সাংবাদিকতা শুধু পেশা নয় এটি একটি আমার মুক্ত আকাশ। পেশাগত, দায়িত্বগত, বন্ধুত্বগত কারণে সাংবাদিক বন্ধু বান্ধবী আমার বেশি। আমার খুব কাছের বন্ধুরা অনেকেই সাংবাদিক। ২০১৫ সালের ঘটনা, ব্লগিং এর পাশাপাশি যখন প্রোফেশনাল সাংবাদিকতা শুরু করি তখন একটি এসাইনমেন্টের কাজে একজন বান্ধবী সাংবাদিকের সাথে যাচ্ছিলাম সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলায়। বাসে করেই যাবও আমাদের সিধান্ত। যেতে যেতে অনেক গল্প হলো, পেশাগত কথাও হলো। আমার বান্ধবী বলেছিলো পেশাগত দায়িত্ব পালনে কতটুকু নাজেহাল হতে হয় নারী সাংবাদিকের। যেমন, ফুটেজ নেওতার জন্য ভীড়ে যেতে হয়, সেখানে ইচ্ছাকৃত ভাবে অনেকেই শারিরিক ভাবে তাদের লাঞ্চিত করেন। আমার কোন কারণে কোন নিউজ বিটের সংশ্লিষ্ট বক্তব্য দিতে গিয়ে যদি মহিলা কণ্ঠ শুনেন, তখন দেখা যায় হাস্যরস করে বিনোদন পাতার রিপোর্টার বলে রম্য করেন। আমার প্রশ্ন হচ্ছে বিনোদন বিট কি নিউজ বিটের বাহিরে, নাকি কোন নারী অন্য বিটের প্রতিবেদক হওয়ার যোগ্যতা রাখেন না? নাকি বিনোদন বিট মানেই নারী সাংবাদিক?
এই প্রশ্ন গুলো আমাকে অনেক ভাবায়! যাই হোক যা বলেছিলাম, ঐ বান্ধবীর কথা বলার সময় তিনি জানিয়েছিলেন, হবিগঞ্জের দৈনিক পত্রিকায় কাজ করার সময় বিভিন্ন ইস্যু তুলে ধরলে বিভিন্ন ভাবে নাজেহাল হতে হয়েছে, ছোট একটা নাজেহাল'ই বলি, রাস্তায় চলার সময় অনেকেই বলে 'ঐ দেখ বেটার মত বেটি সাংবাদিক যার'। তার মানে একজন নারীকে এই পেশায় যেমন অপদস্ত করা হয়, ঠিক তেমনি ড্রেস কোড নিয়ে।
আসি অন্য কথায়, বেশ আগে একজন সিলেটের নারী ফটোগ্রাফার ফুটেজ নিচ্ছিলেন কোন এক মিছিলের। উনার নামটা এই মুহুর্তে মনে নেই। আমিও তখন সেই স্পটে। মনে হয় পরিবহন শ্রমিকদের ধর্মঘট ছিল। এমন ব্যবহার উনার সাথে সেই সময় পরিবহন শ্রমিকরা করলো যে একজন নারী ক্যামেরা পার্সন হতে পারবেনা।
এবার সমসাময়িক কিছু চিত্র তুলে ধরি। একজন সাহসী নারী সাংবাদিকের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, তাকে স্যালুট ও জানাই। ঘটনা ভারতের, কেরালার কৈরালি টিভি চ্যানেলের চিত্র সাংবাদিক শাজিলা আব্দুর রহমান। এই কেরালায় শবরীমালা মন্দিরে নারী প্রবেশ নিয়ে চলছে ব্যাপক বিক্ষোভ। প্রতিবাদ-বিক্ষোভে উত্তাল গোটা রাজ্য। হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো ১২ ঘণ্টার বন্ধের ডাক দিয়েছিল রাজ্যে। আর সেই ঘটনার ফুটেজ ও ছবি আনতে গিয়েছিলেন তিনি। পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত যে, সংবাদমাধ্যমও বাদ যায়নি বিক্ষোভকারীদের তাণ্ডব থেকে। শাজিলা আব্দুল রহমানও এই তাণ্ডবের শিকার হন।এই নারী সাংবাদিক যখন ভিডিও করছিলেন তখন তার উপর হামলা করে বিক্ষোভকারী। তাকে কিল-ঘুসি, চড় মারা হয়। শুধু তাই নয়, হেনস্তাও করা হয়। নির্যাতনের কারণে তাকে কাঁদতে দেখা যায়। কিন্তু তিনি কাঁধ থেকে ক্যামেরা সরাননি। হিন্দুত্ব বাদী দের তান্ডবের শিকার হয়েছিলেন তিনি।
এবার আসি বাংলাদেশে। ২০১৩ সাল, উত্তাল ঢাকার রাজপথ, হেফাজত ইসলামের সমাবেশ চলছে।একুশে টেলিভিশনের সাংবাদিক নাদিয়া শারমিনের ওপর হামলা নয়৷ আরো ৩ জন নারী সাংবাদিককে লাঞ্ছিত করা হয়েছে হেফাজতের সমাবেশে৷ তাদের হামলার শিকার হয়েছেন নারীসহ অন্তত ১৫ জন সাংবাদিক৷ এসবের সুরাহা এখনোও হয়নি। কিছুদিন আগেও কুষ্টিয়ায় পুলিশ সুপারের প্রেস কনফারেন্সের সময় সেইখানে থাকা অন্য এক সাংবাদিক মাহতাব উদ্দিন লালনের হামলায় আহত হয়েছেন আফরোজা আক্তার ডিউ।
গত ২০১৭ সালে ইভটিজিং এর প্রতিবাদ করায় একজন বেসরকারী টিভি চ্যানেলের নারী সাংবাদিক লাঞ্চিত হয়েছেন। ঢাকার মিরপুর ১০ গ্যালাক্সি ভবনের সামনের ঘটনা এটি। গত বছরের মার্চ মাসের ২০ তারিখ মাদারিপুরের এলজিইডি অফিসের এক আমলা সাবরিন মেরিন নামের এই প্রতিবেদকের উপর হামলা করেন, তিনি আজকের বিজনেস বাংলাদেশ দৈনিকের প্রতিবেদক। এবার আসি সিলেটের ঘটনা নিয়ে। গত ২০১৯ সালের জুলাই মাসে হামলা হয় বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আই’র ক্যামেরাপার্সন ও দৈনিক সবুজ সিলেটের সিনিয়র রিপোর্টার সুবর্ণা হামিদের উপর। জুয়া এবং মাদক ব্যবসা নিয়ে প্রতিবেদনের কারণে তার বাসায় হামলা হয়। তার স্বামীও আহত হয়েছিলেন সেই হামলা।
এসব হচ্ছে ঘটনা প্রবাহ। এসব ঘটনা বলতে গেলে শেষ হবেনা। সর্বশেষ গতকাল আক্রান্ত প্রথম আলো রোজিনা ইসলাম। তাকে কিভাবে সচিবালয়ের ভেতরে একজন সচিব কিল ঘুষি দিলেন সেই ছবিটা আমরা দেখেছি। তাকে যেখানে রাষ্ট্রের সেইফ গার্ড দেয়ার কথা ছিল উল্টো তাকে মামলার জালে আটকিয়ে দেয়া হলো।
রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হচ্ছেন সাংবাদিকরা। কোথায় আমরা নিরাপত্তা পাবো, সেখানে উল্টও নাজেহাল হতে হচ্ছে আমাদের। সেখানে নারী পুরুষ কেউ বাদ নন। পেশাগত কাজে সবাই আক্রান্ত। আজকে একজন জ্যোষ্ঠ প্রতিবেদক কাল আমি অথবা আপনি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, মানহানি মামলা যেখানে তাড়া করে বেড়ায় সেখানে নতুন মাত্রা যোগ হলো অফিসিয়াল সিক্রেট এক্ট লংঘন। লাগাম টেনে ধরা নয়, লাগাম দিয়ে বেঁধে ফেলা হচ্ছে সাংবাদিকদের।দুর্নীতি লুটপাট আমরা তুলে ধরবও, এটাই কাজ। নেক্কার হামলা না করে নিউজের বিরুদ্ধে বিবৃতি দেওয়া যেত যুক্তি দেখিয়ে, কারণ দশিয়ে। কিন্তু বারবার হামলা কেন!
ইদানিং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, আমার ব্যক্তিগত বিশ্লেষণ থেকে লাগামহীন হয়ে উঠেছেন সরকারি আমলারা। সাধারণ খাদেম যেখানে হবেন আমলারা সেখানে তারা খাদক হয়ে উঠেছেন। ভূমি অফিস থেকে সচিবালয় একের পর এক আক্রান্ত সাংবাদিক। পেশাগত দায়িত্ব পালনের স্বাধীনতা কোথায়? স্যালুট জানাই নারী সাংবাদিকদের, তথা সাংবাদিকদের। আমরা যারা আক্রান্ত হয়েও কাজ করি।
লিখেছেন- চৌধুরী মারূফ, সাংবাদিক
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন