সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

হিরোশিমা দিবস এবং বিভিন্ন গণহত্যা

১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট। জাপানের হিরোশিমা শহরে স্থানীয় সময় তখন সকাল আটটা ১৫ মিনিট। তখনো ভালো করে ঘুম ভাঙ্গে নি মানুষের। শুরু হয়নি কর্মব্যস্ত সময়। ঠিক সেই সময়টাতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা তখন জোরেশোরে বাজছে। ৬ আগস্ট অর্থাৎ জাপানের হিরোশিমা শহরে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম পারমাণবিক বোমা হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন বি-টুয়েন্টি নাইন বোমারু বিমান এনোলা গে থেকে হিরোশিমায় ফেলা হয় আণবিক বোমা ‘লিটল বয়’। বোমাটি প্রায় ৫০০ মিটার উঁচুতে বিস্ফোরিত হয়। ওই পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণে তাৎক্ষণিকভাবে প্রায় দেড় লাখ মানুষ নিহত হন। তখনও ঘুমের মধ্যেই ছিলেন বেশিরভাগ মানুষ। মাটির সঙ্গে মিশে যায় বেশিরভাগ স্থাপনা। ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয় একটি নগরী। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় বছর শেষে আরও ৬০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়।
আজ ৬ আগস্ট। হিরোশিমা দিবসের ৭৩তম বার্ষিকী। এটি মার্কিনীদের চালানো একটি গনহত্যা ছিল। ঘুমন্ত সাধারণ নাগরিকদের উপর অতর্কিত হামলা ছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ রাতেও এভাবে আমাদের বাঙ্গালীদের উপর হামলা চালিয়েছিল পাকিস্তানী মেলেটারীরা। গভীর রাতে তখন আমাদের জনসাধারণও ঘুমে ছিল। ঢাকা শহরেও প্রায় ৫০ হাজার লোক হত্যা করা হয়েছিল। করেছে তুর্কির মানুষো গণহত্যা। জাতিগত আর্মেনীয়রা নিজেদের ‘হায়’ বলে থাকে। আর্মেনিয়ার ৯০ শতাংশ মানুষ এই ‘হায়’ জাতির। ১৯১১ সালে স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯২২ সালে এটি সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তুর্কিরা আর্মেনীয়দের ওপর নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। তিন বছর ধরে চলা এই গণহত্যায় সে দেশের ১৫ লাখ মানুষ মারা যায়। সে সময় আর্মেনিয়ার জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৩৪ লাখ।
শুধু তাই নয়, হলোকাস্ট শব্দটা বাংলা করলে দাঁড়ায় সবকিছু পোড়ানো। তবে শব্দটি এখন জার্মান সেনাদের প্রায় ৬০ লাখ মানুষ হত্যাকেই বোঝায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদি ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়ের ওপর চালানো এই গণহত্যাকে স্মরণকালের সবচেয়ে নৃশংস গণহত্যা হিসেবে ধরা হয়। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকেই ইহুদিদের ওপর জার্মান বাহিনীর খড়্গ নেমে এসেছিল। তবে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যা ঘটে, সেই নৃশংসতাকে কোনো শব্দ দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয়। জার্মান বাহিনী ১৯৪১ সাল নাগাদ ইউরোপের বেশ কিছু দেশ দখলে নেয়। তখন জার্মানিতে ক্রমবর্ধমান নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে পার্শ্ববর্তী পোল্যান্ড, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, ডেনমার্ক ও নরওয়েতে আশ্রয় নেয় লাখ লাখ মানুষ। অনেক ইহুদিকে বন্দী করে পাঠানো হয় পোল্যান্ড ও জার্মানির বন্দিশালাগুলোতে। এসব বন্দিশালাতেই কখনো গুলি, কখনো গ্যাস কিংবা কখনো রাসায়নিক প্রয়োগে হত্যা করা হয় কয়েক লাখ ইহুদিকে। বন্দিশালায় অত্যধিক পরিশ্রম, খাবারের অভাব আর চিকিৎসার অভাবেও মারা যায় বহু ইহুদি।এই নৃশংসতম গণহত্যায় নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে প্রতিবছর ২৭ জানুয়ারি জাতিসংঘের পক্ষ থেকে পালন করা হয় আন্তর্জাতিক হলোকাস্ট দিবস।
একই সময়ে আরেকটি নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে, যা ‘দ্য ন্যানকিং ম্যাসাকার’ কিংবা ‘রেইপ অব ন্যানকিং’ নামে অনেকের জানা। ১৯৩৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর থেকে ১৯৩৮ সালের জানুয়ারির শেষ ভাগ পর্যন্ত জাপানি সেনাবাহিনী চীনের তৎকালীন রাজধানী ন্যানকিং শহরটিকে একদম গুঁড়িয়ে দেয়। প্রচুর পরিমাণে ধর্ষণ, হত্যাকাণ্ড ও লুটতারাজ চলতে থাকে। এই অল্প সময়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ লাখ। বলা হয়ে থাকে, সেই যুদ্ধে এক তলোয়ারে ১০০ মানুষকে জবাই করা হতো। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ কম্বোডিয়া। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত দেশটিতে ক্ষমতায় ছিল খেমাররুজরা। এই চার বছরে খেমাররুজ সরকার নির্মম গণহত্যা ঘটিয়েছিল, যা কম্বোডীয় গণহত্যা নামেই পরিচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিভিন্ন গণহত্যার মধ্যে কম্বোডিয়ার এই হত্যাকাণ্ড উল্লেখযোগ্য। বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার নামে এই সময়ে প্রায় ২০ লাখ সাধারণ কম্বোডীয়কে হত্যা করে ক্ষমতাসীন বামপন্থী খেমাররুজ সরকার। যে নৃশংস হত্যার শুরু হয়েছিল আগের সরকারের অধীনে কাজ করা কর্মকর্তা-কর্মচারী দিয়ে। কেউ অনিয়মের প্রতিবাদ করলেই হত্যা করা হতো। একপর্যায়ে এই হত্যাযজ্ঞ ছড়িয়ে পড়ে খোদ খেমাররুজ সদস্যদের মধ্যেও। বিদেশিদের গুপ্তচর, দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার বায়বীয় অভিযোগে অনেক খেমাররুজ সদস্যকেও তাঁদের জীবন হারাতে হয়। একসময় দেশটিতে চরম অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়। দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ। দুর্ভিক্ষ আর মহামারিতে আক্রান্ত হয়েও প্রাণ হারাতে থাকে হাজার হাজার মানুষ। পরে ভিয়েতনামের সরকারি বাহিনীর হাতে খেমাররুজ সরকারের পতন হয়।
১৯৯২ সালের এপ্রিলে যুগোস্লাভিয়া থেকে নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করে বসনিয়া-হার্জেগোভিনা। এই অপরাধে এই মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায় বসনীয় সার্বরা। ধারণা করা হয়, এই গণহত্যায় কমপক্ষে এক লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। তিন বছর ধরে চলা এই গণহত্যার মধ্যে নৃশংসতায় সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সেব্রেনিৎসা গণহত্যা। ১৯৯৫ সালের জুলাই মাসে জাতিসংঘ ঘোষিত নিরাপদ এলাকা সেব্রেনিৎসায় নিয়োজিত শান্তিরক্ষী বাহিনীর সামনেই আলাদা করা হয় সেখানে বসবাসরত নারী ও পুরুষদের। এরপর শুরু হয় নৃশংসতার প্রথম পর্ব। মুসলিম নারী ও কিশোরীদের একে একে বাসে তুলে পাঠানো হয় সার্ব-অধ্যুষিত এলাকাগুলোয়, যেখানে তাদের ওপর চালানো হয় যৌন নিপীড়ন, অপেক্ষাকৃত কম বয়সীরা শিকার হয় ধর্ষণের। অন্যদিকে সেব্রেনিৎসার সাত থেকে আট হাজার কিশোর ও পুরুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় সেখানেই। একই ধরনের নৃশংসতা চালানো হয় সারায়েভো, জেপা, ফোকা, প্রিজেদর ও ভিজগ্রাদে। সার্বীয় সৈন্যদের হাতে হত্যা আর ধর্ষণের শিকার হয় লক্ষাধিক বসনীয় মুসলিম।





পৃথিবীতে সংগঠিত প্রতিটি গণহত্যাকারীদের বিচার হোক। হয়েছে, হবেও। গণহত্যাকারীদের রাজনৈতিক ভাবে, আন্তর্জাতিক রাজনীতির মোড়লের আসন থেকে প্রত্যাখ্যান করুক প্রতিটি জাতি। আমি গণহত্যার বিচার চাই ।



তথ্যসূত্র- দেশে দেশে গণহত্যা
লিখেছেন- মারূফ, সাংবাদিক

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাউল সাধক চান মিয়া এবং আমার কিছু উপলব্ধি

"রজনী হইসনা অবসান  আজ নিশিতে আসতে পারেবন্ধু কালাচাঁন।। কত নিশি পোহাইলোমনের আশা মনে রইলো রে কেন বন্ধু আসিলোনা জুড়ায়না পরান। আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন।। বাসর সাজাই আসার আশেআসবে বন্ধু নিশি শেষে দারূন পিরিতের বিষে ধরিল উজান। আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন।। মেঘে ঢাকা আঁধার রাতে কেমনে থাকি একা ঘরে সাধক চাঁনমিয়া কয় কানতে কানতে হইলাম পেরেশান আজ নিশিতে আসতে বন্দু কালাচাঁন।"    গভীর নিশিতে ধ্যান মগ্ন হয়ে কালাচাঁনের অপেক্ষা করছেন সাধক।  সাধক চান মিয়ার শিষ্য বাউল সিরাজউদ্দিনের মতে এটি একটি রাই বিচ্ছেদ। কৃষ্ণের অপেক্ষায় রাধা নিশি বা রাতকে অনুরোধ করছেন 'রাত' যেন না পোহায়  কারণ তার কালা চান যে কোন সময় আসতে পারে। শব্দগুচ্ছ গুলো থেকে সহজেই উপলব্ধি হয় সাধক নিজ দেহকে রাধা আর আত্মাকে কৃষ্ণের সাথে তুলনা করেছেন। দেহ আত্মার মিলন ঘটানোই ছিল সাধকের সাধনা।        বাউল সাধক চান মিয়া উপরোক্ত গানটি রচনা করেছেন। নেত্রকোনা জেলার খাটপুরা গ্রামে ১৩২৫ বঙ্গাব্দে সাধক চান মিয়ার জন্ম। পুরো নাম চান্দেজ্জামান আকন্দ হলেও বা...

