সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বর্ণবাদের কারণে পৃথিবী নিশ্বাস নিতে পারছে ত ?

বর্ণবাদ শব্দটি শুনলেই কেন যেন আমার শরীর ছমছম করে। সাদা কালো মারামারি, বৈষম্য, মানুষের শরীরের চামড়া নিয়ে আঁড় চোখে তাকানো কখনো আমি মেনে নিতেই পারিনা। বর্ণবাদ কেন যেকোন ধরনের ধর্মীয় সামাজিক গোঁড়ামি আমার একদম অপছন্দ। আসলে বর্ণবাদ কথা বলতে চাচ্ছি যুক্তরাষ্ট্রের সমসাময়িক একটি ঘটনা নিয়ে । যুক্তরাষ্ট্রের কর্তব্যরত একজন পুলিশের নির্যাতনে একজন কৃষাঙ্গ শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, এক যুবককে হাঁটু দিয়ে চেপে ধরে নির্যাতন করছেন এক পুলিশ কর্মকর্তা। জর্জ ফ্লোয়েড নামের ওই কৃষ্ণাঙ্গ যুবক বাঁচার আকুতি জানিয়ে বারবার বলছিলেন, আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। পরে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

এটা ত সমসাময়িক ঘটনা। ২০১৬ সালের জুন মাসের একটি ঘটনা মনে আছে কি আমাদের! টেক্সাস রাজ্যের ওয়াকোতে একটি বেসরকারি স্কুলে সহপাঠীদের হাতেই ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়েছে এক কৃষ্ণাঙ্গ শিক্ষার্থী। শ্বেতাঙ্গ সহপাঠীরা গলায় দড়ি পেঁচিয়ে মাটিতে ফেলে দেয় ১২ বছর বয়সী ওই শিক্ষার্থীকে। লাইভ ওক ক্লাসিক্যাল স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির এক ক্যাম্পআউটে দড়ি নিয়ে খেলতে খেলতে এই নির্যাতনের ঘটনা ঘটায় একদল শ্বেতাঙ্গ শিক্ষার্থী। তারা দাবি করে দুর্ঘটনাবশত দড়িটি পেঁচিয়ে যায় মেয়েটির গলায়।

এমন ঘটনা প্রায়ই দেখা যায় ইউরোপ আমেরিকা এবং কানাডা জুড়ে। তবে এসবের রেসিজমের ভিন্ন পথে হাঁটছে একমাত্র ফ্রান্স। মানবতার দেশ খ্যাত ফ্রান্সে কৃষাঙ্গ শ্বেতাঙ্গ বর্ণবৈষম্য অনেক কমে এসেছে। ২০১০ সালের পর থেকে একদম কম বললেই চলে।   

এবার একজন মহান নেতার কথা নিয়ে আসি, অনেকেই হয়তো বোঝে ফেলেছেন কার কথা বলতে যাচ্ছি! হ্যাঁ আমি নেলসন ম্যান্ডেলার কথা বলছি। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদীদের শাসনের অবসান ঘটেছে প্রায় দুই যুগ আগে। বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের প্রবাদপুরুষ নেলসন ম্যান্ডেলার হাত ধরে রাজনৈতিক মুক্তি পেয়েছিল দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষ্ণাঙ্গরা। ম্যান্ডেলা মারা গিয়েছেন ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে। তারপর অতিবাহিত হয়েছে আরও ৫ বছর। কিন্তু কমে গেছে কি বর্ণবাদ ?

২০১৮ সালে প্রকাশিত ‘বিশ্ব ব্যাংকের দারিদ্র্যতা ও অর্থনৈতিক বৈষম্য’ বিষয়ক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দেশটির সুবিধাবঞ্চিত যে সকল নাগরিক পূর্বে তুলনামূলক কম সম্পদের অধিকারী ছিলেন; যাদের দক্ষতার অভাব ছিল; যারা কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হতেন; কিংবা যারা বেকার ছিলেন- তাদের কারোরই ভাগ্যের তেমন কোনো উন্নতি ঘটেনি। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, যারা নিজেদের উচ্চবর্ণের মনে করতো, সমাজের অভিজাত শ্রেণী হিসেবে গণ্য হতো, অর্থাৎ সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গরাই এখন পর্যন্ত অর্থনৈতিক নেতৃত্ব ধরে রেখেছেন। যখন ম্যান্ডেলার দল ‘আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস (এএনসি)’ দক্ষিণ আফ্রিকার ক্ষমতায় আসে, তখন জাতীয় পর্যায়ে তারা মাত্র ৫৭ শতাংশ ভোট পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল। এর ফলে অনেক অঞ্চলে বর্ণবৈষম্য নতুন মাত্রা ধারণ করেছিল এবং শ্বেতাঙ্গদের সাথে কৃষ্ণাঙ্গদের আরও দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। এর ফলে শ্বেতাঙ্গদের নিয়ন্ত্রণে থাকা অর্থনৈতিক জগত থেকে কৃষ্ণাঙ্গরা তেমন কোনো সুবিধা ভোগ করতে পারেনি। বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনেও অনুরূপ চিত্র উঠে আসে। প্রতিষ্ঠানটির পরিসংখ্যানে বলা হয়, দক্ষিণ আফ্রিকা ৬৩ পয়েন্ট নিয়ে বিশ্বের অর্থনৈতিক বৈষম্যপূর্ণ দেশের তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করছে। এই তালিকায় ২৫ পয়েন্ট নিয়ে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে ইউক্রেন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গণমাধ্যম সিএনএন-এর তথ্যচিত্রে দেখানো হয়েছে, ১৯৯৩ সালে দেশটির পয়েন্ট ছিল ৫৯, যা বর্তমানে ক্রম অবনতির মাধ্যমে ৬৩-তে এসে উপনীত হয়েছে। অবশ্য ২০০৫ সালে এটি আরও অবনতি হয়ে ৬৫-তে গিয়েছিল। এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশটির ৭১ শতাংশ সম্পদ মাত্র ১০ শতাংশ ধনিক শ্রেণীর হাতে কুক্ষিগত হয়ে আছে, অপরদিকে দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করা ৬০ শতাংশ মানুষের দখলে রয়েছে মাত্র ৭ শতাংশ সম্পদ। আর মধ্যবিত্ত ৩০ শতাংশের দখলে রয়েছে বাকি ২২ শতাংশ সম্পদ।

ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির এক তথ্যচিত্রে দেখা যায়, দেশটির শিল্প-কারখানার ব্যবস্থাপনা পর্যায়ের পদগুলোর ৬৭ শতাংশ শ্বেতাঙ্গদের দখলে। আর কৃষ্ণাঙ্গদের দখলে মাত্র ১৪.৩ শতাংশ। বাকি পদগুলো ভারতীয় ও অন্যান্য মিশ্র বর্ণের লোকজনের দখলে। যদিও কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর প্রায় ৮০ শতাংশ সদস্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে, অন্যদিকে শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর মাত্র ৯ শতাংশ সদস্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।

উপরের এই সম্পূর্ণ তথ্য হচ্ছে, সাউথ আফ্রিকার, যেখানে প্রবাদ পুরুষ সংগ্রাম করে কাটিয়ে দিয়েছেন শুধু বর্ণবাদকে পিছনে ফেলে সমতার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে । সাউথ আফ্রিকাতে যদি এই অবস্থা হয় তবে বাদ বাকি দেশগুলোর কি অবস্থা! ডাব্লিউ এইচ কুশ্চেন রয়েই যায়!

আসি অন্য একটি কথায়। নিউজিল্যান্ডের মসজিদে বন্দুকধারীর হামলার কথা মনে আছে কি আমাদের! ২০১৯ সালের মার্চে জুম্মার নামাজ রত অবস্থায় ছিলে স্থানীয় মুসলমানরা। সেখানে একজন বন্দুকধারী কি নৃশংসভাবে হামলা চালিয়েছে তা আমরা আগেই দেখেছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ঐ ভিডিও ফুটেজ দেখে মনে হচ্ছিল কেউ যেন ভিডিও গেমস খেলছে তার ডেস্কটপ কম্পিউটারে! কি নৃশংস অবস্থা! বর্ণবাদের চূড়ান্ত সীমার একটি রূপ ছিল এটি।

আসি এখন আমাদের বাংলাদেশের অবস্থায়। বাংলাদেশে হয়ত সরাসরি  সাদা কালো বৈষম্য নেই কিন্তু মুদ্রার ওপিঠের বৈষম্য এখনো আছে। ছোট একটি ঘটনা শেয়ার করলেই সবকিছু ক্লিয়ার হয়ে যাবে। ২০১৪ সালে একবার চট্টগ্রাম যাচ্ছিলাম। রাতের উদয়ন এক্সপ্রেস। সামনা সামনি আসনে বসে ছিলাম বগির মাঝখানে। আমার সামনে বসের ছিলেন একজন ভদ্রলোক, এবং তার পাশে একজন বুদ্ধ ভিক্ষু, ধর্মীয় গেরুয়া পরা। তিনি সিলেট থেকে চিটাগাং যাচ্ছিলেন। কিন্তু পাশে শার্ট প্যান্ট পরা যে ভদ্রলোক ছিলেন তিনি যেন রীতিমত নাক উপরে তুলেই ছিলেন ঐ বুদ্ধ ভিক্ষুকে পাশে দেশে। মনে হচ্ছিল যেন কণ ভাবে একটু ছোঁয়া লাগলেই উনার গায়ে ফোঁসকা পড়বে এমন অবস্থা। পোষাক বা বিশ্বাসগত বৈষম্য এটি।

যাই হোক যা বলছিলাম, পৃথিবীর সব জায়গাতেই বৈষম্য আছে কোন না কোন ভাবেই। সবকিছু অভারকাম করতে আবার কিছু সাধারণ মানুষ লড়েও যাচ্ছেন, কিন্তু তবুও আছে। তবে শেষ কথা হচ্ছে এটি, বিংশ শতাব্দীতে এসে এমন সভ্য সমাজে জর্জ ফ্লোয়েড নামক মানুষের নির্মম হত্যাকাণ্ডের চিত্র দেখে মুখ বন্ধ করে বসে থাকা যায়না। প্রতিবাদ জানাতে হয়, এই লেখনির মাধ্যমে সেই প্রতিবাদ জানালাম। বর্ণবাদ নিপাত যাক।

লেখক- চৌধুরী মারূফ, সাংবাদিক, ব্লগার

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাউল সাধক চান মিয়া এবং আমার কিছু উপলব্ধি

"রজনী হইসনা অবসান  আজ নিশিতে আসতে পারেবন্ধু কালাচাঁন।। কত নিশি পোহাইলোমনের আশা মনে রইলো রে কেন বন্ধু আসিলোনা জুড়ায়না পরান। আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন।। বাসর সাজাই আসার আশেআসবে বন্ধু নিশি শেষে দারূন পিরিতের বিষে ধরিল উজান। আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন।। মেঘে ঢাকা আঁধার রাতে কেমনে থাকি একা ঘরে সাধক চাঁনমিয়া কয় কানতে কানতে হইলাম পেরেশান আজ নিশিতে আসতে বন্দু কালাচাঁন।"    গভীর নিশিতে ধ্যান মগ্ন হয়ে কালাচাঁনের অপেক্ষা করছেন সাধক।  সাধক চান মিয়ার শিষ্য বাউল সিরাজউদ্দিনের মতে এটি একটি রাই বিচ্ছেদ। কৃষ্ণের অপেক্ষায় রাধা নিশি বা রাতকে অনুরোধ করছেন 'রাত' যেন না পোহায়  কারণ তার কালা চান যে কোন সময় আসতে পারে। শব্দগুচ্ছ গুলো থেকে সহজেই উপলব্ধি হয় সাধক নিজ দেহকে রাধা আর আত্মাকে কৃষ্ণের সাথে তুলনা করেছেন। দেহ আত্মার মিলন ঘটানোই ছিল সাধকের সাধনা।        বাউল সাধক চান মিয়া উপরোক্ত গানটি রচনা করেছেন। নেত্রকোনা জেলার খাটপুরা গ্রামে ১৩২৫ বঙ্গাব্দে সাধক চান মিয়ার জন্ম। পুরো নাম চান্দেজ্জামান আকন্দ হলেও বা...

বাউল, বাউলতত্ব এবং কিছু কথা

একজন ভদ্র বন্ধু বরের সাথে বাউল সম্প্রদায় নিয়ে বেশ তর্ক হলো রাতে। তর্কের সূত্রপাত ছিল বাউলরা ভাববাদী না বস্তুবাদী। ভাবলাম "বাউলতত্ত্ব"র আলোকে বাউলরা ভাববাদী নাকি বস্তুবাদী তা নিয়ে যৌক্তিক আলোচনা আবশ্যম্ভাবী। কয়েকটি ধারাবাহিক পর্ব লিখে নিজের মনোভাব বোঝানোর চেষ্টা করব।  শুরুতেই শক্তিনাথ ঝাঁ এর বস্তুবাদী বাউল বই থেকে কিছু কথা লিখতে চাই; বাস্তব জগত ও জীবনকে এরা কোন আনুমানিক যুক্তি বা আলৌকিক যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে নারাজ। জৈব রাসায়নিক ব্যাখায় এরা নারীর রজঃ এবং পুরুষের বিজে জীবন ও জগত সৃষ্টিকে ব্যাখা করে এবং চার ভূতকে প্রাকৃতিক সৃষ্টি মনে করে। এভাবে মানুষে, প্রকৃতিতে তৈরি করে প্রাণ, প্রাণী। অনুমান ভিত্তিক স্বর্গ, নরক, পরলোক, পুনর্জন্মাদি প্রত্যক্ষ প্রমাণাভাবে বাউল আগ্রাহ্য করে। মানুষ ব্যাতিরিক্ত ঈশ্বরও এরা মানে না। সৃষ্টির নিয়মকে জেনে যিনি নিজেকে পরিচালনা করতে শিখেছেন- তিনিই সাঁই। সুস্থ নিরোগ দীর্ঘজীবন এবং আনন্দকে অনুভব করার বাউল সাধনা এক আনন্দমার্গ।।  বাউলরা ভাববাদী না বস্তুবাদী এর অনেক সূক্ষ বিশ্লেষণ শক্তিনাথের বস্তুবাদী বাউল বইটির মধ্যে আলকপাত করা হয়েছে। সাধারণ সমাজে এ ধা...

ভাইবে রাধারমণ

তখন কলেজের ছাত্র। বাংলা বিভাগের প্রভাষক শ্রদ্ধেয় রেজা স্যারের সাথে খুবই ভালো সম্পর্ক। কলেজের প্রথম দিনই স্যারকে খুব পছন্দ। তারপর স্যারের সাথে গল্প, সমাজ, রাজনীতি, সাহিত্য নিয়ে আলোচনা। রীতিমত ফিজিক্স, বায়োলোজি ক্লাস ফাঁকি দিলেও বাংলা ক্লাস কখনই ফাঁকি দিতাম না। খুব উপভোগ করতাম স্যারের ক্লাস। হোস্টেল সুপার হিসেবে স্যার ( ওহী আলম রেজা) আমাদের সাথেই থাকতেন। আমরা আসার প্রায় নয় মাস পর স্যার এলেন সুপার হিসেবে। প্রতিদিন রাতে খাবার পরেই স্যারের রুমে গিয়ে আড্ডা হত, গানের আসর হত। স্যারের পিসিতে প্রায়ই গান শুনতাম আমরা। একদিন হঠাৎ করেই একটি গান স্যার প্লে করলেন 'আমার বন্ধু দয়াময় তোমারে দেখিবার মনে লয়। তোমারে না দেখলে রাধার জীবন কেমনে রয় বন্ধুরে।। কদম ডালে বইসারে বন্ধু ভাঙ্গ কদম্বের আগা। শিশুকালে প্রেম শিখাইয়া যৌবনকালে দাগা রে।। তমাল ডালে বইসারে বন্ধু বাজাও রঙের বাশি। সুর শুনিয়া রাধার মন হইলো যে উদাসি রে।। ভাইবে রাধা রমন বলে মনেতে ভাবিয়া। নিভা ছিল মনের আগুন কে দিলাই জ্বালাইয়া রে।' গানের কথাগুলো বেশ ভালো লেগে গেলো। পুর গানটি শুনে বুঝলাম গানটি সাধক রাধারম...