নিরিবিলি গলি, বিকেলের পড়ন্ত সূর্যের আলোয় বয়ে যায় সোনালী বর্ণের আভা। একটি পার্ক, কয়েকটি আবাসিক ভবন এবং একটি সরকারী অফিস জুড়ে আছে গলির ডানে এবং বামে। খুব একটা জনসমাগম নেই গলির ভেতরে। শেষ বিকেলে ক্লান্ত শরীরে অফিস ত্যাগ করছেন কর্মকর্তা কর্মচারীরা। শান্ত বিকেলে কচিকাঁচায় মুখোরিত পার্ক।
প্যারিস শহরে ৭৫০১৩ পোস্টাল কোড এলাকায় অবস্থান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সড়কের। স্থানীয় ফরাসী ভাষায় বলা হয়ে থাকে 'রু'ই টেগর'। ১২৬ মিটার দৈর্ঘ এবং ১২ মিটার প্রস্থের সড়কটি যুক্ত হয়েছে আঞ্চলিক সড়ক এভিনিউ ডি ইটালি'র সাথে। এই সড়কের মধ্যে অবস্থিত স্থানীয় জোয়ান-মিরো পার্ক। ফ্রান্সের প্রশাসনিক এলাকা প্যারিস প্রিফিকচার জোনের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী এই সড়কের আদি নাম ছিল রেমন্ড প্যাসেজ। ফরাসী বিপ্লবের আগে এই রাস্তাটি ছিলো মাটির বা কাঁচা রাস্তা, তখন এখানে পার্ক বা কোন ভবন ছিলো না। ১৯১৩ সালে এখানে একটি ছোট সন্ত্রাসী হামলা ঘটেছিলো এবং যেখানে একজন মানুষ নিহত হয়েছিলেন বন্দুকধারীর গুলিতে। ১৯ জুন, ১৯১৩, সন্ধ্যা পাঁচটায় এই সড়কের সম্মুখ বারে এই ঘটনা ঘটে। তখন থেকে এর নাম ছিল রেমন্ড প্যাসেজ। পরবর্তীতে ১৯৩৮ সালে এটি প্রশস্ত করা হয়েছিল এবং সর্বশেষ ১২ আগস্ট ১৯৯২ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্মানে এই রাস্তার নামকরণ করা হয় 'রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সড়ক'।
এই সড়কের ভেতরেই জোয়ান-মিরো নামের পার্কে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি ভাস্কর্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে বসে কোন এক সময় কবিতা লিখেছেন এমন একটি আদলে তৈরি করা হয়েছে ভাস্কর্যটি। পার্কের প্রবেশ পথের সাথেই বামপাশে রয়েছে ভাস্কর্যটি। ভাস্কর্যটির নিচে খোদাই করে লিখা আছে ঠাকুরের জন্ম এবং মৃত্যু সাল।
দিনের শেষ লগ্নে শান্ত পার্কে বসে বসে দেখছিলাম রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর্যটিকে। দুই বাংলার হাজার শত বাঙ্গালী প্যারিসে অবস্থান করার পরও এই ভাস্কর্যটির কাছে এখন পর্যন্ত কোন আয়োজন করেননি কেউ। জন্ম মৃত্যুর তারিখ চলে গলেও শ্রদ্ধার্ঘ জানানো হয় না একটি গোলাপ বা রজনীগন্ধা দিয়ে। তবে এটি হতে পারতো প্যারিসে বসবাসরত বাঙ্গালীদের আড্ডা বা মিলন মেলার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু।
প্যারিস ভ্রমণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং নিজেও এসেছিলেন। ১৯০৯ থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত আলবার্ট কান ২৩ জন নোবেল বিজয়ীসহ বিশ্বের প্রায় ৪০০০ অর্থনীতিবিদ, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, আর্টিস্টকে তাঁর বাগানে আমন্ত্রণ করেন এবং তাঁর নিযুক্ত এই ফটোগ্রাফার এবং সিনেমাটোগ্রাফাররা এই বিশ্বখ্যাত অতিথিদের নিয়ে ফটোগ্রাফি ও চলচ্চিত্রে ডকুমেন্টারি তৈরি করেন। আমন্ত্রণ জানানো হয় বাংলা সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে ১৯২১ এবং ১৯৩০ সালে দুই বার ফ্রান্সে আগমন করেন এবং কর্মসূচিতে যোগ দেন।
প্যারিসের কোন মোটরে বসে, কোন সড়ক অতিক্রম করে যেতে হবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সড়কে। খুব সহজে পৌছে যাওয়া যায়। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস শহরের যেকোন মেট্রো, ট্রাম বা বাসে করে যাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সড়কে। সহযে পৌছা যায় স্থানীয় মেট্রো লাইন ৭ কিংবা ১৪, ট্রাম ৩'এ এবং বাস ৪৭, ১৩১ বা ১৮৬ ধরে। সড়কের প্রবেশের পাশেই আছে কফির রেস্তোরা এবং বিভিন্ন খাদ্য সামগীর দোকান।
সড়কটির প্রবেশ পথেই হাতের ডানদিকে নীল রঙের বোর্ডে নকশা করে লিখা আছে 'রু'ই টেগর'। নিচে ছোট করে লিখা আছে কবির জন্ম এবং মৃত্যু সাল, এবং সাথে নোবেল বিজয়ের কালজয়ী তকমা।
লিখেছেনঃ চৌধুরী মারূফ, সাংবাদিক
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন