২০১২ সালে মাত্র ১০ বছর বয়সে বিয়ে হয় সিলেটের দলদলি চা বাগানের চানমারি লাইনের মণি দাসের (১৭)। বিয়ের পরের বছরই মণি জন্ম দেন যমজ সন্তান। মণি তার কৈশোর কাটান নিজের সন্তানদের সাথে খেলা করে। বর্তমানে ৭ বছরের ২টি যমজ মেয়ে ও ৩ বছরের ১টি ছেলে সন্তানের মা তিনি। অল্প বয়সে বিয়ে ও মা হওয়ার বিরূপ প্রভাব পরে মণি ও তার বাচ্চাদের উপর। শরীর রোগা হয়ে পড়ে তার। সারা বছর অসুস্থ থাকেন। নিজে অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ায় সন্তানরাও অপুষ্ট হয়ে জন্ম নেয়।মণির মতই বাল্যবিবাহ হয় দলদলি চা বাগানের শ্রমিক সন্ধ্যা দাশের (২৯)। ১৬ বছর বয়সে বিয়ে হয় তার। সন্ধ্যার স্বামীর বয়স তার বয়সের দ্বিগুণ। বিয়ের ১ বছর পর প্রথম সন্তান জন্ম দেন সন্ধ্যা। বর্তমানে ১১ বছরের ও ৬ বছর বয়সের ২টি ছেলে আছে তার। বাগানের কাজ, বাড়ির কাজ, সন্তান লালন পালন করে দিন কাটে তার। এতসবের চাপে শারীরিক অসুস্থতায় অনেকটা বুড়িয়ে গেছেন সন্ধ্যা।কেবল মণি আর সন্ধ্যাই নন, সিলেটের যে কোনো চা বাগানে গেলেই দেখা মিলবে এমন অসংখ্য মণি-সন্ধ্যাদের। সিলেট বিভাগের চা বাগানগুলোর ৪৬ শতাংশ কিশোরীই বাল্য বিয়ের শিকার হচ্ছে। ১৮ বছরের আগেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে তাদের।সিলেট বিভাগের চা বাগানের উপর পরিচালিত জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক জরিপে জানা গেছে এমন তথ্য। শুধুমাত্র চা জনগোষ্ঠী নিয়ে প্রথমবারের মতো এই জরিপ করা হয় ২০১৮ সালে। এই জরিপের প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে সম্প্রতি।মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার কমানো, অপরিপক্ব শিশু জন্মরোধ ও কিশোরীদের স্বাভাবিক বিকাশে সরকার ১৯ বছরের আগে মেয়েদের ও ২১ বছরের আগে ছেলেদের বিয়ে আইন করে নিষিদ্ধ করেছে।এই আইন প্রয়োগে প্রশাসনের উদ্যোগ এবং জনসচেতনতার কারণে সিলেট বিভাগে বাল্যবিবাহ হারও কমছে। ২০১২-১৩ সালে ইউনিসেফ ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে সিলেট বিভাগে বাল্য বিয়ের হার ৩৮.৫ শতাংশ। আর ২০১৯ সালে এই সংস্থার পরিচালিত জরিপেই সিলেট বিভাগে বাল্য বিয়ের হার কমে দাঁড়িয়েছে ৩১ শতাংশে।চা বাগানে বাল্য বিয়ের হার এখনও অনেক বেশি বলে মনে করেন সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার মো. মোস্তাফিজুর রহমানও। তিনি সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোরকে বলেন, জীবনমানের নানা ক্ষেত্রেই পিছিয়ে রয়েছে চা জনগোষ্ঠী। বাগানগুলোতে বাল্যবিয়ের হারও অধিক। বাগানে বাল্য বিয়ে কমিয়ে আনতে আমরা বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছি। সম্প্রতি ইউনিসেফের কর্মকর্তাদের সাথেও এ ব্যাপারে আমি বৈঠক করেছি। তাদের সাথে করণীয় নিয়ে আলোচনা করেছি।তিনি বলেন, চা জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি আমাদের থেকে আলাদা। তাদের মধ্যে সচেতনতারও অভাব রয়েছে। তাই সরকারের সকল বার্তা ও সেবা তাদের কাছে পৌঁছে দিতে কিছুটা সময় লাগছে। তবে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।সারা দেশে চা বাগান রয়েছে ১৬২টি। এর মধ্যে সিলেট বিভাগের তিন জেলায়ই রয়েছে ১৩৮টি। ইউনিসেফ ও বিবিএসের জরিপের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, হবিগঞ্জের চা বাগানগুলোর ৪১.৩%, মৌলভীবাজারে ৪৭.৭%, সিলেটে ৩৯.১% কিশোরীর ১৮ বছরের আগেই বিয়ের হয়ে যাচ্ছে।আর ১৫ বছরের আগে বিয়ে হচ্ছে ১৩.৫ শতাংশ কিশোরীর। চা বাগানের ২০ থেকে ২৪ বছরের নারীদের উপর পরিচালিত এ জরিপে দেখা গেছে- ১৫ বছরের মধ্যে বিয়ে হয়ে যায় হবিগঞ্জে ১০.৩%, মৌলভীবাজারে ১৪.৩% ও সিলেটের ১৪.২% কিশোরীর।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ার কারণে মা এবং শিশু দুয়ের উপরই ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অপ্রাপ্ত বয়স্ক মা অপুষ্ট শিশু জন্ম দিছেন। অনেক সময় মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু ঘটছে। বাল্য বিবাহের শিকার মেয়ে শিশুরা জীবনভর নানা রকম স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে থাকে।চা বাগানের শিশুদের শৈশবকালীন মৃত্যুর হার নিয়ে ইউনিসেফের জরিপ বলছে, চা বাগানে নবজাতকের মৃত্যুর হার ৫৫ শতাংশ। এরমধ্যে শিশুর জন্ম থেকে ১ বছরের মধ্যে মৃত্যু হয় ৬৮ শতাংশ শিশুর। ১ থেকে ৫ বছরের মধ্যে মৃত্যু হয় ১২ শতাংশ শিশুর, জন্ম থেকে ৫ বছরের মধ্যে মৃত্যু হয় ৭৯ শতাংশ শিশুর।
লিখেছেেন- শাকিলা ববি (Shakila Bobi), সাংবাদিক, সমাজকর্মী (Journalist, Social Activists)
লিখেছেেন- শাকিলা ববি (Shakila Bobi), সাংবাদিক, সমাজকর্মী (Journalist, Social Activists)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন