সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

একজন মুক্তিযোদ্ধার সাথে আমার কথপোকথন

চৌধুরী মারূফ, সাংবাদিক এবং অনলাইন এক্টিভিস্ট
কথোপকথনের সময়- ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭
--------
"আজকে আমাদের ইতিহাস বিকৃত। যে যার ভাবে ইতিহাস তৈরি করে নিচ্ছে।  আমাদের নতুন প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস জানতেই দেওয়া হচ্ছে না। আমরা কোন দলের রাজনীতি করি না। কিন্তু খুব দুঃখ লাগে আজ ৪৬ বছর পরও বিভিন্ন অদ্ভুত কথাবার্তা শুনতে"। এভাবেই আক্ষেপ করছিলেন মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান।

১৫ ডিসেম্বর ২০১৭ (শুক্রবার) সন্ধ্যায় কথা হচ্ছিল ৯ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করা মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমানের সাথে।

মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান জানান, ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে তাদের ১৩ জনের একটি দল বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। প্রবেশ করতেই পড়েন পাকিস্তানি মেলেটারির বাঁধার মুখে। সম্মুখ যুদ্ধ হয় পাক মেলেটারির সাথে।

তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসের প্রথমদিকে যশোর সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করলে যশোরের বড়দিয়া এলাকায় একটি ছোট নদী পার হওয়ার সময় পাক মেলেটারীরা আমাদের ঘিরে ফেলে। কোন মতে আমরা নদীটা পার হই পাক মেলেটারির গুলি বর্ষণের মধ্যে। পাড়ে পৌছে সেখানে থেকেই আমরা গুলি চালাই পাক মেলেটারির উপরে। আমি তখন স্টেনগান দিয়ে ফায়ার করছিলাম পাগলের মত। তিনটা পাক মেলেটারিকে একবারে বুঝে বুঝে এটেম করি। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে আমাকে কভার করা একজনের উপর পাকিস্তানি মেলেটারিরা এল এম জি নিক্ষেপ করলে সে ঝাঝরা হয়ে যায়। পরবর্তীতে প্রবল গুলি বর্ষণের মধ্যে পাকিস্তানীরা টিকতে না পেরে কোন মতে তাদের লঞ্চ নিয়ে পিছু হটে পালিয়ে যায়। এর পর থেকে ঐ নদী দিয়ে কখনই আর পাকিস্তানী মেলেটারিরা আসে নি।

মুক্তিযুদ্ধের এমন সম্মুখ যুদ্ধের ঘটনা বলতে বলতে মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান জানান, ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি ভারত চলে যান ট্রেনিং নিতে। তার মেজো চাচা এম এ কাদেরের সহায়তার তিনি ভারতে যেতে পারেন। তিনি জানান, ভারতের বশীরহাট এলাকার বেগুনদিয়া ক্যাম্পে তিনি ট্রেনিং নেন।

হাবিবুর রহমান সে সময়কার কষ্টের স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমার মা জানতেন না যে আমি মুক্তিযুদ্ধে চলে যাচ্ছি। শুধু আমার বাবা আর আমার মেজো চাচা জানতেন। তখন বাড়ি থেকে যাবার সময় কোন টাকা পয়সা ছিল না। মায়ের এক জোড়া স্বর্ণের কানের দোল ছিল। সেখান থেকে একটা কানের দুল নিয়ে যাই। পরবর্তীতে ভারতে গিয়ে সেটা ৪৭০ বা ৪৮০ টাকায় বিক্রি করেছিলাম। সে টাকা দিয়ে নিজে খরচ করেছি, ক্যাম্পের অন্যান্যদের ও কিছু দিয়েছি।

তিনি জানান, আমার মেজো চাচা এলাকায় থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সব সময় আশ্রয় দিতেন। আমি মুক্তিযুদ্ধে যাবার পর এক দালাল ছিল হালিম খাঁ নাম। পাকিস্তানীদের এই দালাল খুব জ্বালাতন করত বাড়িতে এসে। কত মানুষকে যে টর্চার করছে এই রাজাকার তা বলে শেষ করতে পারব না। জামায়াত ইসলামের এই লোক এলাকার পিচ কমিটির (শান্তি কমিটি) চেয়ারম্যান ছিল। যুদ্ধের পর পর মুক্তিবাহিনীর লোকজন তাকে মেরে ফেলে।

বর্তমান পরিস্থিতির কথা জানতে চাইলে হাবিবুর রহমান জানান, এখন দেশ অনেক ভালো, আগাচ্ছে। কিন্তু সবচেয়ে ভয়াবহ খারাপ দিক হলো এখনো আমাদের ইতিহাসের বিকৃত চর্চা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ৭৫ থেকেই এই চর্চা শুরু হয়েছে।

তিনি বলেন, এই মনে করেন জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র পাঠ করেছে কালুরঘাট থেকে। জিয়া বেঁচে থাকতে কখনো নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে দাবী করেন নাই। কিন্তু এখন তার দল এটা ঢালাও ভাবে প্রচার করছে। এটা স্রেফ মিথ্যাচার। আমরা কোন রাজনীতি করি না কিন্তু এসব ত মেনে নেওয়া যায় না।

তিনি আরও বলেন, এই দেখেন 'জয় বাংলা' শ্লোগান জাতীয় শ্লোগান কেন নয় তা নিয়ে আদালতে শুনানি হচ্ছে। কিন্তু এটাতো কোন রাজনৈতিক দলের শ্লোগান নয়। এটা আমাদের সবার শ্লোগান। কোন দল সেই শ্লোগান দিলে ভালো, কিন্তু সেটাকে দলীয় শ্লোগান বললে ত ইতিহাসকেই বিকৃত করা হয়। কারণ মুক্তিযুদ্ধের শ্লোগান সবার শ্লোগান, জাতীয় শ্লোগান। এত বছর পর এই শ্লোগান কেন জাতীয় শ্লোগান নয় এসব নিয়ে আলোচনা করাটা আমাদের জন্য লজ্জাকর।

হাবিবুর রহমান জানান, আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি, দেশ স্বাধীন করেছি। আমরা চাই আমাদের ছেলে মেয়ে, তাদের ছেলেমেয়ে সঠিক ইতিহাস জানুক, সৎ পথে চলুক। বাংলাদেশকে ভালবাসুক।

মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমানের জন্ম ১৯৫৪ সালের ৯ নভেম্বর বাগেরহাটের চিতলমারি এলাকায়। তাঁর মুক্তিযোদ্ধা সনদ নং  'ম  ১৬৮৯৮৫' এবং সেনাবাহিনী গেজেট মুক্তিযোদ্ধার তথ্য মতে তাঁর গেজেট নাম্বার "১০৫৫৮"।  ১৯৭৪ সালের ৮ নভেম্বর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং অবসর নেন ১৯৯০ সালের ৭ জানুয়ারী। পরবর্তীতে ৯১ সালের  ২ মার্চ সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানায় নিরাপত্তা শাখায় কর্মরত ছিলেন। ২০১৩ সালে তিনি সেখান থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৮৬ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। সহধর্মিনী, দুই ছেলে এবং এক মেয়ে নিয়ে সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার কচুয়াবহর এলাকায় বসবাস করছেন।


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাউল সাধক চান মিয়া এবং আমার কিছু উপলব্ধি

"রজনী হইসনা অবসান  আজ নিশিতে আসতে পারেবন্ধু কালাচাঁন।। কত নিশি পোহাইলোমনের আশা মনে রইলো রে কেন বন্ধু আসিলোনা জুড়ায়না পরান। আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন।। বাসর সাজাই আসার আশেআসবে বন্ধু নিশি শেষে দারূন পিরিতের বিষে ধরিল উজান। আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন।। মেঘে ঢাকা আঁধার রাতে কেমনে থাকি একা ঘরে সাধক চাঁনমিয়া কয় কানতে কানতে হইলাম পেরেশান আজ নিশিতে আসতে বন্দু কালাচাঁন।"    গভীর নিশিতে ধ্যান মগ্ন হয়ে কালাচাঁনের অপেক্ষা করছেন সাধক।  সাধক চান মিয়ার শিষ্য বাউল সিরাজউদ্দিনের মতে এটি একটি রাই বিচ্ছেদ। কৃষ্ণের অপেক্ষায় রাধা নিশি বা রাতকে অনুরোধ করছেন 'রাত' যেন না পোহায়  কারণ তার কালা চান যে কোন সময় আসতে পারে। শব্দগুচ্ছ গুলো থেকে সহজেই উপলব্ধি হয় সাধক নিজ দেহকে রাধা আর আত্মাকে কৃষ্ণের সাথে তুলনা করেছেন। দেহ আত্মার মিলন ঘটানোই ছিল সাধকের সাধনা।        বাউল সাধক চান মিয়া উপরোক্ত গানটি রচনা করেছেন। নেত্রকোনা জেলার খাটপুরা গ্রামে ১৩২৫ বঙ্গাব্দে সাধক চান মিয়ার জন্ম। পুরো নাম চান্দেজ্জামান আকন্দ হলেও বা...

বাউল, বাউলতত্ব এবং কিছু কথা

একজন ভদ্র বন্ধু বরের সাথে বাউল সম্প্রদায় নিয়ে বেশ তর্ক হলো রাতে। তর্কের সূত্রপাত ছিল বাউলরা ভাববাদী না বস্তুবাদী। ভাবলাম "বাউলতত্ত্ব"র আলোকে বাউলরা ভাববাদী নাকি বস্তুবাদী তা নিয়ে যৌক্তিক আলোচনা আবশ্যম্ভাবী। কয়েকটি ধারাবাহিক পর্ব লিখে নিজের মনোভাব বোঝানোর চেষ্টা করব।  শুরুতেই শক্তিনাথ ঝাঁ এর বস্তুবাদী বাউল বই থেকে কিছু কথা লিখতে চাই; বাস্তব জগত ও জীবনকে এরা কোন আনুমানিক যুক্তি বা আলৌকিক যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে নারাজ। জৈব রাসায়নিক ব্যাখায় এরা নারীর রজঃ এবং পুরুষের বিজে জীবন ও জগত সৃষ্টিকে ব্যাখা করে এবং চার ভূতকে প্রাকৃতিক সৃষ্টি মনে করে। এভাবে মানুষে, প্রকৃতিতে তৈরি করে প্রাণ, প্রাণী। অনুমান ভিত্তিক স্বর্গ, নরক, পরলোক, পুনর্জন্মাদি প্রত্যক্ষ প্রমাণাভাবে বাউল আগ্রাহ্য করে। মানুষ ব্যাতিরিক্ত ঈশ্বরও এরা মানে না। সৃষ্টির নিয়মকে জেনে যিনি নিজেকে পরিচালনা করতে শিখেছেন- তিনিই সাঁই। সুস্থ নিরোগ দীর্ঘজীবন এবং আনন্দকে অনুভব করার বাউল সাধনা এক আনন্দমার্গ।।  বাউলরা ভাববাদী না বস্তুবাদী এর অনেক সূক্ষ বিশ্লেষণ শক্তিনাথের বস্তুবাদী বাউল বইটির মধ্যে আলকপাত করা হয়েছে। সাধারণ সমাজে এ ধা...

ভাইবে রাধারমণ

তখন কলেজের ছাত্র। বাংলা বিভাগের প্রভাষক শ্রদ্ধেয় রেজা স্যারের সাথে খুবই ভালো সম্পর্ক। কলেজের প্রথম দিনই স্যারকে খুব পছন্দ। তারপর স্যারের সাথে গল্প, সমাজ, রাজনীতি, সাহিত্য নিয়ে আলোচনা। রীতিমত ফিজিক্স, বায়োলোজি ক্লাস ফাঁকি দিলেও বাংলা ক্লাস কখনই ফাঁকি দিতাম না। খুব উপভোগ করতাম স্যারের ক্লাস। হোস্টেল সুপার হিসেবে স্যার ( ওহী আলম রেজা) আমাদের সাথেই থাকতেন। আমরা আসার প্রায় নয় মাস পর স্যার এলেন সুপার হিসেবে। প্রতিদিন রাতে খাবার পরেই স্যারের রুমে গিয়ে আড্ডা হত, গানের আসর হত। স্যারের পিসিতে প্রায়ই গান শুনতাম আমরা। একদিন হঠাৎ করেই একটি গান স্যার প্লে করলেন 'আমার বন্ধু দয়াময় তোমারে দেখিবার মনে লয়। তোমারে না দেখলে রাধার জীবন কেমনে রয় বন্ধুরে।। কদম ডালে বইসারে বন্ধু ভাঙ্গ কদম্বের আগা। শিশুকালে প্রেম শিখাইয়া যৌবনকালে দাগা রে।। তমাল ডালে বইসারে বন্ধু বাজাও রঙের বাশি। সুর শুনিয়া রাধার মন হইলো যে উদাসি রে।। ভাইবে রাধা রমন বলে মনেতে ভাবিয়া। নিভা ছিল মনের আগুন কে দিলাই জ্বালাইয়া রে।' গানের কথাগুলো বেশ ভালো লেগে গেলো। পুর গানটি শুনে বুঝলাম গানটি সাধক রাধারম...