বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বেশকিছু কালজয়ী উপন্যাস রচনার মাধ্যমে তিনি জয় করে নিয়েছেন বাংলাভাষী পাঠকের হ্রদয়। শুধু উপন্যাস রচনাই নয় ছোটগল্প রচনায়ও সমান দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
গ্রামীণ জীবন ও প্রকৃতি, মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক, মানুষের সাথে প্রকৃতির সম্পর্ক তাঁর রচনার উপজীব্য বিষয়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদার মানবিক বোধের গল্পগুলোর মধ্যে 'অাহবান' বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
হিন্দু- মুসলিম ঐক্যের এক অনন্য ভাষ্য 'অাহবান' গল্প। সহজ সরল অাখ্যানভাগ সংবলিত এ গল্পের অসাধারণত্ব এর অন্তর্নিহিত মানবিক রস।
সম্পর্কের বাধনে ভিন্নধর্মের মানুষের মধ্যেও যে নিবিড় অাত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে তার উত্তম উদাহরণ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'অাহবান' ছোটগল্প।
একজন মুসলিম দরিদ্র বুড়ির স্নেহছায়ায় একজন হিন্দু যুবককে সন্তানের অাসন দিয়েছে। বুড়ি এখানে হয়ে উঠেছেন চিরায়ত মা। গল্পের শেষে বুড়ির দাফনের মধ্যদিয়ে সাম্প্রদায়িক চেতনার কবর রচিত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণ চিন্তার মূলে কুঠারাঘাত করার জন্য এ ধরনের গল্পের মূল্য অনন্য।
বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে অবিভক্ত বাংলার সহজ সরল গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে গল্পের কাহিনি রচিত হয়েছে। গল্পের প্রধান চরিত্র গোপাল একজন হিন্দু ধর্মাবলম্ভী শিক্ষিত তরুণ। তিনি শহরে বাস করেন। গ্রামে তাঁর কোনো ঘর নেই। পৈতৃক ভিটা খালি পড়ে অাছে। ছুটিতে তিনি বাড়ি অাসেন। গ্রামে হাটতে গিয়ে অাম বাগানে এক বুড়ির সাথে দেখা হয়। বুড়ি জাতিতে মুসলমান। কিন্তু বুড়ি তাকে ছেলের মতো ভালোবেসে ফেলে। যখনই গোপাল বাড়ি অাসেন তখনই বুড়ির খোজ খবর নেন। টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করেন।
বুড়িও খাবারদাবার ফলমূল, এটাওটা নিয়ে গোপালকে দেখতে যান। এক সময় অসুস্থ বুড়ি তাঁর মৃত্যুর পর গোপালকে কাফনের কাপড় দিতে বলেন।
শেষবার গোপাল যখন গ্রামে অাসেন তার অাগের দিন বুড়ি মারা যান। অনেকেই মনে করেন বুড়ির মাতৃস্নেহের টানেই গোপাল ফিরে এসেছেন।
গোপাল বুড়ির কাফনের কাপড়ের জন্য টাকা দেন।
মুসলিম রীতি অনুযায়ী বুড়িকে কবর দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
শরতের কটুতিক্ত গন্ধ ওঠা বনঝোপ ও মাকাল লতা দোলানো একটা প্রাচীন গাছের তলায় বৃদ্ধাকে কবর দেওয়া হচ্ছে। গোপাল গিয়ে বসলো ছোটবেলার সহপাঠী অাবদুল, শুকুর মিয়া, নসরের পাশে। অাবদালি তার ছেলে গনি এরা সকলে গাছের ছায়ায় বসে।
শুকুর মিয়া গোপালকে বললো, এই যে বাবা, এসো। বুড়ির মাটি দেওয়ার দিন তুমি কনে থেকে এলে, তুমিতো জানতে না? তোমায় যে বড্ড ভালোবাসতো বুড়ি।
দুজন জোয়ান ছেলে কবর খুড়ছে। কবর দেওয়ার পর সকলে এক এক কোদাল মাটি দিল কবরের উপর। শুকুর মিয়া গোপালকে ইঙ্গিত করে বললো, দ্যাও বাবা তুমিও দাও। গোপাল এক কোদাল মাটি দিল।
গোপালের মনে হল, ও বেঁচে থাকলে বলে উঠতো, অ মোর গোপাল।
লেখকঃঅহী আলম রেজা, প্রভাষক, সাংবাদিক
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন