সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন- ডা.জোবায়ের আহমেদ


মাতুয়াইল শিশুমাতৃ ইন্সটিটিউটের উদ্যোগে দেশে প্রথমবারের মত স্থাপিত হলো হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক। যে মায়েদের সন্তান জন্মের পরই মারা গেছে বা যে মায়েদের নিজ সন্তানকে খাওয়ানো পরেও অতিরিক্ত দুধ আছে, সেসব মায়েরা হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকে দুধ সংরক্ষণ করে রাখতে পারবেন।যে নবজাতকের মা জন্মের পরপরই মারা গেছেন বা যেই মা অসুস্থতা জনিত কারণে দুধ খাওয়াতে পারছেন না, সেই নবজাতকরা এই দুধ খেতে পারবে।প্রিম্যাচিউর লো বার্থ ওয়েট ও এনআইসিইউ এর বাচ্চাদের এই দুধ খাওয়ানোর ফলে শিশুমৃত্যু রোধ হবে।দত্তক নেওয়া সন্তানকে এই ব্যাংক থেকে দুধ নিয়ে খাওয়ানো যাবে। যেসব মায়েরা জন্মের পর নবজাতককে রাস্তায় ডাস্টবিনে ফেলে যান, তাদের এই দুধ খাওয়ানো যাবে।হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকে রাখা দুধ তিন মাস থেকে ১৮ মাস পর্যন্ত ভালো থাকবে। ব্যাংক থেকে বাড়িতে নেওয়া দুধ ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত ভালো থাকবে।কর্মজীবী নারীরা যারা দীর্ঘক্ষণ বাসার বাইরে থাকেন তারা এই ব্যাংকে দুধ জমা রাখতে পারবেন। পরে বাড়ি ফিরে সেই দুধ সন্তানকে খাওয়াতে পারবেন। মিল্ক ভ্যান চালু হলে কর্মীরা বাড়ি থেকে দুধ সংগ্রহ করবেন এবং বাড়িতে দুধ পৌঁছে দিবেন।এতে অনাকাঙ্ক্ষিত শিশুমৃত্যু রোধ হবে, শিশুর অপুষ্টি দূর হবে এবং ফর্মুলা মিল্ক আর শিশুকে খাওয়াতে হবেনা। শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সবল হবে। মাতৃ-দুধের সকল উপকারিতা শিশু পাবে।অনন্য এই উদ্যোগ প্রকাশের পরপরই চারদিকে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকে হারাম ঘোষণা দিয়ে হৈচৈ পড়ে গেছে।ইসলামে দুধ সম্পর্ককে মাহরাম ঘোষণা করা হয়েছে। দুধ মাতা, যেই মা দুধ পান করান উনার স্বামী সেই শিশুটির জন্য দুধ-পিতা, দুধ মায়ের সন্তান দুধ ভাই-বোন হিসেবে মাহরাম বলে গণ্য হবেন অর্থাৎ এদের মধ্যে বিয়ে হারাম।।কতটুকু দুধ পান করলে দুধ সম্পর্ক স্থাপিত হবে?
কতটুকু দুধ পান করলে বা কতবার দুধ পান করলে দুধ সম্পর্ক স্থাপিত হবে তা নিয়ে ফকিহগণের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। ইমাম আবু হানিফার (রা.) মত হচ্ছে, সামান্য পরিমাণ দুধ পান করলেই দুধ সম্পর্ক স্থাপিত হবে। কম বেশি ধর্তব্য নয়। এতটুকু পরিমাণ যা কোনভাবে পেট পর্যন্ত পৌঁছালেই দুধ সম্পর্ক স্থাপিত হবে।ইমাম মালেকের (রা.) মত ইমাম আবু হানিফার (রা.) মতই। অর্থাৎ হানাফি ও মালেকী মাযহাব একই মত অনুসরণ করে। কিন্তু তাদের বিপরীত অধিকাংশ ফকিহগণের মত হচ্ছে নির্দিষ্ট পরিমাণ দুধ পান ছাড়া দুধ সম্পর্ক সাব্যস্ত হবেনা।নির্দিষ্ট পরিমাণ বলতে ৫ বার পরিতৃপ্তির সঙ্গে শিশুর দুধ পান করতে হবে। শিশু দুধ পান করতে কর‍তে যখন স্বেচ্ছায় দুধ পান থেকে বিরত হবে তখন বুঝা যাবে সে পরিতৃপ্ত হয়েছে। এভাবে পাঁচ বার পরিতৃপ্ত দুধ পানে দুধ সম্পর্ক স্থাপিত হবে। এই গ্রুপের দলিল হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিস। তিনি বলেন, কুরআনে প্রথম দশবার পান করার দ্বারা দুধ সম্পর্ক সাব্যস্ত হবার হুকুম নাযিল হয়েছিলো। তারপর সেই হুকুম পরিবর্তন করে পাঁচবারে আনা হয়েছে। (রেফারেন্স: ফাতহুল বারী শরহু সহীহিল বোখারি, ৯/১৪৭)সম্প্রতি সিঙ্গাপুরের মুসলিম স্কলার ও ফতওয়া কমিটি মত দিয়েছেন হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের পক্ষে। তাদের মত হলো- একজন মা যে পরিমাণ দুধ দেবেন তা থেকে ৫০ মিলির বোতলে সেই দুধ প্রক্রিয়াজাত করে সেই বোতল থেকে Split করে সারা দিন সেই শিশুকে খাওয়ালে দুই থেকে তিন ফিডের বেশি দুধ যাবেনা। এতে একজন মা থেকে দুই থেকে তিনবার দুধ পান করানোর মত দুধ সেই শিশুটি পাবে। এতে ভিন্ন ভিন্ন ডোনার থেকে দুধ পান করালে সরিয়া লঙ্ঘন হবেনা। শিশুটিকে মৃত্যুর ঝুঁকি থেকে রক্ষা পাবে।।আপনার শিশুর স্টোমাক কত বড়?
শিশুর প্রথম দিন তার স্টোমাক একটা চেরি ফলের সাইজের সমান যা ভরতে ৫-৭ মিলি দুধ লাগে। তৃতীয় দিনে সেই স্টোমাক একটা ওয়ালনাটের সমান হয় যা ভরতে ২২-২৭ মিলি দুধ লাগে। ৭ দিনের দিন শিশুর স্টোমাক একটা এপ্রিকট ফলের সমান হয় যা ভরতে ৪৫-৬০ মিলি দুধ লাগে। এবং এক মাস বয়সে তা একটি বড় ডিমের আকার ধারণ করে যা ভরতে ৮০-১৫০ মিলি দুধ লাগে।২ কেজি ওজনের একটা শিশুর সারাদিনে ৩১৩ মিলি দুধ লাগে। ২.৫ কেজি ওজনের একজন শিশুর সারাদিনে ৩৯১ মিলি দুধ লাগে। ৩ কেজি ওজনের জন্য ৪৬৯ মিলি, ৩.৫ কেজি ওজনের জন্য ৫৪৮ মিলি দুধ লাগে। এভাবে ওজন বাড়ার সাথে সাথে সারাদিনের দুধের পরিমাণ বাড়ে।।এখন এনআইসিইউতে রাখা একটা নবজাতককে বিভিন্ন বিভিন্ন ডোনারের দুধ খাওয়ালে শিশুটির দৈনিক চাহিদা পূরণ হবার পাশাপাশি শরিয়াহও লঙ্ঘিত হয়না। সিঙ্গাপুর শরীয়াহ কমিটি এই হিসেবের ভিত্তিতেই সেই দেশে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক এর অনুমোদন দিয়েছেন।।হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের মত অনন্য উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। সারাদেশে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক স্থাপন করে নবজাতক ও শিশুদের মায়ের দুধ খাবার সুযোগ তৈরি করে নবজাতক ও শিশুমৃত্যু রোধ করতে ভূমিকা রাখতে যারা সচেষ্ট হয়েছেন তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ।


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাউল সাধক চান মিয়া এবং আমার কিছু উপলব্ধি

"রজনী হইসনা অবসান  আজ নিশিতে আসতে পারেবন্ধু কালাচাঁন।। কত নিশি পোহাইলোমনের আশা মনে রইলো রে কেন বন্ধু আসিলোনা জুড়ায়না পরান। আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন।। বাসর সাজাই আসার আশেআসবে বন্ধু নিশি শেষে দারূন পিরিতের বিষে ধরিল উজান। আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন।। মেঘে ঢাকা আঁধার রাতে কেমনে থাকি একা ঘরে সাধক চাঁনমিয়া কয় কানতে কানতে হইলাম পেরেশান আজ নিশিতে আসতে বন্দু কালাচাঁন।"    গভীর নিশিতে ধ্যান মগ্ন হয়ে কালাচাঁনের অপেক্ষা করছেন সাধক।  সাধক চান মিয়ার শিষ্য বাউল সিরাজউদ্দিনের মতে এটি একটি রাই বিচ্ছেদ। কৃষ্ণের অপেক্ষায় রাধা নিশি বা রাতকে অনুরোধ করছেন 'রাত' যেন না পোহায়  কারণ তার কালা চান যে কোন সময় আসতে পারে। শব্দগুচ্ছ গুলো থেকে সহজেই উপলব্ধি হয় সাধক নিজ দেহকে রাধা আর আত্মাকে কৃষ্ণের সাথে তুলনা করেছেন। দেহ আত্মার মিলন ঘটানোই ছিল সাধকের সাধনা।        বাউল সাধক চান মিয়া উপরোক্ত গানটি রচনা করেছেন। নেত্রকোনা জেলার খাটপুরা গ্রামে ১৩২৫ বঙ্গাব্দে সাধক চান মিয়ার জন্ম। পুরো নাম চান্দেজ্জামান আকন্দ হলেও বা...

বাউল, বাউলতত্ব এবং কিছু কথা

একজন ভদ্র বন্ধু বরের সাথে বাউল সম্প্রদায় নিয়ে বেশ তর্ক হলো রাতে। তর্কের সূত্রপাত ছিল বাউলরা ভাববাদী না বস্তুবাদী। ভাবলাম "বাউলতত্ত্ব"র আলোকে বাউলরা ভাববাদী নাকি বস্তুবাদী তা নিয়ে যৌক্তিক আলোচনা আবশ্যম্ভাবী। কয়েকটি ধারাবাহিক পর্ব লিখে নিজের মনোভাব বোঝানোর চেষ্টা করব।  শুরুতেই শক্তিনাথ ঝাঁ এর বস্তুবাদী বাউল বই থেকে কিছু কথা লিখতে চাই; বাস্তব জগত ও জীবনকে এরা কোন আনুমানিক যুক্তি বা আলৌকিক যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে নারাজ। জৈব রাসায়নিক ব্যাখায় এরা নারীর রজঃ এবং পুরুষের বিজে জীবন ও জগত সৃষ্টিকে ব্যাখা করে এবং চার ভূতকে প্রাকৃতিক সৃষ্টি মনে করে। এভাবে মানুষে, প্রকৃতিতে তৈরি করে প্রাণ, প্রাণী। অনুমান ভিত্তিক স্বর্গ, নরক, পরলোক, পুনর্জন্মাদি প্রত্যক্ষ প্রমাণাভাবে বাউল আগ্রাহ্য করে। মানুষ ব্যাতিরিক্ত ঈশ্বরও এরা মানে না। সৃষ্টির নিয়মকে জেনে যিনি নিজেকে পরিচালনা করতে শিখেছেন- তিনিই সাঁই। সুস্থ নিরোগ দীর্ঘজীবন এবং আনন্দকে অনুভব করার বাউল সাধনা এক আনন্দমার্গ।।  বাউলরা ভাববাদী না বস্তুবাদী এর অনেক সূক্ষ বিশ্লেষণ শক্তিনাথের বস্তুবাদী বাউল বইটির মধ্যে আলকপাত করা হয়েছে। সাধারণ সমাজে এ ধা...

ভাইবে রাধারমণ

তখন কলেজের ছাত্র। বাংলা বিভাগের প্রভাষক শ্রদ্ধেয় রেজা স্যারের সাথে খুবই ভালো সম্পর্ক। কলেজের প্রথম দিনই স্যারকে খুব পছন্দ। তারপর স্যারের সাথে গল্প, সমাজ, রাজনীতি, সাহিত্য নিয়ে আলোচনা। রীতিমত ফিজিক্স, বায়োলোজি ক্লাস ফাঁকি দিলেও বাংলা ক্লাস কখনই ফাঁকি দিতাম না। খুব উপভোগ করতাম স্যারের ক্লাস। হোস্টেল সুপার হিসেবে স্যার ( ওহী আলম রেজা) আমাদের সাথেই থাকতেন। আমরা আসার প্রায় নয় মাস পর স্যার এলেন সুপার হিসেবে। প্রতিদিন রাতে খাবার পরেই স্যারের রুমে গিয়ে আড্ডা হত, গানের আসর হত। স্যারের পিসিতে প্রায়ই গান শুনতাম আমরা। একদিন হঠাৎ করেই একটি গান স্যার প্লে করলেন 'আমার বন্ধু দয়াময় তোমারে দেখিবার মনে লয়। তোমারে না দেখলে রাধার জীবন কেমনে রয় বন্ধুরে।। কদম ডালে বইসারে বন্ধু ভাঙ্গ কদম্বের আগা। শিশুকালে প্রেম শিখাইয়া যৌবনকালে দাগা রে।। তমাল ডালে বইসারে বন্ধু বাজাও রঙের বাশি। সুর শুনিয়া রাধার মন হইলো যে উদাসি রে।। ভাইবে রাধা রমন বলে মনেতে ভাবিয়া। নিভা ছিল মনের আগুন কে দিলাই জ্বালাইয়া রে।' গানের কথাগুলো বেশ ভালো লেগে গেলো। পুর গানটি শুনে বুঝলাম গানটি সাধক রাধারম...