সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

এ জার্নি বাই ট্রেন: ঢাকা টু সিলেট

সকাল ১১টা। রাজধানীর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের ২নং প্লাটফর্মে দাড়িয়ে আছে ঢাকা থেকে সিলেটগামী জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস ট্রেন। ট্রেন ছাড়ার নির্ধারিত সময় বেলা সোয়া ১১টা। নতুন ঘোষিত সময়সূচি অনুযায়ী ট্রেনটি সিলেটে পৌঁছানোর নির্ধারিত সময় সন্ধ্যা ৭টা। কিন্তু, নির্ধারিত সময়ের ৩৫ মিনিট বিলম্বে কমলাপুর রেলওয়ে ষ্টেশন থেকে ছাড়ে জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস।
স্টেশনের কাউন্টারে বিক্রিত টিকেটের সাথে ট্রেনের একটি কামরার বরাদ্দকৃত সিটের অসামঞ্জস্যতার কারণে ট্রেন ছাড়তে বিলম্ব হয়েছে বলে জানান 'ক' কামরার নিরাপত্তায় থাকা রেলওয়ের পুলিশের সদস্য শান্তি রঞ্জন। ষ্টেশনে ট্রেন পরিচালনার দায়িত্বে থাকা একাধিক ব্যক্তি জানান, বিক্রিত টিকেটের সাথে অসামঞ্জস্যতার বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে এসেছে। ট্রেনে সংযুক্ত ছোট কামরাটি বিচ্ছিন্ন করে টিকেটের সাথে মিল রেখে বড় কামরা সংযুক্তির পর ট্রেন ছাড়ে।
কমলাপুরগামী একটি ট্রেনের চলাচল নির্বিঘ্ন করতে ক্রসিংয়ের জন্য জয়ন্তিকাকে আরও ১০মিনিট অনির্ধারিত বিরতি করতে হলো ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট ষ্টেশনে। দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনে উঠে হিজড়া। নানা ছলাকলা ও কখনোবা হুমকি দিয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিতে শুরু করে তারা। ১০ মিনিট বিরতির পর চলা শুরু করে ট্রেন। বেলা সাড়ে ১২টায় ট্রেনটি পৌছায় ঢাকার বিমানবন্দর রেলওয়ে ষ্টেশনে। এই স্টেশনে যাত্রা বিরতি ছিলো ১০ মিনিট। মাঝখানে আরও একটি ট্রেনকে চলাচলের সুবিধা দিতে আরও ১০ মিনিট থেমে থাকলো জয়ন্তিকা। এরপর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অদূরে আবারও থামানো হলো ট্রেন। এবার অজ্ঞাত কারণে মিনিট পনেরোর বিরতি শেষে ট্রেনটি ছাড়লো সিলেট অভিমুখে। ইতিমধ্যে ট্রেনের ভেতরে ঢুকে পড়ে আরও দুই হিজড়া। শ্রীমঙ্গলের এক যাত্রীসহ কামরায় থাকা আরো কয়েকজন যাত্রীর সাথে এবার বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়ে তারা। এক পর্যায়ে যাত্রীদের গায়েও হাতে তুলে হিজাড়ারা।
পাশের সিটে বসা যাত্রী মৌলভীবাজারের উত্তর কলিমাবাদের বাসিন্দা আশরাফ জাহান ঢাকায় গিয়েছিলেন চাকুরীর পরীক্ষা দিতে। তিনি জানান, হিজড়াদের এসমস্ত যন্ত্রণা সহ্য করেই নিয়মিত পথ চলতে হয় রেলওয়ের যাত্রীদের।
বেলা আড়াইটায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া ষ্টেশনে পৌছায় ট্রেন। ষ্টেশন থেকে ট্রেনটি ছাড়ার পর 'ক' কামরার ৩৪ নম্বর সিট খালি পেয়ে বসে পরেন এক যাত্রী। নিজেকে 'মাষ্টার' পরিচয় দেয়া ওই যাত্রীটি ওই সিটের নির্ধারিত যাত্রীর সাথে সিটে বসা নিয়ে বাদানুবাদে জড়িয়ে পরেন। পরে অন্যান্য যাত্রীদের মধ্যস্থতায় আসনটি ছেড়ে দেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ট্রেনে উঠা ওই যাত্রী। পথ চলতে চলতে বেলা ৩টায় আজমপুর রেলওয়ে ষ্টেশন থেকে ছেড়ে যায় জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস। বিমানবন্দর ষ্টেশন পেরোনোর পর ট্রেনের প্রায় প্রতিটি কামরায়ই আসনবিহীন দাঁড়ানো জনাপঞ্চাশেক যাত্রী। এদের মধ্যে প্রতিটি কামরায়ই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী যাত্রী রয়েছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ষ্টেশন পেরোনোর পর দাঁড়ানো যাত্রী সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে মুকুন্দপুর ষ্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়লে ২মিনিট পরেই ধীরলয়ে চলা শুরু করে। ঝুঁকিপূর্ণ রেলসেতু মেরামতের জন্য ট্রেনটির এই ধীরলয়ে চলা। সেতুটি পেরিয়ে আবারও গতি বাড়লো ট্রেনের।
৩টা ৩৫ মিনিটে ট্রেন পৌছায় হরষপুর ষ্টেশনে। ৫মিনিট পরই ছেড়ে যায় ট্রেন। ৩টা ৪০ মিনিটে মাধবপুরের গাংগাইল এলাকায় ৩মিনিটের জন্য দাঁড়ায় জয়ন্তিকা। সেখান থেকে ছাড়ার মিনিট দুয়েক পর ট্রেন পৌছায় মনতলা ষ্টেশনে। নির্ধারিত বিরতি শেষে আবারও চলা শুরু করে ট্রেনটি। বিকেল ৪টা ২৫মিনিটে নোয়াপাড়া ষ্টেশনে নির্ধারিত বিরতি শেষে ট্রেন আবারও চলা শুরু করে। ট্রেন চলার দীর্ঘ যাত্রায় অন্তত ৩টি স্থানে দেখা মেলে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ রেলসেতু মেরামত কাজের। শাহজিবাজার ষ্টেশনে ট্রেন ৩মিনিট যাত্রা বিরতি শেষে বিকেল ৪টা ৪০ মিনিটে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে আবারও যাত্রা শুরু করে।
বিকেল পৌনে ৫টার দিকে শায়েস্তাগঞ্জ ষ্টেশনের অদূরে ট্রেনের কামরা লক্ষ্য করে ঢিল ছুড়ে মারে অজ্ঞাত দুর্বৃত্ত। এতে আহত হয় ঢাকার একটি বেসরকারি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র মাহিম ও পাশে থাকা যাত্রী আশরাফ। শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে ষ্টেশনের পৌঁছানোর আগে আবারও হিজড়াদের উৎপাত। এবারও যাত্রীদের কাছে টাকার দাবি তাদের। সন্ধ্যা পৌনে ৬টা শ্রীমঙ্গল ষ্টেশন ছেড়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস।
সন্ধ্যা ৬টা ৫ মিনিটে ভানুগাছ ষ্টেশনের আউটারে আবারও ক্রসিংয়ের জন্য ১০ মিনিটের মতো দাঁড়ায় এক্সপ্রেস ট্রেনটি। সেখানে ট্রেন দাঁড়ানো অবস্থায় পাবনার ঈশ্বরদীর সীমান্ত (১০) নামে মাদ্রাসা পড়ুয়া এক ছাত্রের দেখা মেলে। সীমান্তকে পাবনার ট্রেনের বদলে ভুলবশত সিলেটগামী জয়ন্তিকা এক্সপ্রেসে তুলে দেন তার খালা।
সীমান্ত জানায়, সে তার খালার বাড়িতে বেড়াতে ঢাকায় আসছিল। পরে শামীম আহমদ নামে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের এক যাত্রী সীমান্তের পরিবারের সাথে মুঠোফোনে কথা বলেন। তাকে ঢাকায় পৌঁছে দেয়ার আশ্বাস দিয়ে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। অনেকক্ষণ চলার পর সন্ধ্যা ৭টায় মৌলভীবাজারের কুলাউড়া ষ্টেশনে পৌছায় ট্রেনটি। ৫মিনিট বিরতির পর সিলেটের মাইজগাঁও ষ্টেশনের উদ্দেশ্যে আবার যাত্রা করে। জয়ন্তিকা যখন মাইজগাঁও ষ্টেশনে পৌছায় ঘড়ির কাটায় তখন রাত ৭টা ৪০ মিনিট। মিনিট তিনেক মাইজগাঁও ষ্টেশনে বিরতি দিয়ে ট্রেনটি তার সর্বশেষ গন্তব্য সিলেট রেলওয়ে ষ্টেশনের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে।
এইসময়ে ট্রেনের এই কামরাতে বেহালা হতে নিয়ে উঠেন বাউল সবুজ মিয়া। তিনি বেহালায় সুর তুলে গান ধরেন- 'যদি থাকে নসিবে আপনে আপনে আসিবে'। ট্রেনের কামরায় উপস্থিত শ্রোতাদের মনে খানিক সময়ের জন্য আনন্দ যোগায় বাউলের এই গান।
দিনভর ভোগান্তি শেষে নির্ধারিত সময়ের দেড় ঘণ্টারও বেশি সময় পর ট্রেনটি সিলেট রেল ষ্টেশনে পৌছায় রাত ৮টা ২০মিনিটে। এতটা সময় রেলপথ ভ্রমণের ক্লান্তি ভুলে যাত্রীরা নিজ নিজ গন্তব্যের দিকে যে যার মতো চলে যান। ট্রেনটি ষ্টেশনে রয়ে যায় ভিন্ন গন্তব্যের যাত্রীদের অপেক্ষায়।
লিখেছেন-  দেবব্রত চৌধুরী লিটন,আইনজীবী, নাগরিক সাংবাদিক  


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাউল সাধক চান মিয়া এবং আমার কিছু উপলব্ধি

"রজনী হইসনা অবসান  আজ নিশিতে আসতে পারেবন্ধু কালাচাঁন।। কত নিশি পোহাইলোমনের আশা মনে রইলো রে কেন বন্ধু আসিলোনা জুড়ায়না পরান। আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন।। বাসর সাজাই আসার আশেআসবে বন্ধু নিশি শেষে দারূন পিরিতের বিষে ধরিল উজান। আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন।। মেঘে ঢাকা আঁধার রাতে কেমনে থাকি একা ঘরে সাধক চাঁনমিয়া কয় কানতে কানতে হইলাম পেরেশান আজ নিশিতে আসতে বন্দু কালাচাঁন।"    গভীর নিশিতে ধ্যান মগ্ন হয়ে কালাচাঁনের অপেক্ষা করছেন সাধক।  সাধক চান মিয়ার শিষ্য বাউল সিরাজউদ্দিনের মতে এটি একটি রাই বিচ্ছেদ। কৃষ্ণের অপেক্ষায় রাধা নিশি বা রাতকে অনুরোধ করছেন 'রাত' যেন না পোহায়  কারণ তার কালা চান যে কোন সময় আসতে পারে। শব্দগুচ্ছ গুলো থেকে সহজেই উপলব্ধি হয় সাধক নিজ দেহকে রাধা আর আত্মাকে কৃষ্ণের সাথে তুলনা করেছেন। দেহ আত্মার মিলন ঘটানোই ছিল সাধকের সাধনা।        বাউল সাধক চান মিয়া উপরোক্ত গানটি রচনা করেছেন। নেত্রকোনা জেলার খাটপুরা গ্রামে ১৩২৫ বঙ্গাব্দে সাধক চান মিয়ার জন্ম। পুরো নাম চান্দেজ্জামান আকন্দ হলেও বা...

বাউল, বাউলতত্ব এবং কিছু কথা

একজন ভদ্র বন্ধু বরের সাথে বাউল সম্প্রদায় নিয়ে বেশ তর্ক হলো রাতে। তর্কের সূত্রপাত ছিল বাউলরা ভাববাদী না বস্তুবাদী। ভাবলাম "বাউলতত্ত্ব"র আলোকে বাউলরা ভাববাদী নাকি বস্তুবাদী তা নিয়ে যৌক্তিক আলোচনা আবশ্যম্ভাবী। কয়েকটি ধারাবাহিক পর্ব লিখে নিজের মনোভাব বোঝানোর চেষ্টা করব।  শুরুতেই শক্তিনাথ ঝাঁ এর বস্তুবাদী বাউল বই থেকে কিছু কথা লিখতে চাই; বাস্তব জগত ও জীবনকে এরা কোন আনুমানিক যুক্তি বা আলৌকিক যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে নারাজ। জৈব রাসায়নিক ব্যাখায় এরা নারীর রজঃ এবং পুরুষের বিজে জীবন ও জগত সৃষ্টিকে ব্যাখা করে এবং চার ভূতকে প্রাকৃতিক সৃষ্টি মনে করে। এভাবে মানুষে, প্রকৃতিতে তৈরি করে প্রাণ, প্রাণী। অনুমান ভিত্তিক স্বর্গ, নরক, পরলোক, পুনর্জন্মাদি প্রত্যক্ষ প্রমাণাভাবে বাউল আগ্রাহ্য করে। মানুষ ব্যাতিরিক্ত ঈশ্বরও এরা মানে না। সৃষ্টির নিয়মকে জেনে যিনি নিজেকে পরিচালনা করতে শিখেছেন- তিনিই সাঁই। সুস্থ নিরোগ দীর্ঘজীবন এবং আনন্দকে অনুভব করার বাউল সাধনা এক আনন্দমার্গ।।  বাউলরা ভাববাদী না বস্তুবাদী এর অনেক সূক্ষ বিশ্লেষণ শক্তিনাথের বস্তুবাদী বাউল বইটির মধ্যে আলকপাত করা হয়েছে। সাধারণ সমাজে এ ধা...

ভাইবে রাধারমণ

তখন কলেজের ছাত্র। বাংলা বিভাগের প্রভাষক শ্রদ্ধেয় রেজা স্যারের সাথে খুবই ভালো সম্পর্ক। কলেজের প্রথম দিনই স্যারকে খুব পছন্দ। তারপর স্যারের সাথে গল্প, সমাজ, রাজনীতি, সাহিত্য নিয়ে আলোচনা। রীতিমত ফিজিক্স, বায়োলোজি ক্লাস ফাঁকি দিলেও বাংলা ক্লাস কখনই ফাঁকি দিতাম না। খুব উপভোগ করতাম স্যারের ক্লাস। হোস্টেল সুপার হিসেবে স্যার ( ওহী আলম রেজা) আমাদের সাথেই থাকতেন। আমরা আসার প্রায় নয় মাস পর স্যার এলেন সুপার হিসেবে। প্রতিদিন রাতে খাবার পরেই স্যারের রুমে গিয়ে আড্ডা হত, গানের আসর হত। স্যারের পিসিতে প্রায়ই গান শুনতাম আমরা। একদিন হঠাৎ করেই একটি গান স্যার প্লে করলেন 'আমার বন্ধু দয়াময় তোমারে দেখিবার মনে লয়। তোমারে না দেখলে রাধার জীবন কেমনে রয় বন্ধুরে।। কদম ডালে বইসারে বন্ধু ভাঙ্গ কদম্বের আগা। শিশুকালে প্রেম শিখাইয়া যৌবনকালে দাগা রে।। তমাল ডালে বইসারে বন্ধু বাজাও রঙের বাশি। সুর শুনিয়া রাধার মন হইলো যে উদাসি রে।। ভাইবে রাধা রমন বলে মনেতে ভাবিয়া। নিভা ছিল মনের আগুন কে দিলাই জ্বালাইয়া রে।' গানের কথাগুলো বেশ ভালো লেগে গেলো। পুর গানটি শুনে বুঝলাম গানটি সাধক রাধারম...