মা নিজের হাত তুলে ভাত খাইয়ে দেবেন এই ব্যাপারটার মত সুখকর এবং পবিত্র মুহূর্ত অন্য কোন কিছুই হতে পারেনা। কিন্ডার গার্টেন স্কুলে প্লে বা নার্সারিতে পড়ি তখন ড্রইং বা ছবি আঁকতে আঁকতে মা গল্প শুনাতেন। আমার মা একজন শিক্ষিকা, সারাদিন স্কুল শেষ করে এসে আমাকে দেখাশোনা করা বেশ কষ্টকর ছিল। কিন্তু সন্ধ্যার পর পড়তে বসলে মা গল্প শুনাতেন। মায়ের মুখে শোনা একটি গল্প মনে পড়ে গেলো--
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার মায়ের বয়স তিন বছর। আমার নানীর কোলে থাকা ফুটফুটে শিশু তিনি। সবকিছু উনার মনে নেই। কিন্তু যা মনে ছিলো তাই গল্প করতেন। আমার নানা নজমুল ইসলাম চৌধুরী (সম্পত্তি মিয়া) মুক্তিযুদ্ধে চলে যাবার পর নানার বাড়িকে অনেক ঝুট ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। আমার নানা ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার, মাইজগাঁও ইউনিয়নের নুরপুর গ্রামের বাসিন্দা। ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানার সাবেক স্টাফ। যুদ্ধ করেছেন হাকালুকি হাওর বেষ্টিত বড়লেখা বিয়ানীবাজার সীমান্ত এলাকায়। জুলাই এর শেষ বা আগস্ট মাসের শুরুতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ তুঙ্গে। ফেঞ্চুগঞ্জ স্থানীয় মেলেটারি ক্যাম্পে রাজাকাররা খবর পৌছে দিল জুম্মাটিল্লার সম্পত্তি (নানার নাম) মুক্তিবাহিনীতে চলে গেসেন। আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে আমার ছোট নানী (আমার মায়ের ফুফু) যিনি এখন লন্ডন প্রবাসী তিনি, আমাড় নানী, এবং আমার নানার ভাই (ছোট নানা) আমার মাকে কোলে করে স্থানীয় কুশিয়ারা নদী দিয়ে নৌকা করে বর্তমান পূর্ব ফেঞ্চুগঞ্জ বাজার হয়ে মোগলাবাজার একজন দূর সম্পর্কের ফুফার বাড়িতে চলে গেলেন। মাঝ পথে বাঁধলো বিপত্তি । ঘাট থেকে রাস্তার পাশে আজহার বা আজিম নামের একজন রাজাকার পাড়ে পাড়ে হেঁটে তাড়া করা শুরু করলো নৌকা। রাস্তা থেকে শুরু করলো অজস্র ডাকাডাকি, নৌকা পাড়ে ভিড়ানোর জন্য। খোকা মাঝি নামের সেই নৌকার মাঝি অনেক কষ্ট করে উজানে নৌকা বেয়ে রেহাই করলো আমার মা নানীদের।
মায়ের ঐ ফুফা ছিলেন মৌলানা টাইপের, এই সুবাধে অনেক ক্ষেত্রে পাকিস্তানি মেলেটারি বা রাজাকাররা উনার বাড়ীতে আসত না। তাই নিরাপদ ভেবেই অখানেই আশ্রয় নিয়েছিলেন। আমার এই মা দুধ খেতে খুব পছন্দ করতেন। একদিনের ঘটনা, মা সকাল সকাল বেলা খুব কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন দুধ খাবেন। যেই বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন ঐ বাড়ির কর্তী মায়ের কান্না দেখলেও দুধ দিতেন না একটু খাবার জন্য, ভাবতেন উড়ে এসে জুড়ে বসা মানুষজন। একদিন খুব কান্নাকাটি দেখে, উনাদের বাড়ির পিছনে ছোট বাটিতে করে দেওয়া গৃহস্থালি বিড়ালের মুখ দেওয়া ঝুটা দুধ মা'কে দিয়ে দিলেন। মা ছোট মানুষ সেটাই খেলেন।
মা'ত ছোট ব্যাপারটা বোঝলেন না। কিন্তু ছোট নানী (আমার মায়ের সাথে থাকা ফুপু ) ব্যাপারটা দেখে ফেললেন। এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিরন মধ্যে সেই যে আমার ছোট নানী আমার মা এবং নিজের নানীকে নিয়ে আসছিলেন আজ পর্যন্ত উনাদের সাথে আর কোন সম্পর্ক রাখেন নি।
কথাগুলো কোন গল্প নয়, আমার মায়ের মুখ থেকে শোনা বাস্তব অভিজ্ঞতা। আমার সেই ছোট নানী, লন্ডন প্রবাসী এখনো বলেন, "দেশ কি স্বাধীন হবেনা, হবে হবে, আমার ভাই (নানা) আসবে দুধ নিয়ে"।
এরকম হাজারো শিশু কান্না আর ভোগান্তির অর্জন মহান স্বাধীনতা। হ্যাঁ স্বাধীনতা মহান। আমার বাবা মা দুজনেই ৭০ দশকের প্রজন্ম। মানে মুক্তিযুদ্ধের সময় উনারা একদম বাচ্চা শিশু। কিন্তু স্মৃতিতে লেগে থাকা যতখানি ইতিহাস মনে আছে সেগুলো শুনাতেন। এভাবেই অর্জন স্বাধীনতা।
লেখকঃ চৌধুরী মারূফ, সাংবাদিক
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন