবেন। বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার বছরখানেক পর,মাকে নিয়ে তীর্থে যাওয়ার সময় ট্রেনে অপ্রত্যাশিতভাবে কল্যাণীকে আবিষ্কার করে অনুপম। কল্যাণীর প্রাণচঞ্চলতা, ব্যক্তিত্ব, প্রতিবাদী মনোভাব অনুপম ও তার মাকে মুগ্ধ করে। ট্রেন থেকে নেমে তারা জানতে পারেন- এই সেই কল্যাণী!
কিন্তু কল্যাণী ততদিনে নারী শিক্ষার ব্রত নিয়ে বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নিজে যেমন মুক্তি নিয়েছে তেমনি অন্য আরও অনেক নারীর মুক্তির পথ খুঁজছে।
গল্পের শেষে, অনুপম যখন কিছুটা শৃঙ্খল মুক্ত হয় তখন তার মানসিক পরিবর্তন হয়। মনে মনে অপরিচিতার মনে জায়গা করে নিতে চায়। অনুপম ভাবে ‘ ওগো অপরিচিতা, তোমার পরিচয়ের শেষ হইল না, শেষ হইবে না; কিন্তু ভাগ্য আমার ভালো, এই তো আমি জায়গা পাইয়াছি৷
লেখক : অহী আলম রেজা
প্রভাষক, বাংলা, বালাগঞ্জ সরকারি কলেজ ৷
প্রভাষক, বাংলা, বালাগঞ্জ সরকারি কলেজ ৷
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন