প্রসঙ্গ হচ্ছে কালো না সফেদ, নারীর গায়ের রঙ না পুরুষের গায়ের রঙ, সুন্দর নাকি অসুন্দর? আমি যদি আমাকে এই প্রশ্ন করি তবে উত্তর আমি নিজেই দেবো পৃথিবীর রঙটাই সুন্দর।
মানুষের গায়ের চামড়া বা রঙ নিয়ে বৈষম্য সেই আদিকাল থেকেই। এখানে কে লম্বা কে বেটে, কার রঙ কেমন, কে কোন জাতের ইত্যাদি প্রথা বিভিন্ন সময়, যুগ এবং কালে মানুষের মধ্যে ছিল৷ যুগে যুগে কাঠামো উন্নত হয়েছে সমাজের কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি অনেক ক্ষেত্রেই আমরা সেই দেড় হাজার বা তার আগের যুগের মতই রয়ে গেছে৷ উইকিপিডিয়া থেকে সরাসরি যদি প্রাচীন ভারতের বর্ণপ্রথার ইতিহাস তুলে ধরি, তবে বলতে হবে,
ভারতে বর্ণপ্রথা হলো জাতি এর উপমূর্তিগত উদাহরণ। প্রাচীন ভারতে এর উৎস রয়েছে এবং মধ্যযুগীয়, আদি-আধুনিক, এবং আধুনিক ভারতে বিশেষত মোগল সাম্রাজ্য এবং ব্রিটিশ রাজের বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠী দ্বারা এটি রূপান্তরিত হয়েছিল। এটি আজ ভারতে শিক্ষাগত এবং চাকরি সংরক্ষণ এর একটি ভিত্তি হিসেবে রয়ে গেছে। বর্ণপ্রথা দুটি পৃথক ধারণা নিয়ে গঠিত, এগুলি হলোবর্ণ এবং জাতি যা এই পদ্ধতির বিশ্লেষণের বিভিন্ন স্তরের দিক হিসাবে বিবেচিত হতে পারে।
গান্ধী ১৯৩৩ সালে দলিত (তিনি হরিজনকে ব্যবহার করেছেন) কারণে ভারতব্যাপী সফরে মাদ্রাজে (বর্তমানে চেন্নাই) গিয়েছিলেন। এ জাতীয় সফরের সময় তাঁর বক্তৃতাগুলিতে তিনি ভারতের বর্ণ-বৈষম্যমূলক বিষয়ে আলোচনা করতেন।
বর্তমানে যে জাতি বর্ণ রয়েছে তা মুঘল যুগের পতনের সময়কার উন্নয়ন এবং ভারতেব্রিটিশ উপনিবেশিক সরকার এর উত্থানের ফলাফল বলে মনে করা হয়। মোগল যুগের পতন দেখে কিছু প্রভাবশালী জাতির উত্থান ঘটেছিল যারা নিজেদেরকে রাজা, পুরোহিত এবং তপস্বীদের সাথে যুক্ত করেছিল, যা জাতিগত আদর্শের নিয়মিত ও সামরিক রূপকে নিশ্চিত করে, এবং এটি অনেকগুলি দৃশ্যত বর্ণহীন সামাজিক গোষ্ঠীগুলিকে পৃথক পৃথক জাতের সম্প্রদায়ের মধ্যে রূপ দিয়েছে। কঠোর বর্ণবাদী সংগঠনকে প্রশাসনের কেন্দ্রীয় মেকানিজম হিসাবে পরিণত করে ব্রিটিশ রাজ এই বিকাশকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল।১৮৬০ এবং ১৯২০ এর মধ্যে ব্রিটিশরা ভারতীয়দেরকে বর্ণ দ্বারা বিচ্ছিন্ন করে প্রশাসনিক চাকরি দেয় এবং কেবলমাত্র খ্রিস্টান এবং নির্দিষ্ট জাতের লোকদের জন্য তারা উচ্চপদস্থ নিয়োগ দিয়েছিলো।১৯২০ এর দশকে সামাজিক অস্থিরতা এই নীতিতে পরিবর্তনের দিকে পরিচালিত করেছিল।এর পর থেকে উপনিবেশিক প্রশাসন একটি নির্দিষ্ট শতাংশ সংরক্ষণ করে বিভাজনমূলক ও ইতিবাচক বৈষম্যের নীতি শুরু করে নিচু জাতের লোকদের চাকরি দিতো। ১৯৪৮ সালে বর্ণের ভিত্তিতে নেতিবাচক বৈষম্য আইন দ্বারা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এবং আরও কিছু আইন ভারতীয় সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, তবে এই পদ্ধতিটি ভারতে ধ্বংসাত্মক সামাজিক প্রভাব সহ এখনও চালু রয়েছে।
নেপালি বৌদ্ধধর্মের মতো ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চল এবং ধর্মগুলিতেও বর্ণ ভিত্তিক পার্থক্য অনুশীলিত হয়েছে,খ্রিস্টান ধর্ম, ইসলাম, ইহুদী ধর্ম এবং শিখ ধর্ম। বহু সংস্কারবাদী হিন্দু আন্দোলন দ্বারা এটিকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছে,ইসলাম, শিখ ধর্ম, খ্রিস্টান,এবং বর্তমান ভারতীয় বৌদ্ধধর্ম দ্বারাও।
এ'ত গেলো প্রাচীন ভারতের বর্ণপ্রথার ইতিহাস। আসি বর্তমান আমাদের সময়ের কিছু বর্ণপ্রথা নিয়ে, যেখানে নারীরা আক্রান্ত সবচেয়ে বেশি। আমাদের গ্রাম্য এমনকি শহুরে সমাজে একটি ব্যবস্থা এখনো প্রচলন আছে- কোথাও বিয়ের আলাপে যদি পাত্রপক্ষ কনে পক্ষের বাড়িতে যান তাহলে প্রথমে গিয়েই মেয়ের গায়ের রঙ পরীক্ষে করা শুরু করে দেন। আমি আমার পরিবারের নানী দাদী বা বড় নানীদের ক্ষেত্রে এমন দেখেছি। তারা মনে করেন মেয়ে যদি ফর্সা হয় বা সফেদ হয় তাহলে হয়তো পরবর্তী প্রজন্ম সাদা বা ফর্সা গড়নের হবে। এটা সম্পূর্ণভাবে একটি বর্ণবাদী প্রথা যেটিকে বিজ্ঞান একদম নাকচ করে দেয়। সোজা বাংলায় বলতে গেলে, বা মায়ের ক্রোমোজমের উপর ভিত্তি করে সন্তানরা গায়ের রঙ পায়। এই রঙ কখনো সাদা সাদা মিলে ক্রোমোজমগত কারণে কালো হতে পারে, কালো কালো কিলে সাদা হতে পারে, বা সাদা কালো মিলে শ্যামবর্ণ এমনকি পিৎ বর্ণ হতে পারে।
উদাহরণ স্বরূপ বলি, প্রতিদিন কাজের ক্ষেত্রে অনেকপরিবারের সাথে দেখা হয় আমার। দেখা যায় বাবা আফ্রিকান কালো বর্ণের, মা ইউরোপিয়ান সাদা বর্ণের টুকটুকে মেয়েটা হয়েছে ঝলমলে চিকচিক করা কালো বর্ণের। মানে ক্রোমোজম বা জিনগত বাবার ব্যাপার টা পেয়েছে। আবার দেখা যায় মা আফ্রিকান বা বাবা এরাবিয়ান কোন দেশের লোক সন্তান হয়েছে পুরো লাল টুকটুকে ইউরোপিয়ান৷ দুটোই ত সুন্দর। কোনজন ঝলমলে, কোনজন টুকটকে। যা বলছিলাম আমাদের দেশে এই প্রথাটা বিয়ের সময় এখনো রয়েই গেছে। আবার দেখেছি, অনেক ক্ষেত্রে ছেলে পক্ষের ক্ষেত্রে কনে পক্ষে যায় লম্বা গড়নের ছেলে। তার মানে এখানেও বর্ণবাদ, বেটে মানুষজন নাকি অলক্ষ্মী হয় এমন ধরনের লম্বা কুসংস্কার এখনো চলোমান।
ছোটবেলা থেকেই আমি চাবাগান প্রেমী মানুষ। চা বাগানের মানুষজন বিশেষ করে চা শ্রমিকদের দেহের রঙ কালো। ভারতের আসাম উড়িষ্যা মাদ্রাজ থেকে আসা এসব আদিলোকজনের বর্ণ অঞ্চলগত ভাবেই কালো। কিন্তু রঙের কারণে এখনো তারা 'কুলি' বলে আখ্যায়িত হোন, যাদেরকে ছোটজাত বলে ঘৃণার চোখে দেখা হয়। একধরনের অসভ্য নোংরামি বর্ণবাদ প্রচলন নাগরিক সমাজ থেকে গিয়ে ঘায়েল করে চা শ্রমিকদের।
যাই হোক কালো ধলো আসলে উঠে আসে বর্ণবাদ নামক একটি বিব্রতকর শব্দ যা আজও লুকিয়ে আছে আমার বা আপনার সুপ্ত ইচ্ছা বা চিন্তায়। লিখা না বাড়িয়ে পরিসংহারে এটিই কথা আমার কাছে মহামূল্যবান - 'কালো সুন্দর ধলো সুন্দর, শ্যাম সুন্দর শ্যামলী সুন্দর, সুন্দর পৃথিবীর রঙ'।
লিখেছেন - চৌধুরী মারূফ, সাংবাদিক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন