সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

লকডাউনে ❛আনলকড❜ চা শ্রমিকেরা

দেড় শতাধিক চা বাগান খোলা রেখে সিলেট বিভাগের সকল জেলা স্ব স্ব প্রশাসনের নির্দেশে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। এসকল চা বাগানে স্থায়ী ও অস্থায়ী প্রায় দেড় লক্ষাধিক শ্রমিক রয়েছে। আর পরিবারের সদস্যসহ প্রায় ১২ লাখের বেশি চা জনগোষ্ঠী বাগানগুলোতে বসবাস করে।

গত ৩১ মার্চ গণভবন থেকে জেলা প্রশাসকসহ মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও চা বাগানের কাজ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে মত দেন। ভিডিও কনফারেন্সে সিলেট জেলার ডেপুটি কমিশনার এম কাজী এমদাদুল ইসলাম সিলেটে কয়েকটি চা বাগানে শ্রমিকদের কর্মবিরতি ও দুটি বাগানে শ্রমিকরা কাজে যোগ দিচ্ছেন না বলে প্রধানমন্ত্রীকে জানান।এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, উৎপাদনমুখী, রপ্তানিমুখী খাত চালু রাখতে হবে। আর চা শ্রমিকরা যখন পাতা তোলে তখন তারা বিক্ষিপ্তভাবে দূরে দূরে তোলে। চা শ্রমিকরা এমনিতেই প্রকৃতির সাথে থাকে আর চা বাগানে যেহেতু সংক্রমণও নাই, সুতরাং ভয় পাওয়ারও কিছু নাই। শুধুমাত্র পাতা যখন জমা করবে তখন লাইন ধরে দূরত্ব বজায় রেখে দেবে।

রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের কাছ থেকে এমন অবিবেচনাপ্রসূত বক্তব্যের মাধ্যমে বোঝা যায় চা বাগান ও চা শ্রমিক বিষয়ে এই সরকারের কোনো ধারণা নাই। ঠিক কী ধরনের পরিবেশে দেশের চা শ্রমিকদের কাজ করতে হয়, তা নিয়ে একটি গবেষণা পরিচালনা করেছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)। ‘আ স্টাডি রিপোর্ট অন ওয়ার্কিং কন্ডিশনস অব টি প্লান্টেশন ওয়ার্কার্স ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের চা শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার বিষয়টি চরমভাবে উপেক্ষিত। চা শ্রমিকদের ৬৩ শতাংশই রয়েছেন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। দেশের ১০টি চা বাগানের ২৯৭ জন শ্রমিকের তথ্যের ভিত্তিতে গবেষণাটি করা হয়েছে। এছাড়া ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশন করা হয়েছে ছয়টি। সেখানে ছিলেন পঞ্চায়েত, শ্রমিক, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি, চা বাগানের ব্যবস্থাপক ও সরকারের প্রতিনিধিরাও। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করলেও ঝড়-বৃষ্টিতে আশ্রয় নেয়ার মতো ব্যবস্থা নেই কর্মক্ষেত্রের পাশে। বিশ্রামও সেভাবে পান না শ্রমিক।
অভাব রয়েছে নিরাপত্তা কিটস, টয়লেট সুবিধার। কর্মক্ষেত্রে হয়রানি ছাড়াও পুষ্টিকর খাদ্য না পাওয়ার কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে চা শ্রমিকদের মধ্যে। স্বাস্থ্যের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব টের পান ৭৫ শতাংশের বেশি চা শ্রমিক। ৮৪ শতাংশ চা শ্রমিক ভোগেন মাথাব্যথায়। মাংসপেশির ব্যথা নিয়েও কাজ করেন ৭৪ শতাংশ শ্রমিক। আর পিঠের ব্যথায় আক্রান্ত চা শ্রমিকদের ৭২ শতাংশ ও ৬৫ শতাংশের বেশি শ্রমিকের চর্মরোগ রয়েছে। বিষাক্ত পোকামাকড় ও কীটনাশক থেকে বাচার জন্য কর্মক্ষেত্রে কোন ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থা যেমন বুট, সুরক্ষা কবজ, মাস্ক, গ্লাভসের ব্যবহার নেই। তেমনই অরক্ষিত কর্ম এলাকা বা চা কারখানার শ্রমিকদের রয়েছে অমানবিক পরিশ্রমের ফলে সৃষ্ট মানষিক চাপ। শ্রম আইনে বাধ্যতামূলক ভাবে কর্মক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের জন্য পৃথক শৌচাগার নির্মাণের কথা বলা থাকলেও চা শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এ ধরণের কোন ব্যবস্থা নেই। চা শ্রমিকদের মাঝে মাত্র ১৩ শতাংশ কর্মক্ষেত্রে ছায়াযুক্ত স্থানে অর্থাৎ গাছের ছায়ায় বিশ্রাম ও আহারের সুযোগ পায়। বাকিদের তীব্র দাবদাহ অথবা ঝড় বৃষ্টিতেই বিশ্রাম নিতে হয়। গবেষণাতে বলা হয়েছে বছরের সব মৌসুমে বিশুদ্ধ পানির সুবিধা পায় এমন চা বাগানের সংখ্যা খুবই কম। চা বাগানের স্বাস্থ্যকেন্দ্র গুলোতে একজন কম্পাউডারের নেতৃত্বে গুটি কয়েক স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছে যারা বিভিন্ন অসুখে প্রায় একই রকমের ঔষধ সরবরাহ করে থাকে। আর এ সকল ঔষধের নিম্নমানের ব্যাপারে প্রায় সকল শ্রমিকের অভিযোগ রয়েছে। চা শ্রমিকদের চিকিৎসা সুবিধায় ৬৮ শতাংশ শ্রমিকই অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন বলে গবেষণায় আরও উল্লেখ করা হয়।

বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে যারা তুলনামূলক দুর্বল, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম কিংবা পূর্বেই বিভিন্ন শারীরিক ব্যাধিতে আক্রান্ত তাদের মৃত্যু ঝুঁকি বেশি। কাজেই বাংলাদেশে প্রেক্ষাপটে করোনা ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি চা জনগোষ্ঠীর। এমন পরিস্থিতিতে চা বাগানগুলো খোলা রেখে প্রশাসনিকভাবে লকডাউন ঘোষণা একটি অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত হতে যাচ্ছে এতে কোনো সন্দেহ নেই।

২০১৯ সালে দীর্ঘ ১৬৬ বছরের দেশের চা শিল্পের ইতিহাসে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ চা উৎপাদনের নতুন রেকর্ড গড়ে বাংলাদেশ। চা শ্রমিকদের অমানবিক পরিশ্রমের উপর টিকে থাকা দেশের চা শিল্প এখন জাতীয় জিডিপিতে প্রায় ১% অবদান রাখছে। পুরো বিশ্বকে স্তম্ভিত করা এই অতিমারীর সময়েও চা শ্রমিকেরা উচ্চ ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে যেখানে বিভিন্ন রপ্তানিযোগ্য শিল্পখাতের শ্রমিকদেরও স-মজুরিতে ছুটি দেয়া হয়েছে। লকডাউনের সময়কালে চা বাগানের এই কর্মযজ্ঞ দেখে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে চা শ্রমিকদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে বাগান মালিকেরা ও সরকার এ বছর নতুন রেকর্ডের স্বপ্নে বিভোর।

সরকার-বাগান মালিকদের তোষামোদি ও লেজুড়বৃত্তির চর্চায় নিয়োজিত চা শ্রমিক ইউনিয়নও চা শ্রমিকদের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের সময় চা বাগানে ঐতিহাসিক 'সোলেমান হটাও' আন্দোলনের প্রেক্ষাপট সম্ভবত তাদের মনে নেই। ব্রিটিশ শাসকদের তাবেদার হয়ে স্ব-ঘোষিত চা শ্রমিক নেতা সোলেমান খান বিভিন্ন সময় শ্রমিকদের দাবি দাওয়া, অসন্তুষ্টি কিংবা বিদ্রোহ দমনের কাজেই নিয়োজিত ছিলো। ফলে বিক্ষুব্ধ চা শ্রমিকেরা সোলেমান খানকে বাগান থেকে বের করে দেন। পরবর্তীতে যারা চা শ্রমিক ইউনিয়নের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তারাও একই কায়দায় দীর্ঘ সময় শ্রমিক ইউনিয়ন পরিচালনা করেন। শ্রমিক অধিকারে কথা না বলে বিভিন্ন সময়ে সরকার ও মালিকপক্ষের হয়ে সংক্ষুব্ধ চা নিবৃত করতেই বেশি মনোযোগ ছিলো তাদের। ফলে পূর্ণ স্বাধীন চা শ্রমিক ইউনিয়ন গঠনের স্বপ্ন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে চা বাগানে যে 'সোলেমান হটাও' আন্দোলন হয়েছিলো তার বাস্তবায়ন আজো হয়নি। কাজেই লেজুরবৃত্তি থেকে মুক্ত স্বাধীন চা শ্রমিক ইউনিয়ন এখন সময়ের দাবি।

সরকার জিডিপি বোঝে গরীব মানুষ বোঝে না। অধিক লাভ কিংবা জিডিপির আশায় চা শ্রমিকদের মৃত্যুর মুখে পর্যবসিত করে উন্নয়নের বুলি দেশের আপামর জনগণ সহ্য করবে না। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ২০১৮ সালের চা মেলায় চা শ্রমিকদের বাড়ি বানানোর জন্য মালিকদের ২ শতাংশ হারে ঋণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। বাস্তবে এর কোন হদিস নেই এখনো। চা শ্রমিকদের দীর্ঘদিনের দাবির পর প্রথমবারের মতো গঠিত চা শ্রমিকদের জন্য পৃথক মজুরি বোর্ড গত বছরের অক্টোবরে গঠিত হলেও এখনো নতুন মজুরি নির্ধারিত হয় নি। কাজেই বলতে চাই উন্নয়নের মূলা ঝুলিয়ে চা শ্রমিকদের সাথে ধোঁকাবাজির পরিণাম ভয়াবহ হবে। মহামারী করোনায় সর্বোচ্চ মৃত্যুঝুঁকিতে থাকা চা শ্রমিকদের অবিলম্বে সমজুরিতে ছুটিসহ পর্যাপ্ত চিকিৎসা সহায়তা প্রদান না করলে এর বিপরীতে সরকার-বাগান মালিক-শ্রমিক ইউনিয়ন সবাইকেই চড়া মূল্য দানের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। রাষ্ট্রের অবহেলায় উপেক্ষিত চা শ্রমিকদের সেই বিদ্রোহ কেউ দমাতে পারবে না।
দেড় শতাধিক চা বাগান খোলা রেখে সিলেট বিভাগের সকল জেলা স্ব স্ব প্রশাসনের নির্দেশে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। এসকল চা বাগানে স্থায়ী ও অস্থায়ী প্রায় দেড় লক্ষাধিক শ্রমিক রয়েছে। আর পরিবারের সদস্যসহ প্রায় ১২ লাখের বেশি চা জনগোষ্ঠী বাগানগুলোতে বসবাস করে।

গত ৩১ মার্চ গণভবন থেকে জেলা প্রশাসকসহ মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও চা বাগানের কাজ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে মত দেন। ভিডিও কনফারেন্সে সিলেট জেলার ডেপুটি কমিশনার এম কাজী এমদাদুল ইসলাম সিলেটে কয়েকটি চা বাগানে শ্রমিকদের কর্মবিরতি ও দুটি বাগানে শ্রমিকরা কাজে যোগ দিচ্ছেন না বলে প্রধানমন্ত্রীকে জানান।এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, উৎপাদনমুখী, রপ্তানিমুখী খাত চালু রাখতে হবে। আর চা শ্রমিকরা যখন পাতা তোলে তখন তারা বিক্ষিপ্তভাবে দূরে দূরে তোলে। চা শ্রমিকরা এমনিতেই প্রকৃতির সাথে থাকে আর চা বাগানে যেহেতু সংক্রমণও নাই, সুতরাং ভয় পাওয়ারও কিছু নাই। শুধুমাত্র পাতা যখন জমা করবে তখন লাইন ধরে দূরত্ব বজায় রেখে দেবে।

রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের কাছ থেকে এমন অবিবেচনাপ্রসূত বক্তব্যের মাধ্যমে বোঝা যায় চা বাগান ও চা শ্রমিক বিষয়ে এই সরকারের কোনো ধারণা নাই। ঠিক কী ধরনের পরিবেশে দেশের চা শ্রমিকদের কাজ করতে হয়, তা নিয়ে একটি গবেষণা পরিচালনা করেছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)। ‘আ স্টাডি রিপোর্ট অন ওয়ার্কিং কন্ডিশনস অব টি প্লান্টেশন ওয়ার্কার্স ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের চা শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার বিষয়টি চরমভাবে উপেক্ষিত। চা শ্রমিকদের ৬৩ শতাংশই রয়েছেন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। দেশের ১০টি চা বাগানের ২৯৭ জন শ্রমিকের তথ্যের ভিত্তিতে গবেষণাটি করা হয়েছে। এছাড়া ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশন করা হয়েছে ছয়টি। সেখানে ছিলেন পঞ্চায়েত, শ্রমিক, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি, চা বাগানের ব্যবস্থাপক ও সরকারের প্রতিনিধিরাও। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করলেও ঝড়-বৃষ্টিতে আশ্রয় নেয়ার মতো ব্যবস্থা নেই কর্মক্ষেত্রের পাশে। বিশ্রামও সেভাবে পান না শ্রমিক।
অভাব রয়েছে নিরাপত্তা কিটস, টয়লেট সুবিধার। কর্মক্ষেত্রে হয়রানি ছাড়াও পুষ্টিকর খাদ্য না পাওয়ার কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে চা শ্রমিকদের মধ্যে। স্বাস্থ্যের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব টের পান ৭৫ শতাংশের বেশি চা শ্রমিক। ৮৪ শতাংশ চা শ্রমিক ভোগেন মাথাব্যথায়। মাংসপেশির ব্যথা নিয়েও কাজ করেন ৭৪ শতাংশ শ্রমিক। আর পিঠের ব্যথায় আক্রান্ত চা শ্রমিকদের ৭২ শতাংশ ও ৬৫ শতাংশের বেশি শ্রমিকের চর্মরোগ রয়েছে। বিষাক্ত পোকামাকড় ও কীটনাশক থেকে বাচার জন্য কর্মক্ষেত্রে কোন ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থা যেমন বুট, সুরক্ষা কবজ, মাস্ক, গ্লাভসের ব্যবহার নেই। তেমনই অরক্ষিত কর্ম এলাকা বা চা কারখানার শ্রমিকদের রয়েছে অমানবিক পরিশ্রমের ফলে সৃষ্ট মানষিক চাপ। শ্রম আইনে বাধ্যতামূলক ভাবে কর্মক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের জন্য পৃথক শৌচাগার নির্মাণের কথা বলা থাকলেও চা শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এ ধরণের কোন ব্যবস্থা নেই। চা শ্রমিকদের মাঝে মাত্র ১৩ শতাংশ কর্মক্ষেত্রে ছায়াযুক্ত স্থানে অর্থাৎ গাছের ছায়ায় বিশ্রাম ও আহারের সুযোগ পায়। বাকিদের তীব্র দাবদাহ অথবা ঝড় বৃষ্টিতেই বিশ্রাম নিতে হয়। গবেষণাতে বলা হয়েছে বছরের সব মৌসুমে বিশুদ্ধ পানির সুবিধা পায় এমন চা বাগানের সংখ্যা খুবই কম। চা বাগানের স্বাস্থ্যকেন্দ্র গুলোতে একজন কম্পাউডারের নেতৃত্বে গুটি কয়েক স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছে যারা বিভিন্ন অসুখে প্রায় একই রকমের ঔষধ সরবরাহ করে থাকে। আর এ সকল ঔষধের নিম্নমানের ব্যাপারে প্রায় সকল শ্রমিকের অভিযোগ রয়েছে। চা শ্রমিকদের চিকিৎসা সুবিধায় ৬৮ শতাংশ শ্রমিকই অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন বলে গবেষণায় আরও উল্লেখ করা হয়।

বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে যারা তুলনামূলক দুর্বল, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম কিংবা পূর্বেই বিভিন্ন শারীরিক ব্যাধিতে আক্রান্ত তাদের মৃত্যু ঝুঁকি বেশি। কাজেই বাংলাদেশে প্রেক্ষাপটে করোনা ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি চা জনগোষ্ঠীর। এমন পরিস্থিতিতে চা বাগানগুলো খোলা রেখে প্রশাসনিকভাবে লকডাউন ঘোষণা একটি অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত হতে যাচ্ছে এতে কোনো সন্দেহ নেই।

২০১৯ সালে দীর্ঘ ১৬৬ বছরের দেশের চা শিল্পের ইতিহাসে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ চা উৎপাদনের নতুন রেকর্ড গড়ে বাংলাদেশ। চা শ্রমিকদের অমানবিক পরিশ্রমের উপর টিকে থাকা দেশের চা শিল্প এখন জাতীয় জিডিপিতে প্রায় ১% অবদান রাখছে। পুরো বিশ্বকে স্তম্ভিত করা এই অতিমারীর সময়েও চা শ্রমিকেরা উচ্চ ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে যেখানে বিভিন্ন রপ্তানিযোগ্য শিল্পখাতের শ্রমিকদেরও স-মজুরিতে ছুটি দেয়া হয়েছে। লকডাউনের সময়কালে চা বাগানের এই কর্মযজ্ঞ দেখে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে চা শ্রমিকদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে বাগান মালিকেরা ও সরকার এ বছর নতুন রেকর্ডের স্বপ্নে বিভোর।

সরকার-বাগান মালিকদের তোষামোদি ও লেজুড়বৃত্তির চর্চায় নিয়োজিত চা শ্রমিক ইউনিয়নও চা শ্রমিকদের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের সময় চা বাগানে ঐতিহাসিক 'সোলেমান হটাও' আন্দোলনের প্রেক্ষাপট সম্ভবত তাদের মনে নেই। ব্রিটিশ শাসকদের তাবেদার হয়ে স্ব-ঘোষিত চা শ্রমিক নেতা সোলেমান খান বিভিন্ন সময় শ্রমিকদের দাবি দাওয়া, অসন্তুষ্টি কিংবা বিদ্রোহ দমনের কাজেই নিয়োজিত ছিলো। ফলে বিক্ষুব্ধ চা শ্রমিকেরা সোলেমান খানকে বাগান থেকে বের করে দেন। পরবর্তীতে যারা চা শ্রমিক ইউনিয়নের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তারাও একই কায়দায় দীর্ঘ সময় শ্রমিক ইউনিয়ন পরিচালনা করেন। শ্রমিক অধিকারে কথা না বলে বিভিন্ন সময়ে সরকার ও মালিকপক্ষের হয়ে সংক্ষুব্ধ চা নিবৃত করতেই বেশি মনোযোগ ছিলো তাদের। ফলে পূর্ণ স্বাধীন চা শ্রমিক ইউনিয়ন গঠনের স্বপ্ন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে চা বাগানে যে 'সোলেমান হটাও' আন্দোলন হয়েছিলো তার বাস্তবায়ন আজো হয়নি। কাজেই লেজুরবৃত্তি থেকে মুক্ত স্বাধীন চা শ্রমিক ইউনিয়ন এখন সময়ের দাবি।

সরকার জিডিপি বোঝে গরীব মানুষ বোঝে না। অধিক লাভ কিংবা জিডিপির আশায় চা শ্রমিকদের মৃত্যুর মুখে পর্যবসিত করে উন্নয়নের বুলি দেশের আপামর জনগণ সহ্য করবে না। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ২০১৮ সালের চা মেলায় চা শ্রমিকদের বাড়ি বানানোর জন্য মালিকদের ২ শতাংশ হারে ঋণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। বাস্তবে এর কোন হদিস নেই এখনো। চা শ্রমিকদের দীর্ঘদিনের দাবির পর প্রথমবারের মতো গঠিত চা শ্রমিকদের জন্য পৃথক মজুরি বোর্ড গত বছরের অক্টোবরে গঠিত হলেও এখনো নতুন মজুরি নির্ধারিত হয় নি। কাজেই বলতে চাই উন্নয়নের মূলা ঝুলিয়ে চা শ্রমিকদের সাথে ধোঁকাবাজির পরিণাম ভয়াবহ হবে। মহামারী করোনায় সর্বোচ্চ মৃত্যুঝুঁকিতে থাকা চা শ্রমিকদের অবিলম্বে সমজুরিতে ছুটিসহ পর্যাপ্ত চিকিৎসা সহায়তা প্রদান না করলে এর বিপরীতে সরকার-বাগান মালিক-শ্রমিক ইউনিয়ন সবাইকেই চড়া মূল্য দানের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। রাষ্ট্রের অবহেলায় উপেক্ষিত চা শ্রমিকদের সেই বিদ্রোহ কেউ দমাতে পারবে না।

 লেখক- মিখা পিরেগু: সভাপতি, ছাত্র ইউনিয়ন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সংসদ; সহসভাপতি, বিশ্ববিদ্যালয় চা ছাত্র সংসদ।




মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাউল সাধক চান মিয়া এবং আমার কিছু উপলব্ধি

"রজনী হইসনা অবসান  আজ নিশিতে আসতে পারেবন্ধু কালাচাঁন।। কত নিশি পোহাইলোমনের আশা মনে রইলো রে কেন বন্ধু আসিলোনা জুড়ায়না পরান। আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন।। বাসর সাজাই আসার আশেআসবে বন্ধু নিশি শেষে দারূন পিরিতের বিষে ধরিল উজান। আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন।। মেঘে ঢাকা আঁধার রাতে কেমনে থাকি একা ঘরে সাধক চাঁনমিয়া কয় কানতে কানতে হইলাম পেরেশান আজ নিশিতে আসতে বন্দু কালাচাঁন।"    গভীর নিশিতে ধ্যান মগ্ন হয়ে কালাচাঁনের অপেক্ষা করছেন সাধক।  সাধক চান মিয়ার শিষ্য বাউল সিরাজউদ্দিনের মতে এটি একটি রাই বিচ্ছেদ। কৃষ্ণের অপেক্ষায় রাধা নিশি বা রাতকে অনুরোধ করছেন 'রাত' যেন না পোহায়  কারণ তার কালা চান যে কোন সময় আসতে পারে। শব্দগুচ্ছ গুলো থেকে সহজেই উপলব্ধি হয় সাধক নিজ দেহকে রাধা আর আত্মাকে কৃষ্ণের সাথে তুলনা করেছেন। দেহ আত্মার মিলন ঘটানোই ছিল সাধকের সাধনা।        বাউল সাধক চান মিয়া উপরোক্ত গানটি রচনা করেছেন। নেত্রকোনা জেলার খাটপুরা গ্রামে ১৩২৫ বঙ্গাব্দে সাধক চান মিয়ার জন্ম। পুরো নাম চান্দেজ্জামান আকন্দ হলেও বা...

বাউল, বাউলতত্ব এবং কিছু কথা

একজন ভদ্র বন্ধু বরের সাথে বাউল সম্প্রদায় নিয়ে বেশ তর্ক হলো রাতে। তর্কের সূত্রপাত ছিল বাউলরা ভাববাদী না বস্তুবাদী। ভাবলাম "বাউলতত্ত্ব"র আলোকে বাউলরা ভাববাদী নাকি বস্তুবাদী তা নিয়ে যৌক্তিক আলোচনা আবশ্যম্ভাবী। কয়েকটি ধারাবাহিক পর্ব লিখে নিজের মনোভাব বোঝানোর চেষ্টা করব।  শুরুতেই শক্তিনাথ ঝাঁ এর বস্তুবাদী বাউল বই থেকে কিছু কথা লিখতে চাই; বাস্তব জগত ও জীবনকে এরা কোন আনুমানিক যুক্তি বা আলৌকিক যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে নারাজ। জৈব রাসায়নিক ব্যাখায় এরা নারীর রজঃ এবং পুরুষের বিজে জীবন ও জগত সৃষ্টিকে ব্যাখা করে এবং চার ভূতকে প্রাকৃতিক সৃষ্টি মনে করে। এভাবে মানুষে, প্রকৃতিতে তৈরি করে প্রাণ, প্রাণী। অনুমান ভিত্তিক স্বর্গ, নরক, পরলোক, পুনর্জন্মাদি প্রত্যক্ষ প্রমাণাভাবে বাউল আগ্রাহ্য করে। মানুষ ব্যাতিরিক্ত ঈশ্বরও এরা মানে না। সৃষ্টির নিয়মকে জেনে যিনি নিজেকে পরিচালনা করতে শিখেছেন- তিনিই সাঁই। সুস্থ নিরোগ দীর্ঘজীবন এবং আনন্দকে অনুভব করার বাউল সাধনা এক আনন্দমার্গ।।  বাউলরা ভাববাদী না বস্তুবাদী এর অনেক সূক্ষ বিশ্লেষণ শক্তিনাথের বস্তুবাদী বাউল বইটির মধ্যে আলকপাত করা হয়েছে। সাধারণ সমাজে এ ধা...

ভাইবে রাধারমণ

তখন কলেজের ছাত্র। বাংলা বিভাগের প্রভাষক শ্রদ্ধেয় রেজা স্যারের সাথে খুবই ভালো সম্পর্ক। কলেজের প্রথম দিনই স্যারকে খুব পছন্দ। তারপর স্যারের সাথে গল্প, সমাজ, রাজনীতি, সাহিত্য নিয়ে আলোচনা। রীতিমত ফিজিক্স, বায়োলোজি ক্লাস ফাঁকি দিলেও বাংলা ক্লাস কখনই ফাঁকি দিতাম না। খুব উপভোগ করতাম স্যারের ক্লাস। হোস্টেল সুপার হিসেবে স্যার ( ওহী আলম রেজা) আমাদের সাথেই থাকতেন। আমরা আসার প্রায় নয় মাস পর স্যার এলেন সুপার হিসেবে। প্রতিদিন রাতে খাবার পরেই স্যারের রুমে গিয়ে আড্ডা হত, গানের আসর হত। স্যারের পিসিতে প্রায়ই গান শুনতাম আমরা। একদিন হঠাৎ করেই একটি গান স্যার প্লে করলেন 'আমার বন্ধু দয়াময় তোমারে দেখিবার মনে লয়। তোমারে না দেখলে রাধার জীবন কেমনে রয় বন্ধুরে।। কদম ডালে বইসারে বন্ধু ভাঙ্গ কদম্বের আগা। শিশুকালে প্রেম শিখাইয়া যৌবনকালে দাগা রে।। তমাল ডালে বইসারে বন্ধু বাজাও রঙের বাশি। সুর শুনিয়া রাধার মন হইলো যে উদাসি রে।। ভাইবে রাধা রমন বলে মনেতে ভাবিয়া। নিভা ছিল মনের আগুন কে দিলাই জ্বালাইয়া রে।' গানের কথাগুলো বেশ ভালো লেগে গেলো। পুর গানটি শুনে বুঝলাম গানটি সাধক রাধারম...