সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বীভৎসতার চাষবাস: মুক্তি কত দূর?

কার্টুনিস্ট আহম্মেদ কবির কিশোরের একটা কার্টুন আছে এরকম- মা বিড়াল তার বাচ্চাকে 'আমি বৃদ্ধ হলে তুই কি আমায় বনে ফেলে আসবে?' জিজ্ঞেস করলে বাচ্চা বিড়ালের উত্তর: আমি কি মানুষের বাচ্চা?'মানুষ তো এক সময় বন-জঙ্গলে থাকতো। জীবজন্তু যেমন থাকে। পুরো পলীয় যুগে বা পুরাতন পাথরের যুগ পর্যন্ত তারা ফলমূল আহরণ করে খেতো। জীবজন্তু শিকার করে খেতো। কারণ ততদিন পর্যন্ত মানুষ কৃষি কাজ করতে শেখেনি। পাথরকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতো। গাছের ডালপালাও। নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তিক কৌশল কাজে লাগিয়ে তারা সবার চেয়ে এগিয়ে যায়। চিন্তার শক্তি দিয়ে একে একে ধরাশায়ী করে সব জীবজন্তুকে। নতুন সৃষ্টির সক্ষমতায় গড়ে তুলে বসতি। কাপড় চোপড় পরে শাসন করতে থাকে পৃথিবী। ইচ্ছে মতো প্রকৃতি আর প্রাণিকে খতম করে করে নিজেদের হিংস্রতার ইতিহাস জানান দেয়।প্রকৃতিতে এক প্রাণি অন্য প্রাণিকে খায়। এটা চলে আসছে প্রাণির সৃষ্টি থেকে। মানুষও খাচ্ছে প্রায় সব প্রাণিকে। বিজ্ঞান যাকে খাদ্যশৃঙ্খল বলে। তাহলে প্রাণি হত্যায় হৈচৈ কেন?


 আমরা যারা গ্রামাঞ্চলে বেড়ে ওঠেছি তাদের অনেকেরই বিভিন্ন ধরনের সাপের সামনে পরার অভিজ্ঞতা আছে। একেবারে সাপের উপর পরে গেলে হয়তো কামড়ে দিয়েছে নতুবা সাপ তো সব সময় পালিয়েই গিয়েছে। বেহুলা লখিন্দরের বাসর ঘরে ঢুকে দংশন করা সাপ ছাড়া আর কোনো সাপ কাউকে কি কখনো খোঁজে গিয়ে দংশন করেছে? করেনি। কিন্তু আমরা হরহামেশাই তাকে দেখা মাত্র দলবেঁধে বেরিয়েছি তার শেষ দেখে নিতে।দু'চারটা হাঁস মোরগ খেয়ে ফেলে বলে শিয়াল মারার জন্যে আশপাশের ঝোপঝাড় শেষ করে ফেলি। বিভিন্ন সময় পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয় বন্য হাতি মানুষের ঘরবাড়িতে হানা দেয়ার খবর, ধানসহ নানা ধরনের ফসলের ক্ষতি করার খবর। বানরসহ কিছু প্রাণি লোকালয়ে চলে আসে খাবারের জন্যে। এখন কথা হলো এই প্রাণিরা লোকালয়ে আসে কেন? তারা কি আমাদের দেখতে আসে- আমাদের প্রেম আর মহত্ত্বে দেওয়ানা হয়ে? মোটেই না। আমরা দখলদারির মাধ্যমে তাদের আবাসস্থল ধ্বংস করছি।আমাদের লোভী জিহ্বা বছরের পর বছর, দশকের পর দশক ধরে শুধু দীর্ঘই হচ্ছে। আমরা গ্রামের ঝোপঝাড় থেকে শুরু করে গহীন পাহাড়ের চূড়া পর্যন্ত গিলে ফেলছি। ডোবা, জলাশয়, খাল, বিল, হাওর, নদী সব গিলে নিচ্ছি। তাই এই প্রাণিরা আমাদের মতো জল্লাদের এলাকায় চলে আসে। তারা তো জানে না, আমরা কোন সুদূর অতীতেই আমাদের বন জঙ্গলে থাকার ইতিহাসের কবর দিয়ে হজম করে ফেলেছি। তারা তো জানে না যে, সেই কবে থেকে আমরা আমাদের জাতির কাউকেই এখন আর ছাড়ি না। এখানে আবার প্রশ্ন তুলি আগে যে প্রশ্নটা তুলেছিলাম, তাহলে প্রাণি হত্যায় হৈচৈ কেন? এক কথায় উত্তর- যখন সেটা বীভৎসতার মাত্রা ছাড়ায়। প্রতিদিন কতো লক্ষ, কোটি প্রাণি শেষ হয় আমাদের উদর পূর্তিতে। কই আমরা তো চিৎকার করি না। আবার দিনকে দিন মানুষের কিন্তু মানবেতর প্রাণির প্রতি সমবেদনা বাড়ছে নিঃসন্দেহে। নিজের প্রাণের ওপর নিয়ে চিন্তা করতে পারলে বিচলিত না হওয়ার কারণ নেই।


এমতাবস্থায় কী করণীয়? আশু মুক্তির কোনো পথ আছে বলে মনে হয় না। তবে চাইলে ধীরে ধীরে সেটা হয়তো সহনীয় করা সম্ভব। এই সহনীয় মাত্রায় রাখতে সাপ মারা, পাখি মারা, চোর মারা, নারী নির্যাতন, সিনেমার ভয়ংকর দৃশ্য দেখে দেখে বেড়ে ওটা আমাদের নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন বলে আমার মনে হয়।অনেকে বীভৎস ছবি শেয়ার করেন। সেটা মানুষ হোক কিংবা অন্য কোনো প্রাণির। যারা মানুষের হিংস্রতার শিকার। তারা ভালো উদ্দেশ্যে হয়তো শেয়ার করেন কিন্তু এসব দেখতে দেখতে এক সময় মানুষের অনুভূতি সহনশীল হয়ে যায়। তাই বিষয় তুলে ধরেন, সোচ্চার হন কিন্তু এসব বীভৎস ছবি না দিলেই ভালো। আমরা মোরগ লড়াই থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের পশুর লড়াই দেখি। এসব বন্ধ করা উচিৎ। এমনকি মুষ্টিযুদ্ধ, কুস্তিও বন্ধ হওয়া উচিত। প্রাণিকে বন্দি করে রাখার চিড়িয়াখানা ব্যবস্থা তুলে দেয়া দরকার। আমরা ছোট শিশুদের স্নেহের নামে শূন্যে তুলে ধরাসহ বিভিন্নভাবে আনন্দ উপভোগ করি অথচ সে ভয়ে বা যন্ত্রণায় কেঁদে উঠে। এসব যে ক্ষতির কারণ তা আমরা বুঝতে চাই না।অনেক পরিবারে তুচ্ছ কারণে শিশুদের নির্যাতন করা হয়। মোরগ জবাই থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রাণি হত্যায় আমরা প্রফুল্লচিত্তে শিশুদের নিয়ে আসি দেখাতে। এভাবে তারা ওই বয়স থেকে শেখে ওঠে এটাই স্বাভাবিক। যুদ্ধ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, সংঘাত তো আছেই। ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বিভিন্ন নিষ্ঠুরতা ও রক্তপাতের ধারাও আছে। এসব ক্ষেত্রে আমাদের আরও কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া দরকার। যত্নশীল হওয়া উচিত। তাহলে অন্তত এসব বন্ধ না হোক কিন্তু নির্মম বীভৎসতার চিত্র আস্তে আস্তে কমে আসবে। তখন কোনো জীবছানার মুখেই আর সংলাপ দিতে হবে না, আমি কি মানুষের বাচ্চা?

লেখকঃ জাহাঙ্গীর জয়েস, কবি।





মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাউল সাধক চান মিয়া এবং আমার কিছু উপলব্ধি

"রজনী হইসনা অবসান  আজ নিশিতে আসতে পারেবন্ধু কালাচাঁন।। কত নিশি পোহাইলোমনের আশা মনে রইলো রে কেন বন্ধু আসিলোনা জুড়ায়না পরান। আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন।। বাসর সাজাই আসার আশেআসবে বন্ধু নিশি শেষে দারূন পিরিতের বিষে ধরিল উজান। আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন।। মেঘে ঢাকা আঁধার রাতে কেমনে থাকি একা ঘরে সাধক চাঁনমিয়া কয় কানতে কানতে হইলাম পেরেশান আজ নিশিতে আসতে বন্দু কালাচাঁন।"    গভীর নিশিতে ধ্যান মগ্ন হয়ে কালাচাঁনের অপেক্ষা করছেন সাধক।  সাধক চান মিয়ার শিষ্য বাউল সিরাজউদ্দিনের মতে এটি একটি রাই বিচ্ছেদ। কৃষ্ণের অপেক্ষায় রাধা নিশি বা রাতকে অনুরোধ করছেন 'রাত' যেন না পোহায়  কারণ তার কালা চান যে কোন সময় আসতে পারে। শব্দগুচ্ছ গুলো থেকে সহজেই উপলব্ধি হয় সাধক নিজ দেহকে রাধা আর আত্মাকে কৃষ্ণের সাথে তুলনা করেছেন। দেহ আত্মার মিলন ঘটানোই ছিল সাধকের সাধনা।        বাউল সাধক চান মিয়া উপরোক্ত গানটি রচনা করেছেন। নেত্রকোনা জেলার খাটপুরা গ্রামে ১৩২৫ বঙ্গাব্দে সাধক চান মিয়ার জন্ম। পুরো নাম চান্দেজ্জামান আকন্দ হলেও বা...

বাউল, বাউলতত্ব এবং কিছু কথা

একজন ভদ্র বন্ধু বরের সাথে বাউল সম্প্রদায় নিয়ে বেশ তর্ক হলো রাতে। তর্কের সূত্রপাত ছিল বাউলরা ভাববাদী না বস্তুবাদী। ভাবলাম "বাউলতত্ত্ব"র আলোকে বাউলরা ভাববাদী নাকি বস্তুবাদী তা নিয়ে যৌক্তিক আলোচনা আবশ্যম্ভাবী। কয়েকটি ধারাবাহিক পর্ব লিখে নিজের মনোভাব বোঝানোর চেষ্টা করব।  শুরুতেই শক্তিনাথ ঝাঁ এর বস্তুবাদী বাউল বই থেকে কিছু কথা লিখতে চাই; বাস্তব জগত ও জীবনকে এরা কোন আনুমানিক যুক্তি বা আলৌকিক যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে নারাজ। জৈব রাসায়নিক ব্যাখায় এরা নারীর রজঃ এবং পুরুষের বিজে জীবন ও জগত সৃষ্টিকে ব্যাখা করে এবং চার ভূতকে প্রাকৃতিক সৃষ্টি মনে করে। এভাবে মানুষে, প্রকৃতিতে তৈরি করে প্রাণ, প্রাণী। অনুমান ভিত্তিক স্বর্গ, নরক, পরলোক, পুনর্জন্মাদি প্রত্যক্ষ প্রমাণাভাবে বাউল আগ্রাহ্য করে। মানুষ ব্যাতিরিক্ত ঈশ্বরও এরা মানে না। সৃষ্টির নিয়মকে জেনে যিনি নিজেকে পরিচালনা করতে শিখেছেন- তিনিই সাঁই। সুস্থ নিরোগ দীর্ঘজীবন এবং আনন্দকে অনুভব করার বাউল সাধনা এক আনন্দমার্গ।।  বাউলরা ভাববাদী না বস্তুবাদী এর অনেক সূক্ষ বিশ্লেষণ শক্তিনাথের বস্তুবাদী বাউল বইটির মধ্যে আলকপাত করা হয়েছে। সাধারণ সমাজে এ ধা...

ভাইবে রাধারমণ

তখন কলেজের ছাত্র। বাংলা বিভাগের প্রভাষক শ্রদ্ধেয় রেজা স্যারের সাথে খুবই ভালো সম্পর্ক। কলেজের প্রথম দিনই স্যারকে খুব পছন্দ। তারপর স্যারের সাথে গল্প, সমাজ, রাজনীতি, সাহিত্য নিয়ে আলোচনা। রীতিমত ফিজিক্স, বায়োলোজি ক্লাস ফাঁকি দিলেও বাংলা ক্লাস কখনই ফাঁকি দিতাম না। খুব উপভোগ করতাম স্যারের ক্লাস। হোস্টেল সুপার হিসেবে স্যার ( ওহী আলম রেজা) আমাদের সাথেই থাকতেন। আমরা আসার প্রায় নয় মাস পর স্যার এলেন সুপার হিসেবে। প্রতিদিন রাতে খাবার পরেই স্যারের রুমে গিয়ে আড্ডা হত, গানের আসর হত। স্যারের পিসিতে প্রায়ই গান শুনতাম আমরা। একদিন হঠাৎ করেই একটি গান স্যার প্লে করলেন 'আমার বন্ধু দয়াময় তোমারে দেখিবার মনে লয়। তোমারে না দেখলে রাধার জীবন কেমনে রয় বন্ধুরে।। কদম ডালে বইসারে বন্ধু ভাঙ্গ কদম্বের আগা। শিশুকালে প্রেম শিখাইয়া যৌবনকালে দাগা রে।। তমাল ডালে বইসারে বন্ধু বাজাও রঙের বাশি। সুর শুনিয়া রাধার মন হইলো যে উদাসি রে।। ভাইবে রাধা রমন বলে মনেতে ভাবিয়া। নিভা ছিল মনের আগুন কে দিলাই জ্বালাইয়া রে।' গানের কথাগুলো বেশ ভালো লেগে গেলো। পুর গানটি শুনে বুঝলাম গানটি সাধক রাধারম...