দুই যুগের কাছাকাছি সময়ে রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং সরকার প্রধান ফ্রান্সে রাষ্ট্রীয় সফরে এলেন। আসলে আমরা কি পেলাম প্রবাসীরা প্রধানমন্ত্রীর সফরে এমন প্রশ্ন থেকেই যায়। আমাদের যারা আওয়ামীলীগ মতাদর্শ বা সরকারপন্থী রাজনীতি বা যেকোন ধরনের বিজনেস রিলেশনের সাথে জড়িত তারা বলবেন অনেক কিছুই পেয়েছি। আবার যারা সরকার বিরোধী রাজনীতির সাথে জড়িত বিশেষ করে যারা জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সাথেও জড়িত তারা বলবেন কিছুই পাননি। আর প্রবাসে কষ্ট করে দু'পয়সা আয় করা ছাঁপোষা বাংলাদেশিদের একমাত্র প্রশ্ন এসে কি দিয়ে গেলেন অথবা কি নিয়ে গেলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা !
ফ্রান্সে বসবাস করা বাংলাদেশীদের মনে দীর্ঘদিন থেকে একটি প্রশ্ন বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিল, যে বাংলাদেশ এবং ফ্রান্স সম্পর্ক দীর্ঘদিন থেকে মাইনাসের পথে। বিশেষ করে বিভিন্ন ধর্মীয় ইস্যু নিয়ে ইসলাম ভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন কর্মসূচি মোটাদাগে বলতে গেলে বাংলাদেশে অবস্থিত ফ্রান্স হাইকমিশন ঘেরাও কর্মসূচি নিয়ে অনেকে আতঙ্কিত ছিলেন। ফ্রান্সে অবথান করা প্রবাসী বাংলাদেশীদের মনে একটাই প্রশ্ন ছিল অভিবাসী, ইমিগ্র্যান্ট (সেলারি কার্ড) এবং পারিবারিক ভিসা আওতায় ফ্রান্সে নিয়মিত বাসিন্দা হওয়ার সুযোগ অনেকটাই কমে গেছে বাংলাদেশে ফ্রান্স বিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক মুভমেন্ট এর কারণে। ফ্রান্স প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মেক্র এবং বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাস্যজ্জ্বল ছবি দেখে, এলিসি প্রাসাদে উষ্ণ অভ্যর্থনা দেখে এই শঙ্কা হয়ত কিছুটা কেটেছে। আবার ভেতরে ভেতরে অনেকের বুক ধুরুধুরু করে, কি বলে গেলেন প্রধানমন্ত্রী যার কারণে নাকি আবার নিয়মিত নাগরিক বা রেসিডেন্স পারমিট পাবার প্রবণতা কমে যায়।
বাস্তবতা হচ্ছে , যারা আওয়ামীলীগ বা সরকারপন্থী রাজনীতির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত তারা দীর্ঘদিন পরে নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ এর সুযোগ পেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর সাথে অবস্থান করা সফর সঙ্গী যেমন স্থানীয় সাংসদ, কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে দেখা করার জন্য দীর্ঘ সময় অবস্থান করেছেন হোটেলের সামনে। অনেকে দেখা পেয়েছেন, সুখ দুঃখ আলোচনা করেছেন। নেতা উপলব্ধি করেন বা না'ই করেন কর্মীরা গিয়েছেন দেখা করেছেন বলেছেন। ফ্রান্সে অবস্থান করেছেন প্রধস্নমন্ত্রীর সফর সঙ্গীরা প্যারিসের ইল দ্যা ফ্রান্স রিজওন এর অপেরা এলাকার হোটেল কন্টিনেন্টাল ইন্টারন্যাশনালে। আমি নিজেও গিয়েছি দেখেছি কর্মীরা কিভাবে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করেছেন নেতার সাক্ষাৎ এর জন্য। এটা যে শুধু রাজনৈতিক অবস্থা উন্নতির লক্ষ্য ছিল তা নয় একধরনের ভালোবাসা'ও কাজ করছিল। আবার বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা বিভিন্ন হোটেলে করেছেন ছোটখাট সভা সমাবেশ, ' গো ব্যাক হাসিনা' ইত্যাদি বলে শ্লোগান ও দিয়েছেন তাদের দলীয় নেতার আস্থাভাজন হবার লক্ষ্যে । আর সাধারণ একজন খেটে খাওয়া প্রবাসী বারবার প্রশ্ন করেই চলছেন আগামীর ফ্রান্স বাংলাদেশী প্রবাসীদের জন্য কেমন হতে চলছে?
শেখ হাসিনা ফ্রান্স সফর করলেন ৯ থেকে ১২ নভেম্বর। প্রথমে উদ্দেশ্য, প্যারিসে ইউনেস্কো সদর দফতরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে একটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে বিজয়ীদের হাতে সম্মাননা তুলে দিলেন । প্রথমত প্রধানমন্ত্রীর সফর রাষ্ট্রীয় না থাকলেও পরবর্তীতে ফ্রান্স সরকার এটিকে সরকারি সফর ঘোষণা করলো।
এই পুরষ্কারের বিশেষ দিক হচ্ছে ক্রিয়েটিভ ইকোনমিতে সাফল্য এবং অব্দানের জন্য এই পুরষ্কার আমাদের দেশের মান এবং সম্মান বাড়িয়েছে। বিশ্বের দরবারে উঠে এসে বাংলাদেশের নাম আরও একবার। এখানে আমরা 'এজ এ বাংলাদেশী' হিসেবে পেয়েছি সম্মান। এই সম্মান হয়ত কোন বস্তু বা আইনগত বিষয় নয় , আমরা লাল না কালো দেখতে পারব না, কিন্তু ফ্রান্স রাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশীদের গুরুত্ব নিঃসন্দেহে আরও বেড়ে গেলো তুলনামূলক।
ফ্রান্সে সফরকালে মূলত প্রতিরক্ষামূলক বিভিন্ন সরঞ্জাম অত্যাধুনিক ফরাসি যুদ্ধবিমান রাফাল, দ্বিতীয় স্যাটেলাইট চালু এবং উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন রাডার কেনা সংক্রান্ত বিষয় গুরুত্বপূর্ণভাবে স্থান পেয়েছে। এই পুরোটো ব্যাপারটি প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত। একটি দেশের জন্য যে বিভিন্ন প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জাম দরকার সেটি এই সফরের অন্যতম একটি বিষয় ছিল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই সরঞ্জাম পাবলিকের কি কাজে লাগবে। আমার কাছে উত্তরটা এমন মনে হচ্ছে, আমরা বাড়িতে গ্রিল বা সদর দরজায় কেন সিসি ক্যামেরা বা খিল ব্যবহার করি যেসবের জন্য, ঠিক তার জন্যই।
সফরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন, বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এয়ারবাসের সিইও গুইলাম ফরি। শেখ হাসিনার কাছে এয়ারবাসের যাত্রীবাহী বিমানের সুবিধা তুলে ধরলেও কোম্পানিটির কাছে কার্গো বিমানের কথা বলা হয় ঢাকার পক্ষ থেকে। অ্যারোনটিক্যাল প্রযুক্তি বিনিময়েও সম্মত হয়েছে এয়ারবাস। ফরাসি অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান রাফাল এখন সামরিক সক্ষমতার মাত্রায় বিভিন্ন দেশের প্রতিরক্ষা কৌশলে বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় সম্মতিপত্রের সূত্র ধরে শেখ হাসিনার কাছে রাফালের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ড্যাসল্ট অ্যাভিয়েশনের প্রেসিডেন্ট এরিক ট্র্যাপিয়ারও এ প্রসঙ্গে কথা বলেন। তবে ড্যাসল্টের অ্যাভিয়েশন প্রযুক্তি লালমনিরহাটে অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় কাজে লাগানোর প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন স্যাটেলাইট নির্মাতা প্রতিষ্ঠান থ্যালেসের প্রেসিডেন্ট প্যাট্রিক কেইন। এ সময়, বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে তাদের আগ্রহ দেখিয়েছেন থ্যালেস প্রধান। এ ছাড়া,বাংলাদেশে ই-ভিসা চালু করারও প্রস্তাব দিয়েছে তারা। জানা গেছে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের থার্ড টার্মিনালে পুরো বাংলাদেশ কভার করার উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন যে মাল্টি মোডাল রাডার কেনা হচ্ছে তারও নির্মাতা থ্যালেস। কোভিড ব্যবস্থাপনা, পানি সঞ্চালন এবং বিমান চলাচল খাতে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা বাড়াতে ফ্রান্সের সঙ্গে তিনটি চুক্তি করেছে বাংলাদেশ।
আমরা সবাই জানি বাংলাদেশের এই সময়ে বড় ধরনের সমস্যা রোহিঙ্গা সমস্যা। এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে ফ্রান্স প্রেসিডেন্ট এর সাথে। এটা নিশ্চিত ফ্রান্স সরকার জানিয়েছে এবং আশ্বাস দিয়েছে, সংকটের স্থায়ী সমাধান না হওয়া পর্যন্ত তারা বাংলাদেশের পাশে থাকবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আসলেই কি ফ্রান্স পাশে থাকবে এই সমস্যা মোকাবেলায় বাংলাদেশের। আমি ছোট একটি ভিডিও ফুটেজের কথা বলি যা জাতিসংঘের সাধারন পরিষদের ঘটনা। বিভিন্ন দেশ যখন প্যালিস্টাইন এবং ইসরায়েল ইস্যুতে ভোট দিচ্ছিলো স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সেখানে ফ্রান্স ফিলিস্তিনের পক্ষেই ভোট দিয়েছি। যেখানে না ভোট দিয়েছি যুক্তরাষ্ট্রের মত শক্তিধর রাষ্ট্র। সুতরাং আশাবাদী হওয়াই যায় পাশে থাকবে এমন ইস্যুতে ফ্রান্স।
ফ্রান্সের সিনেটের সদস্যদের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। সেখানে মূলত বিনিয়োগ এবং বাণিজ্য নিয়ে কথা হয়েছে। আমরা প্রবাসীরা আশা করতে পারি, আগামীতে শুল্ক মুক্ত বাণিজ্য আমরা করতে পারব ফ্রান্সে। যদিও এটা হয়ত সময় সাপেক্ষ ব্যাপার, তবুও যদি একবার হয়ে যায় তাহলে অন্তত আমাদের দেশের খাদ্য পণ্য গুলো আরও বেশি প্রবাসে অবস্থান করা আমরা বাংলাদেশীদের হাতের নাগালে চলে আসবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্যারিসে এলিসি প্রাসাদে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর সঙ্গে বৈঠকের পর দুই দেশ প্রতিরক্ষা সহযোগিতার সম্মতিপত্রে সই করেছেন। তাতে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর দক্ষতা বাড়ানোর জন্য আধুনিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি প্রযুক্তি বিনিময়ের মতো বিষয়গুলো যুক্ত থাকছে। দুই দেশ প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সহযোগিতা বাড়াতে একমত হয়েছেন দুই দেশের সরকারের সর্বোচ্চ নেতারা। এদিকে শেখ হাসিনার সাথে দেখা করেছেন ফ্রান্সের ব্যবসায়ীদের অন্যতম সংগঠন মুভমেন্ট অব দ্য এন্টারপ্রাইজ অব ফ্রান্সের (এমইডিইএফ) উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল দল। অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত সহযোগিতা বিষয়ে তিনটি চুক্তি সই করেছে বাংলাদেশ ও ফ্রান্স। এছাড়া বাংলাদেশ ফ্রান্সের মধ্যে তিনটি চুক্তির মধ্যে দু’টি চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশকে ৩৩০ মিলিয়ন ইউরো উন্নয়ন সহায়তা দেবে ফ্রান্স যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশ গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
পাঁচ দিনের সফরে আমরা সরাসরি অনেক কিছুই পাইনি বলে অনেকে উড়িয়ে দেবেন অম্লজানে। তবে আমি তা বলছিনা। সরাসরি যে বিষয়টি পেয়েছি বাংলাদেশ এবং ফ্রান্সের মধ্যে একটি উন্নত সম্পর্ক যা জোরদার হলো আরো। আমরা যারা ফ্রান্সে বসবাস করছি এর ফল সরাসরি হয়ত আমরা কোন আইনে ভোগ করব না, তবে রেসিডেন্স পারমিটের চিন্তায় আমরা যারা অনেক আতঙ্কিত তারা অবশ্যই সুনজরে থাকব ফ্রান্স সরকার। বিগত কয়েক বছরের তিক্তটা কাটবে, এটাই দিনশেষে আমাদের ফলাফল। বলা বাহুল্য ফ্রান্স সরকার এমন নয়, যে ইমিগ্রেশন ক্যাটাগরি অভিবাসী ক্যাটাগরিতে কোন পরিবর্তন আনবে। এসব সম্পূর্ণভাবে বিবেচনা করা হয় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা গুলোর কাণ্ট্রি রিপোর্ট অনুসারে।
লেখকঃ চৌধুরী মারূফ অমিত, সাংবাদিক ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন