সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

আমার একলার আকাশ, তাইতে এতো হিসাব নিকাশ

করোনা শুধুই কি ক্ষতি করে গেলো, বহু মানুষের, রাষ্ট্রের, সম্পদের; নাকি দিয়েছেও কাউকে কাউকে কিছু!
আজ ঠায় ঠায় একচল্লিশ দিন ঘরে বসা। সংখ্যাটা বেশ মুল্যবান। জীবনে কাজ শিখে নিজেকে একজন কামলা ঘোষনা দিয়ে দেবার পর একসাথে এতদিন ঘরে থাকার কোন সুযোগই আসেনি এই জীবনে! যাই হোক, বাইরে মানুষ মরছে, রোজকার হিসেব একবার দেখবো না, দেখবো না করেও, সন্ধেবেলা মুখ লুকিয়ে দেখে ফেলি, মুখ লুকাই নিজের কাছ থেকে নিজে। আমার ঘরের পাশে রোজ আটটা বাজলেই একটা সাইরেন বাজে, যেন কোথাও যুদ্ধের দামামা, কেন বাজে ? কারণ জানি না, তবে এই সাইরেন শুনতে পেলেই আমি মৃতের সংখ্যা দেখতে বসি। বেশ খুটিয়ে খুটিয়ে কোন দেশের কজন গেলেন, শাদা নাকি কালো, হিন্দু নাকি মুসলিম, ইহুদি নাকি ক্রিশ্চান, বাচ্চা নাকি বুড়ো, ছেলে নাকি মেয়ে! না অতো খুটিয়ে আর দেখি কই? দেখি আজকে ১৪৫৫+ গেলেন, দেশ ফ্রান্স! এর পরে সকলে জানান, না না এ শুধু হসপিটালের না, এখানকার বৃদ্ধাশ্রম গুলোরও, এ শুধু আজকের না! তা কালকের বা পরশুর লাশগুলো বাসী হয়ে গেল বলে, আজকের হিসাবের সাথে তাকে যোগ করে দিলে বেশ সুবিধা হয় মানুষের মনে! তারা ধরে নেয় আজকে ১৪৫৫+ মরেনি! কিন্তু গত দুই দিনের গড় যে এখানে এসে ৮০০/৯০০ হয়ে যাচ্ছে তাতে মাথা ব্যাথা নেই কারোর। সকলের কথা আজকে তো এতো মরেনি!
এই যে বৃদ্ধাশ্রমের মৃত্যু আলাদা করে গোনা হয় এতে জনমনে বেশ ভাল একটা অনুভুতি দেখি, সকলেই ভেবে নিয়েছেন এরা তো মরবেই, আমি মরবো না! বৃদ্ধ-মানুষ  মরে গেলেই তো ভালো। কি ভালো? জানি না অতো, কিন্তু করোনা এসেছে এতো কঠিন অসুখ, এতে বৃদ্ধরা মরে গেলে আর কি? সরকার কি আর বাঁচাতে পারবে? এদের কি আর চিকিৎসা দিয়ে বাঁচানো যাবে ? মরছে, মরে যাক, মরে বাঁচুক!
যাই হোক, এই যে এতো লাশ, তাতে কি শুধুই মন্দ ব্যাপার! না রাষ্ট্রযন্ত্র বলে যে একটা ব্যাপার আছে, যেখানে আরো নানান পদের হিসাব নিকাশের পরে জনসংখ্যা যার কাছে একটা সংখ্যা শুধু, আর যার নিজস্ব কোন হৃদয় নেই ঈশ্বরের মতন, তার কিন্তু সবটা ক্ষতি নয়! কেনো নয় তাই নিয়ে দু কথা!
এক একজন বৃদ্ধ-মানুষ, এক একজন চলন্ত ইতিহাস, এক একটা পরিবারের হতচ্ছাড়া বটগাছ, এমনি এমনি সংখ্যাটা শুনে বুকে খচ করে উঠে না আর আমাদের! মরবেই তো তাই মরে যাচ্ছে যে! এতো হৃদয়হীন হয়ে গেছি আমরাও রাষ্ট্র-যন্ত্রের মত করে।
তা ধরা যাক এই মুহূর্তে ফ্রান্সে মারা গেছেন ২২০০০+ মানুষ। আমরা চোখ বন্ধ করে ধরে নিতে পারি এর মাঝে ১৫০০০+ মানুষ যারা ষাটোর্ধ অবং নানান ভাবে অসুস্থ্য ছিলেন। সুতরাং সরকার প্রতি মাসে একেবারে নগন্য করে হলেও এই ১৫০০০ মানুষের জন্য মাসে ১০০০ ইউরো করে খরচ করলেও ১৫০০০*১০০০=১৫০০০০০০ ইউরো খরচ করতো প্রতি মাসে ! তাহলে বছরে ১৮ কোটি ইউরো। ধরা যাক এই মানুষ গুলো আরো নিতান্ত ১০ বছর বেঁচে থাকলে সরকারকে এই মানুষদের জন্য খরচ করতে হতো ১৮০ কোটি ইউরো! এই হিসাবটা সর্বনিম্ন হিসাব ধরে একেবারেই আন্দাজ এর মারপ্যাচে করা। তাহলে আমরা দেখি রাষ্ট্রযন্ত্র এক ধাক্কায় এই ক্ষতি থেকে মুক্ত! ক্ষতি বলছি এই কারণে যে এই পরিমাণ অর্থ বরাদ্ধের বিপরীতে এই বয়সের মানুষদের কাছ থেকে সরকারের আর কোন প্রাপ্তি যোগ ছিলো না। সুতরাং যে রাষ্ট্রযন্ত্রকে আমরা ১০০ ভাগ ক্ষতির সম্মুখিন দেখছি সে কিন্তু আসলে ৭০/৮০ ভাগ ক্ষতিতে আছে!
এবার আসা যাক বাদ বাকি মানুষদের কথায়, এই পনেরো হাজারের পরে পরে যারা মারা যাচ্ছেন ধরে নিলাম তারা আরো কম বয়সের সক্ষম মানুষ, কিন্তু তারা কিন্তু আপাত সক্ষম নন। সরকারের কাছে তারাও দায় বৈ আর কিছু নন, এরা সকলেই কোন না কোন ক্ষেত্রে অসুস্থ্য, একেবারেই ফীট যাকে বলে তা নন, এরা সকলেই কোন না কোন রোগ আক্রান্ত, এরা সকলেই এক দিকে আয় করেন অন্য দিকে ঔষধ পথ্য ডাক্তার হাসপাতাল করে সরকারের কাছ থেকে এই সব ক্ষেত্রে ভর্তুকি নেন। সরকার এদের নিয়ে কিন্তু একশো ভাগ খুশী না! এরা তার গুড সোলজার নন!
পশ্চিমা বিশ্বের কাছে এই সংখ্যাতত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যেখানে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসি সেখানে সরকার-যন্ত্র সংখ্যা দিয়েই ভালোবাসবে। তাতেই ডুববে এবং ভাসবে। এই সংখ্যাগুলোকে এখন যদি আপনি দশের ঘরে গুনিতক দিয়ে গুন করেন। মানে এই পনেরো হাজার যদি কোন ভাবে দেড় লক্ষ হয় তবে সরকারের কোষাগারের সঞ্চয়পত্রের হিসাবটা আপনি নিজেই একটু করে দেখুন আপনার মোবাইলের ক্যালকুলেটর দিয়ে! সেটা অবশ্য অনেক সময় কাজ করে না!
গত দেড় মাসের লকডাউন এর নিয়ম-নীতি না মানার কারণে ফ্রান্সে প্রায় ১ লক্ষ লোককে ফাইন করা হয়েছে। ফাইন এর পরিমান সর্বনিম্ন ১৩৫ ইউরো এখন। সেটা নানান কারণে বেড়ে ১৫০০ ইউরো অব্দি যেতে পারে, আবার একজনকে দুইবার ফাইন করার মতন অবস্থা হলে সেটা ৩৭৫০ ইউরো অব্দি যেতে পারে। এই দন্ডে দন্ডিত যারা তাদের টাকাও উসুল হয়েছে, কারণ ১৫ দিনের মাঝে না দিলে দন্ডের পরিমাণ বাড়বে! এক লক্ষ লোক ১৩৫ ইউরো করে নুন্যতম তবে সরকারের কোষাগারে কত দিলেন? যদিও এই এক লক্ষ লোককে খোঁজে বের করতে ১৭ লক্ষ মানুষকে পথে ঘাটে পুলিশ জেরা করেছে বলছে। যাক এই অর্থ সমাগম সরকার চায়নি! এটা অনাকাঙ্ক্ষিত!
আবার দেখুন এখানে অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক কিছুই কিন্তু হলো, যখন একেবারে শুরু শুরুতে এখানে ইলেকশন ছিলো সরকার আমাদের জানালেন ইলেকশন হবে, সকল ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, আপনারা আসবেন হাতে স্যানিটাইজার মাখবেন ভোট দিবেন। ইলেকশন থামিয়ে দেয়ার ক্ষতি সরকারের পোষাবে না! খুব সুচারু ব্যবস্থা! তো তাই হলো, লোকে বিশ্বাস করলো সরকার ঠিক বলছেন। রাস্তা ঘাটে গিজ গিজ করছে লোকজন, সবাই সরকারকে বিশ্বাস করে ঘর থেকে বের হলো, আসল রোগীর সংখ্যা মৃতের সংখ্যা সব লুকিয়ে রেখে এই ইলেকশন হলো! এর পরে আমরা দেখলাম তার ফলাফল! কি দ্রুত একটা দেশ অসহায়ের মত মৃতের মিছিলে ছাড়িয়ে যেতে থাকলো। যাক শেষাবদি আমেরিকা এসে উদ্ধার করায়, ইউরোপ পিছিয়ে পরেছে অনেকখানি! এখন অনেককেই দেখি আর এইসব বিশ বাইশ হাজারের দিকে তাকাতে অত আগ্রহ পান না!
আচ্ছা আমরা সকলে মিলে আরেকটা হিসাব করি না একটু। এই যে এক একটা লাশ শুইয়ে রেখে তার উপরে আরেকটা লাশ রেখে আমরা কত উচু দালান করতে পারবো? একটা মানুষের কাঁধে আরেকটা মানুষ ধরে বাইশ হাজার মানুষ কত দীর্ঘ লাইন হয়? একটা কফিন এর উপরে আরেকটা কফিন রেখে এই বাইশ হাজার কফিন কত উঁচু হয়? আর যেখানে সংখ্যাটা ২ লাখ ছাড়িয়েছে.. কত উঁচুতে গেছে সেই কফিনের, লাশের, হাতে হাত ধরা কিংবা কাঁধে কাধ মিলানো সারি …
আমাদের অনন্ত কত হিসাব বাকি এখনো… ইতিহাস নিশ্চই এভাবেই হিসাব জানাবে, আমার, আপনার, আমাদের …


Sagar Kanti DEB is a book lover, reader,  and founder of “Boiyer Jahaj” (transnational book supplying organisation). An enthusiastic person and newcomer of book publishing in Bangladesh,

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাউল সাধক চান মিয়া এবং আমার কিছু উপলব্ধি

"রজনী হইসনা অবসান  আজ নিশিতে আসতে পারেবন্ধু কালাচাঁন।। কত নিশি পোহাইলোমনের আশা মনে রইলো রে কেন বন্ধু আসিলোনা জুড়ায়না পরান। আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন।। বাসর সাজাই আসার আশেআসবে বন্ধু নিশি শেষে দারূন পিরিতের বিষে ধরিল উজান। আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন।। মেঘে ঢাকা আঁধার রাতে কেমনে থাকি একা ঘরে সাধক চাঁনমিয়া কয় কানতে কানতে হইলাম পেরেশান আজ নিশিতে আসতে বন্দু কালাচাঁন।"    গভীর নিশিতে ধ্যান মগ্ন হয়ে কালাচাঁনের অপেক্ষা করছেন সাধক।  সাধক চান মিয়ার শিষ্য বাউল সিরাজউদ্দিনের মতে এটি একটি রাই বিচ্ছেদ। কৃষ্ণের অপেক্ষায় রাধা নিশি বা রাতকে অনুরোধ করছেন 'রাত' যেন না পোহায়  কারণ তার কালা চান যে কোন সময় আসতে পারে। শব্দগুচ্ছ গুলো থেকে সহজেই উপলব্ধি হয় সাধক নিজ দেহকে রাধা আর আত্মাকে কৃষ্ণের সাথে তুলনা করেছেন। দেহ আত্মার মিলন ঘটানোই ছিল সাধকের সাধনা।        বাউল সাধক চান মিয়া উপরোক্ত গানটি রচনা করেছেন। নেত্রকোনা জেলার খাটপুরা গ্রামে ১৩২৫ বঙ্গাব্দে সাধক চান মিয়ার জন্ম। পুরো নাম চান্দেজ্জামান আকন্দ হলেও বা...

বাউল, বাউলতত্ব এবং কিছু কথা

একজন ভদ্র বন্ধু বরের সাথে বাউল সম্প্রদায় নিয়ে বেশ তর্ক হলো রাতে। তর্কের সূত্রপাত ছিল বাউলরা ভাববাদী না বস্তুবাদী। ভাবলাম "বাউলতত্ত্ব"র আলোকে বাউলরা ভাববাদী নাকি বস্তুবাদী তা নিয়ে যৌক্তিক আলোচনা আবশ্যম্ভাবী। কয়েকটি ধারাবাহিক পর্ব লিখে নিজের মনোভাব বোঝানোর চেষ্টা করব।  শুরুতেই শক্তিনাথ ঝাঁ এর বস্তুবাদী বাউল বই থেকে কিছু কথা লিখতে চাই; বাস্তব জগত ও জীবনকে এরা কোন আনুমানিক যুক্তি বা আলৌকিক যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে নারাজ। জৈব রাসায়নিক ব্যাখায় এরা নারীর রজঃ এবং পুরুষের বিজে জীবন ও জগত সৃষ্টিকে ব্যাখা করে এবং চার ভূতকে প্রাকৃতিক সৃষ্টি মনে করে। এভাবে মানুষে, প্রকৃতিতে তৈরি করে প্রাণ, প্রাণী। অনুমান ভিত্তিক স্বর্গ, নরক, পরলোক, পুনর্জন্মাদি প্রত্যক্ষ প্রমাণাভাবে বাউল আগ্রাহ্য করে। মানুষ ব্যাতিরিক্ত ঈশ্বরও এরা মানে না। সৃষ্টির নিয়মকে জেনে যিনি নিজেকে পরিচালনা করতে শিখেছেন- তিনিই সাঁই। সুস্থ নিরোগ দীর্ঘজীবন এবং আনন্দকে অনুভব করার বাউল সাধনা এক আনন্দমার্গ।।  বাউলরা ভাববাদী না বস্তুবাদী এর অনেক সূক্ষ বিশ্লেষণ শক্তিনাথের বস্তুবাদী বাউল বইটির মধ্যে আলকপাত করা হয়েছে। সাধারণ সমাজে এ ধা...

ভাইবে রাধারমণ

তখন কলেজের ছাত্র। বাংলা বিভাগের প্রভাষক শ্রদ্ধেয় রেজা স্যারের সাথে খুবই ভালো সম্পর্ক। কলেজের প্রথম দিনই স্যারকে খুব পছন্দ। তারপর স্যারের সাথে গল্প, সমাজ, রাজনীতি, সাহিত্য নিয়ে আলোচনা। রীতিমত ফিজিক্স, বায়োলোজি ক্লাস ফাঁকি দিলেও বাংলা ক্লাস কখনই ফাঁকি দিতাম না। খুব উপভোগ করতাম স্যারের ক্লাস। হোস্টেল সুপার হিসেবে স্যার ( ওহী আলম রেজা) আমাদের সাথেই থাকতেন। আমরা আসার প্রায় নয় মাস পর স্যার এলেন সুপার হিসেবে। প্রতিদিন রাতে খাবার পরেই স্যারের রুমে গিয়ে আড্ডা হত, গানের আসর হত। স্যারের পিসিতে প্রায়ই গান শুনতাম আমরা। একদিন হঠাৎ করেই একটি গান স্যার প্লে করলেন 'আমার বন্ধু দয়াময় তোমারে দেখিবার মনে লয়। তোমারে না দেখলে রাধার জীবন কেমনে রয় বন্ধুরে।। কদম ডালে বইসারে বন্ধু ভাঙ্গ কদম্বের আগা। শিশুকালে প্রেম শিখাইয়া যৌবনকালে দাগা রে।। তমাল ডালে বইসারে বন্ধু বাজাও রঙের বাশি। সুর শুনিয়া রাধার মন হইলো যে উদাসি রে।। ভাইবে রাধা রমন বলে মনেতে ভাবিয়া। নিভা ছিল মনের আগুন কে দিলাই জ্বালাইয়া রে।' গানের কথাগুলো বেশ ভালো লেগে গেলো। পুর গানটি শুনে বুঝলাম গানটি সাধক রাধারম...