বাউল, বাউলতত্ব এবং কিছু কথা

একজন ভদ্র বন্ধু বরের সাথে বাউল সম্প্রদায় নিয়ে বেশ তর্ক হলো রাতে। তর্কের সূত্রপাত ছিল বাউলরা ভাববাদী না বস্তুবাদী। ভাবলাম "বাউলতত্ত্ব"র আলোকে বাউলরা ভাববাদী নাকি বস্তুবাদী তা নিয়ে যৌক্তিক আলোচনা আবশ্যম্ভাবী। কয়েকটি ধারাবাহিক পর্ব লিখে নিজের মনোভাব বোঝানোর চেষ্টা করব।  শুরুতেই শক্তিনাথ ঝাঁ এর বস্তুবাদী বাউল বই থেকে কিছু কথা লিখতে চাই; বাস্তব জগত ও জীবনকে এরা কোন আনুমানিক যুক্তি বা আলৌকিক যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে নারাজ। জৈব রাসায়নিক ব্যাখায় এরা নারীর রজঃ এবং পুরুষের বিজে জীবন ও জগত সৃষ্টিকে ব্যাখা করে এবং চার ভূতকে প্রাকৃতিক সৃষ্টি মনে করে। এভাবে মানুষে, প্রকৃতিতে তৈরি করে প্রাণ, প্রাণী। অনুমান ভিত্তিক স্বর্গ, নরক, পরলোক, পুনর্জন্মাদি প্রত্যক্ষ প্রমাণাভাবে বাউল আগ্রাহ্য করে। মানুষ ব্যাতিরিক্ত ঈশ্বরও এরা মানে না। সৃষ্টির নিয়মকে জেনে যিনি নিজেকে পরিচালনা করতে শিখেছেন- তিনিই সাঁই। সুস্থ নিরোগ দীর্ঘজীবন এবং আনন্দকে অনুভব করার বাউল সাধনা এক আনন্দমার্গ।।  বাউলরা ভাববাদী না বস্তুবাদী এর অনেক সূক্ষ বিশ্লেষণ শক্তিনাথের বস্তুবাদী বাউল বইটির মধ্যে আলকপাত করা হয়েছে। সাধারণ সমাজে এ ধা...

ভাইবে রাধারমণ

তখন কলেজের ছাত্র। বাংলা বিভাগের প্রভাষক শ্রদ্ধেয় রেজা স্যারের সাথে খুবই ভালো সম্পর্ক। কলেজের প্রথম দিনই স্যারকে খুব পছন্দ। তারপর স্যারের সাথে গল্প, সমাজ, রাজনীতি, সাহিত্য নিয়ে আলোচনা। রীতিমত ফিজিক্স, বায়োলোজি ক্লাস ফাঁকি দিলেও বাংলা ক্লাস কখনই ফাঁকি দিতাম না। খুব উপভোগ করতাম স্যারের ক্লাস। হোস্টেল সুপার হিসেবে স্যার ( ওহী আলম রেজা) আমাদের সাথেই থাকতেন। আমরা আসার প্রায় নয় মাস পর স্যার এলেন সুপার হিসেবে। প্রতিদিন রাতে খাবার পরেই স্যারের রুমে গিয়ে আড্ডা হত, গানের আসর হত। স্যারের পিসিতে প্রায়ই গান শুনতাম আমরা। একদিন হঠাৎ করেই একটি গান স্যার প্লে করলেন 'আমার বন্ধু দয়াময় তোমারে দেখিবার মনে লয়। তোমারে না দেখলে রাধার জীবন কেমনে রয় বন্ধুরে।। কদম ডালে বইসারে বন্ধু ভাঙ্গ কদম্বের আগা। শিশুকালে প্রেম শিখাইয়া যৌবনকালে দাগা রে।। তমাল ডালে বইসারে বন্ধু বাজাও রঙের বাশি। সুর শুনিয়া রাধার মন হইলো যে উদাসি রে।। ভাইবে রাধা রমন বলে মনেতে ভাবিয়া। নিভা ছিল মনের আগুন কে দিলাই জ্বালাইয়া রে।' গানের কথাগুলো বেশ ভালো লেগে গেলো। পুর গানটি শুনে বুঝলাম গানটি সাধক রাধারম...