সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

সুরে সুরে দেহ আত্মার মিলনে বারী সিদ্দিকী

১. গভীর নিশিতে ধ্যান মগ্ন হয়ে কালাচাঁনের অপেক্ষা করছেন সাধক। সাধক চান মিয়ার শিষ্য বাউল সিরাজউদ্দিনের মতে এটি একটি রাই বিচ্ছেদ। কৃষ্ণের অপেক্ষায় রাধা নিশি বা রাতকে অনুরোধ করছেন 'রাত' যেন না পোহায়  কারণ তার কালা চান যে কোন সময় আসতে পারে। শব্দগুচ্ছ গুলো থেকে সহজেই উপলব্ধি হয় সাধক নিজ দেহকে রাধা আর আত্মাকে কৃষ্ণের সাথে তুলনা করেছেন। দেহ আত্মার মিলন ঘটানোই ছিল সাধকের সাধনা।         

বন্ধু কালাচাঁনের খোঁজা পুরো গানটি হল--    
"রজনী হইসনা অবসান 
আজ নিশিতে আসতে পারেবন্ধু কালাচাঁন।।
কত নিশি পোহাইলোমনের আশা মনে রইলো রে
কেন বন্ধু আসিলোনা জুড়ায়না পরান।
আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন।।
বাসর সাজাই আসার আশেআসবে বন্ধু নিশি শেষে
দারূন পিরিতের বিষে ধরিল উজান।
আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন।।
মেঘে ঢাকা আঁধার রাতে কেমনে থাকি একা ঘরে
সাধক চাঁনমিয়া কয় কানতে কানতে হইলাম পেরেশান
আজ নিশিতে আসতে বন্দু কালাচাঁন।"   


২. অন্য আরেকটি গান খুব দাগ কাটে মনে। শুয়াচান অর্থাৎ আমি মনে করি শুয়ে থাকা চাঁদ। উকিল মুন্সীর এই গানটি আমার খুব’ই প্রিয়;

শুয়াচান পাখি আমার শুয়াচান পাখি
আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি।।
তুমি আমি জনম ভরাছিলাম মাখামাখি,
আজ কেন হইলে নীরবমেলো দুটি আঁখি।
বুলবুলি আর তোতা ময়নাকত নামে ডাকি,তোরে কত নামে ডাকি,
শিকল ভেঙ্গে চলে গেলে কারে লইয়া থাকি।।

তোমার আমার এই পিরিতিচন্দ্র সূর্য সাক্ষী
হঠাৎ করে চলে গেলেবুঝলাম না চালাকিরে পাখি
আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি।

সঙ্গীত শিল্পী বারী সিদ্দিকীর মুখ থেকে শোনা যায়, শুয়া চান পাখি গানটি উকিল মুন্সী তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে রচিত। বাউল গবেষকের মতে, গানটি উকিল মুন্সি মৃত বউয়ের শিয়রে বসে রচনা করেন। উকিল তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে’ই চান অর্থাৎ চাঁদের সাথে তুলনা করেছেন। অপরদিকে উকিল মুন্সির বাউল শিষ্য রহিমা খাতুন ওই গানের রোমান্টিক তত্ত্বটি বিভিন্ন বাউল গবেষকের নিকট নাকচ করে দিয়ে আধ্যাত্মিকতায় গানটিকে প্রতিষ্ঠিত করেন। রহিমা খাতুনের মতে, গানটি উকিল মুন্সি তাঁর পীর মুর্শিদ বা গুরুকে নিয়ে বেঁধেছেন। উকিলের অনেক গানের সঙ্গে আছে তাঁর গুরুর গভীরতর সম্পর্ক বিদ্যমান। উকিল লিখেছেন; তুমি আমি জনম ভরা ছিলাম মাখামাখি,আজ কেন হইলে নীরব মেলো দুটি আঁখি। অর্থাৎ স্ত্রীর সাথে মিলনের আসক্ততা খুবই সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন গানের কথাতে। বুলবুলি, টিয়া, ময়না প্রভৃতি নামে ডেকে বউকে প্রেম পিঞ্জিরায় পুষেছেন জীবন অব্দি। হঠাত করে প্রেম সোহাগী চলে যাওয়ায় উকিলের নিঃস্ব-একাকী জীবনের কালো কলি তার গানের কথাতেই ফুটে উঠেছে।

বাউল সাধক চান মিয়া এবং বাউল উকিল মুন্সীর এই দুটি গান জনপ্রিয় হয়েছে শ্রদ্ধেয় বারী সিদ্দিকীর কণ্ঠে। বাঁশির সুরে ধুন তোলা এই মানুষটি আজ অসুস্থ। দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন প্রিয় বারী সিদ্দিকী।  

লিখেছেন: মারূফ অমিত, অনলাইন এক্টিভিস্ট


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাউল সাধক চান মিয়া এবং আমার কিছু উপলব্ধি

"রজনী হইসনা অবসান  আজ নিশিতে আসতে পারেবন্ধু কালাচাঁন।। কত নিশি পোহাইলোমনের আশা মনে রইলো রে কেন বন্ধু আসিলোনা জুড়ায়না পরান। আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন।। বাসর সাজাই আসার আশেআসবে বন্ধু নিশি শেষে দারূন পিরিতের বিষে ধরিল উজান। আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন।। মেঘে ঢাকা আঁধার রাতে কেমনে থাকি একা ঘরে সাধক চাঁনমিয়া কয় কানতে কানতে হইলাম পেরেশান আজ নিশিতে আসতে বন্দু কালাচাঁন।"    গভীর নিশিতে ধ্যান মগ্ন হয়ে কালাচাঁনের অপেক্ষা করছেন সাধক।  সাধক চান মিয়ার শিষ্য বাউল সিরাজউদ্দিনের মতে এটি একটি রাই বিচ্ছেদ। কৃষ্ণের অপেক্ষায় রাধা নিশি বা রাতকে অনুরোধ করছেন 'রাত' যেন না পোহায়  কারণ তার কালা চান যে কোন সময় আসতে পারে। শব্দগুচ্ছ গুলো থেকে সহজেই উপলব্ধি হয় সাধক নিজ দেহকে রাধা আর আত্মাকে কৃষ্ণের সাথে তুলনা করেছেন। দেহ আত্মার মিলন ঘটানোই ছিল সাধকের সাধনা।        বাউল সাধক চান মিয়া উপরোক্ত গানটি রচনা করেছেন। নেত্রকোনা জেলার খাটপুরা গ্রামে ১৩২৫ বঙ্গাব্দে সাধক চান মিয়ার জন্ম। পুরো নাম চান্দেজ্জামান আকন্দ হলেও বা...

বাউল, বাউলতত্ব এবং কিছু কথা

একজন ভদ্র বন্ধু বরের সাথে বাউল সম্প্রদায় নিয়ে বেশ তর্ক হলো রাতে। তর্কের সূত্রপাত ছিল বাউলরা ভাববাদী না বস্তুবাদী। ভাবলাম "বাউলতত্ত্ব"র আলোকে বাউলরা ভাববাদী নাকি বস্তুবাদী তা নিয়ে যৌক্তিক আলোচনা আবশ্যম্ভাবী। কয়েকটি ধারাবাহিক পর্ব লিখে নিজের মনোভাব বোঝানোর চেষ্টা করব।  শুরুতেই শক্তিনাথ ঝাঁ এর বস্তুবাদী বাউল বই থেকে কিছু কথা লিখতে চাই; বাস্তব জগত ও জীবনকে এরা কোন আনুমানিক যুক্তি বা আলৌকিক যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে নারাজ। জৈব রাসায়নিক ব্যাখায় এরা নারীর রজঃ এবং পুরুষের বিজে জীবন ও জগত সৃষ্টিকে ব্যাখা করে এবং চার ভূতকে প্রাকৃতিক সৃষ্টি মনে করে। এভাবে মানুষে, প্রকৃতিতে তৈরি করে প্রাণ, প্রাণী। অনুমান ভিত্তিক স্বর্গ, নরক, পরলোক, পুনর্জন্মাদি প্রত্যক্ষ প্রমাণাভাবে বাউল আগ্রাহ্য করে। মানুষ ব্যাতিরিক্ত ঈশ্বরও এরা মানে না। সৃষ্টির নিয়মকে জেনে যিনি নিজেকে পরিচালনা করতে শিখেছেন- তিনিই সাঁই। সুস্থ নিরোগ দীর্ঘজীবন এবং আনন্দকে অনুভব করার বাউল সাধনা এক আনন্দমার্গ।।  বাউলরা ভাববাদী না বস্তুবাদী এর অনেক সূক্ষ বিশ্লেষণ শক্তিনাথের বস্তুবাদী বাউল বইটির মধ্যে আলকপাত করা হয়েছে। সাধারণ সমাজে এ ধা...

ভাইবে রাধারমণ

তখন কলেজের ছাত্র। বাংলা বিভাগের প্রভাষক শ্রদ্ধেয় রেজা স্যারের সাথে খুবই ভালো সম্পর্ক। কলেজের প্রথম দিনই স্যারকে খুব পছন্দ। তারপর স্যারের সাথে গল্প, সমাজ, রাজনীতি, সাহিত্য নিয়ে আলোচনা। রীতিমত ফিজিক্স, বায়োলোজি ক্লাস ফাঁকি দিলেও বাংলা ক্লাস কখনই ফাঁকি দিতাম না। খুব উপভোগ করতাম স্যারের ক্লাস। হোস্টেল সুপার হিসেবে স্যার ( ওহী আলম রেজা) আমাদের সাথেই থাকতেন। আমরা আসার প্রায় নয় মাস পর স্যার এলেন সুপার হিসেবে। প্রতিদিন রাতে খাবার পরেই স্যারের রুমে গিয়ে আড্ডা হত, গানের আসর হত। স্যারের পিসিতে প্রায়ই গান শুনতাম আমরা। একদিন হঠাৎ করেই একটি গান স্যার প্লে করলেন 'আমার বন্ধু দয়াময় তোমারে দেখিবার মনে লয়। তোমারে না দেখলে রাধার জীবন কেমনে রয় বন্ধুরে।। কদম ডালে বইসারে বন্ধু ভাঙ্গ কদম্বের আগা। শিশুকালে প্রেম শিখাইয়া যৌবনকালে দাগা রে।। তমাল ডালে বইসারে বন্ধু বাজাও রঙের বাশি। সুর শুনিয়া রাধার মন হইলো যে উদাসি রে।। ভাইবে রাধা রমন বলে মনেতে ভাবিয়া। নিভা ছিল মনের আগুন কে দিলাই জ্বালাইয়া রে।' গানের কথাগুলো বেশ ভালো লেগে গেলো। পুর গানটি শুনে বুঝলাম গানটি সাধক রাধারম...