সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ঈদের একাল সেকাল

 মধ্য পরিবারের ঈদ আমাদের অন্যরকম কিন্তু গতানুগতিক।  অন্যরকম এই কারণেই বললাম আমাদের যারা বাঙ্গালি মুসলমান পরিবারে জন্ম,  বেড়ে ওঠা আমরা সারাজীবন'ই দেখেছি পুরো রোজা মাস আমাদের পরিবারগুলোতে একরকম উৎসবের আমেজ থাকে যার মূল কেন্দ্র বিন্দু হচ্ছে ঈদ। সাধ্যমত আনন্দ ভাগাভাগি করাটা একধরনের সুখ৷ এই কারণেই সেটা অন্যান্য সময়ের তুলনায় অন্যরকম। আবার গতানুগতিক এই কারণেই বললাম আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবার গুলোতে আয় সীমিত,  সারা বছর যা আয় হয় সেটা রোজা মাসেও হয়, সুতরাং সেই আয় থেকে উৎসবের যোগান দিতে হয়।  

মধ্যবিত্ত পরিবারে আমার জন্ম বেড়ে উঠা হলেও কখনো অভাব দেখিনি। এটা হয়ত প্রকৃতির দয়া, দোয়া বা আশীর্বাদ।  আবার পূর্বপুরুষের কর্মফসল হতে পারে। বাবা মা দুজন চাকরির সুবাদে বেশ ভালো ভাবেই বড় হয়েছে। দুজনের একজনও কখনো আমাদের দুইভাইকে অভাব দেখতে দেন নি। আয় ইনকামে বেশ ভালো ভাবেই চলেছে। বাবা সত্তর দশক থেকেই ছাত্র রাজনীতি মা আশির দশকে টুকটাক করেছেন। দাদা বা নানাও সরকারী চাকুরীজীবী ছিলেন, যুদ্ধ করেছেন অনেকেই ভাবেন যে হয়তো রাজনীতির কারণে অনেক ব্যবসা আছে,  তা মোটেও নয়। পারিবারিক সূত্রে মুটামুটি যা ছিল তাই। আসলে ঈদের কথা বলছিলাম। আমার বাবাকে আমি সারাজীবন দেখেছি ঈদের সময় আঁট থেকে দশ হাজার আমার হাতে গুঁজ এ দিয়ে বলতেন যা ইচ্ছা তা কিনে নিও। আমার বাবা আমাকে কখনো টাকা দিয়ে বলতেন না কি করতেন, তবে উনার নজর রাখতেন। এটা বাবার কাছ থেকে পাওয়া সম্মান আবার নজরদারিও,  দুটোই। মায়ের কাছ থেকে যা নিতে পারি, এটা কখনো ১ হাজার কখনো দশ হাজার ও। আমি অবশ্য সৌখিন জিনিস কিনেই টাকা খরচ করেছি বেশি। এটা যে খুব দামী কাপড় বা মোবাইল তা নয়, যেমন একটা ফুলের টব কিনে ফেলেছি দুইহাজার দিয়ে, ১ প্যাকেট বিদেশি সিগারেট কিনে ফেলেছি ৪ শ টাকা দিয়ে এমন টাইপ। তবে মায়ের কাছ থেকে সবসময় পাঞ্জাবি পেয়েছি, এটা নিয়মিত এবং এখনো প্রচলিত। 

আমার ছোট ভাইয়ের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আবার ভিন্ন। তার ইচ্ছা চাহিদা বিংশ শতাব্দির। বাসার একমাত্র ছোট মানুষ সে, আমরা তিনজন তার মাথার উপর ছায়া, তাই কখনোই আমি ব্যক্তিগত ভাবে লাগাম টানিনা খরচের ব্যাপারে।  সবসময়ই ভাবে বেড়াই একটাই ত ভাই করে ফেলুক। 


আমাদের সিলেট অঞ্চলে ঈদ মানেই চই পিঠা (চালের গুড়া দিয়ে মেখে ম্যারা পিঠা), হান্দেশ (তেলের পিঠা), নুনের পিঠা (লবণ,  আদা দিয়ে তৈরি করা),পব (নারিকেল পেস্ট রুটি দিয়ে করা) ইত্যাদি। ছোট বেলায় সবসময় দেখতাম মা বাসায় আসা চা বাগানের রংগিলা খালাকে দিয়ে চালের গুড়া করে এসব করাতেন। ঘাইল ছিয়া (চাল ভাংগার হাতের যন্ত্র) এসব করাতেন। দুইহাজার দশ সালের পর অবশ্য তা মিশিনে নিয়ে যেতেন।  সেকালের ঈদ ছিল অন্যরকম অদ্ভুদ সুন্দর। ছোট্ট করে লিখলাম অন্য সময় আরও বিশদ লিখব। 

দিন গড়াচ্ছে, মাথার চুলও এক দুইটা সাদা হচ্ছে দুই মাস ধরে। ঈদ গুলোও এখন মলিন। বিদেশ বিভুইয়ে থাকা আমরা দেশের আঙিনায় ঘুরি চোখের নজরে।  রোজা আসার আগেই মাথায় চিন্তা থাকে বাসায় কত পাঠাবো এবার। আমার ব্যক্তিগত ভাবেই বলছি আমি না পাঠালেও আমার বাসার সবাই স্বচ্ছল,  কিন্তু একটা আবেগ কাজ করে। আমরা যারা বাহিরে থাকি সবারই এমন। অল্প কিছু পাঠালে যেন নিশ্বাস ফিরে পাই। ঈদ তাই পরিবর্তন হয়ে গেছে। একসময় অন্যের দায়িত্বে থেকে বাহানার শেষ ছিল না, এখন নিজের দায়িত্বে। একাএকা যখন থাকি চিন্তা করি বাবা মা কিভাবে যে বড় করেছেন। দুইটাকা যদি কাউকে দেয়ার চিন্তা করি, ভাবি ইস আমার বাগানের একটা লোককে দেই, বা নিরীহ একজন মানুষকে দেই। এটা গৌরব বা শান বা প্রচার নয়, নিজের মধ্যে একধরনের সুখ হয়, যখন কল দিয়ে কেউ বলে 'ভাই পাইসি'৷ দিনের কালে সময় বদলায়, ঈদ বদলায়, দায়িত্ব বাড়ে। 

আমাদের মধ্যবিত্ত জীবন এমন।  এটাই আমাদের উৎসব। দয়া করে কথাগুলো অর্থনৈতিক মানদন্ডে নেবেন না। মনের কথাগুলো শেয়ার করা। এটাই উৎসবের আমেজ।





লিখেছেনঃ চৌধুরী মারূফ, সাংবাদিক, ব্লগার

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাউল সাধক চান মিয়া এবং আমার কিছু উপলব্ধি

"রজনী হইসনা অবসান  আজ নিশিতে আসতে পারেবন্ধু কালাচাঁন।। কত নিশি পোহাইলোমনের আশা মনে রইলো রে কেন বন্ধু আসিলোনা জুড়ায়না পরান। আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন।। বাসর সাজাই আসার আশেআসবে বন্ধু নিশি শেষে দারূন পিরিতের বিষে ধরিল উজান। আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন।। মেঘে ঢাকা আঁধার রাতে কেমনে থাকি একা ঘরে সাধক চাঁনমিয়া কয় কানতে কানতে হইলাম পেরেশান আজ নিশিতে আসতে বন্দু কালাচাঁন।"    গভীর নিশিতে ধ্যান মগ্ন হয়ে কালাচাঁনের অপেক্ষা করছেন সাধক।  সাধক চান মিয়ার শিষ্য বাউল সিরাজউদ্দিনের মতে এটি একটি রাই বিচ্ছেদ। কৃষ্ণের অপেক্ষায় রাধা নিশি বা রাতকে অনুরোধ করছেন 'রাত' যেন না পোহায়  কারণ তার কালা চান যে কোন সময় আসতে পারে। শব্দগুচ্ছ গুলো থেকে সহজেই উপলব্ধি হয় সাধক নিজ দেহকে রাধা আর আত্মাকে কৃষ্ণের সাথে তুলনা করেছেন। দেহ আত্মার মিলন ঘটানোই ছিল সাধকের সাধনা।        বাউল সাধক চান মিয়া উপরোক্ত গানটি রচনা করেছেন। নেত্রকোনা জেলার খাটপুরা গ্রামে ১৩২৫ বঙ্গাব্দে সাধক চান মিয়ার জন্ম। পুরো নাম চান্দেজ্জামান আকন্দ হলেও বা...

বাউল, বাউলতত্ব এবং কিছু কথা

একজন ভদ্র বন্ধু বরের সাথে বাউল সম্প্রদায় নিয়ে বেশ তর্ক হলো রাতে। তর্কের সূত্রপাত ছিল বাউলরা ভাববাদী না বস্তুবাদী। ভাবলাম "বাউলতত্ত্ব"র আলোকে বাউলরা ভাববাদী নাকি বস্তুবাদী তা নিয়ে যৌক্তিক আলোচনা আবশ্যম্ভাবী। কয়েকটি ধারাবাহিক পর্ব লিখে নিজের মনোভাব বোঝানোর চেষ্টা করব।  শুরুতেই শক্তিনাথ ঝাঁ এর বস্তুবাদী বাউল বই থেকে কিছু কথা লিখতে চাই; বাস্তব জগত ও জীবনকে এরা কোন আনুমানিক যুক্তি বা আলৌকিক যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে নারাজ। জৈব রাসায়নিক ব্যাখায় এরা নারীর রজঃ এবং পুরুষের বিজে জীবন ও জগত সৃষ্টিকে ব্যাখা করে এবং চার ভূতকে প্রাকৃতিক সৃষ্টি মনে করে। এভাবে মানুষে, প্রকৃতিতে তৈরি করে প্রাণ, প্রাণী। অনুমান ভিত্তিক স্বর্গ, নরক, পরলোক, পুনর্জন্মাদি প্রত্যক্ষ প্রমাণাভাবে বাউল আগ্রাহ্য করে। মানুষ ব্যাতিরিক্ত ঈশ্বরও এরা মানে না। সৃষ্টির নিয়মকে জেনে যিনি নিজেকে পরিচালনা করতে শিখেছেন- তিনিই সাঁই। সুস্থ নিরোগ দীর্ঘজীবন এবং আনন্দকে অনুভব করার বাউল সাধনা এক আনন্দমার্গ।।  বাউলরা ভাববাদী না বস্তুবাদী এর অনেক সূক্ষ বিশ্লেষণ শক্তিনাথের বস্তুবাদী বাউল বইটির মধ্যে আলকপাত করা হয়েছে। সাধারণ সমাজে এ ধা...

ভাইবে রাধারমণ

তখন কলেজের ছাত্র। বাংলা বিভাগের প্রভাষক শ্রদ্ধেয় রেজা স্যারের সাথে খুবই ভালো সম্পর্ক। কলেজের প্রথম দিনই স্যারকে খুব পছন্দ। তারপর স্যারের সাথে গল্প, সমাজ, রাজনীতি, সাহিত্য নিয়ে আলোচনা। রীতিমত ফিজিক্স, বায়োলোজি ক্লাস ফাঁকি দিলেও বাংলা ক্লাস কখনই ফাঁকি দিতাম না। খুব উপভোগ করতাম স্যারের ক্লাস। হোস্টেল সুপার হিসেবে স্যার ( ওহী আলম রেজা) আমাদের সাথেই থাকতেন। আমরা আসার প্রায় নয় মাস পর স্যার এলেন সুপার হিসেবে। প্রতিদিন রাতে খাবার পরেই স্যারের রুমে গিয়ে আড্ডা হত, গানের আসর হত। স্যারের পিসিতে প্রায়ই গান শুনতাম আমরা। একদিন হঠাৎ করেই একটি গান স্যার প্লে করলেন 'আমার বন্ধু দয়াময় তোমারে দেখিবার মনে লয়। তোমারে না দেখলে রাধার জীবন কেমনে রয় বন্ধুরে।। কদম ডালে বইসারে বন্ধু ভাঙ্গ কদম্বের আগা। শিশুকালে প্রেম শিখাইয়া যৌবনকালে দাগা রে।। তমাল ডালে বইসারে বন্ধু বাজাও রঙের বাশি। সুর শুনিয়া রাধার মন হইলো যে উদাসি রে।। ভাইবে রাধা রমন বলে মনেতে ভাবিয়া। নিভা ছিল মনের আগুন কে দিলাই জ্বালাইয়া রে।' গানের কথাগুলো বেশ ভালো লেগে গেলো। পুর গানটি শুনে বুঝলাম গানটি সাধক রাধারম...