কথা বলছিলাম বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জ জেলার এম সানির সাথে। অনেক দীর্ঘ কথোপকথন হলও। উনার বক্তব্য তুলে ধরেই শুরু করলাম।
"প্যারিস শহরের পখ দ্যা লাশাপিল এলাকায় বসবাস করি। ২০১৯ সালের প্রথম দিকে আমি ফ্রান্সে আসি। আমি ফ্রান্সের অনিয়মিত একজন বাসিন্দা। গত ১৬ মার্চ থেকে আমার কাজ বন্ধ রয়েছে। খুবই আর্থিক সমস্যার মধ্যে দিন যাপন করছি। আমি যেহেতু অনিয়মিত বাসিন্দা সেহেতু ফ্রান্স সরকার যে বিশেষ আর্থিক প্রণোদনা দিবে তা থেকে আমি কোন উপকৃত হবও না।"
উনার নিচের বক্তব্যটা প্যারিস তথা ফ্রান্সে বসবাস করা অনিয়মিত বাংলাদেশিদের মনের কথা। এখানে এসে ভাষাগত সংস্কৃতিগত কারণে বাংলাদেশি লোকজন অনেক পেছনে। শুধু পেছনে বললে হবে না রীতিমত সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এই সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার বেশ কিছু কারণ রয়েছে । তন্মোধ্যে সবচেয়ে বড় কারণ হলও এখানে ফরাসী ভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষায় লোকজন কথা বলতে চায়না। বিশেষ করে ইংলিশ ত নয়'ই। বেশ কিছু সরকারী অফিস আদালতে আমি গিয়েছি, দেখেছি, কোনভাবে ইংলিশ ভাষায় কথা বললে উনারা (অফিস কর্মকর্তা/কর্মচারী) কথা বলতে চান না। যেমন আমি ব্যক্তিগত ভাবে উর্দু ভষায় কথা বললে তার সাথে কথা বলতে চাইনা ঠিক এই ভাবেই। ভাষাগত এই বৈষম্যের মূল কারণ আমার কাছে মনে হয়েছে কিছুটা ঐতিহাসিক রাজনৈতিক দ্বন্দ্বগত কারণে। যাই হোক যা বলছিলাম, আমরা বাংলাদেশিরা বাংলার পর মডার্ন ভাষা হিসেবে বা ইন্টারন্যাশনাল-শিপ হিসেবে ইংরেজি শিখি , শিখতে চাই। কিন্তু এখানে সেই ইংরেজি ভাষা সচরাচর ব্যবহৃত হয়না বলেই আমরা অনেক কিছুই বোঝতে পারিনা, বোঝাতে পারিনা। আর এই একটি মাত্র কারণে ফ্রান্সে বাংলাদেশি লোকজন অনেক পিছিয়ে।
অপরদিকে আরেকটি কারণ'ও আছে। ফ্রান্সে বসবাসরত বেশির ভাগ বাংলাদেশিরা এখানে এসে পড়ালেখা করেন না, বা ফ্রান্সে বাংলাদেশিদের স্টুডেন্ট ভিসার সুযোগ সুবিধা খুব কম। কম বলতে কি ১ শতাংশ'ও হবেনা। আর এটা খুবই স্বাভাবিক, কোন দেশ বা অঞ্চলে আপনি জাতিগত ভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে সেইখানের আঞ্চলিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। কিন্তু সে সুযোগ না থাকায় আমরা বাংলাদেশিরা অনেক পিছিয়ে।
তৃতীয় ব্যাপারটি হচ্ছে , ইমিগ্র্যান্ট হওয়ার আশায় ফ্রান্সে থাকা বাংলাদেশিরা আওয়ার সেলারি মেইন্টেইন না করেই যেখানে সেখানে কাজে লেগে যান। বিশেষ করে রেস্টুরেন্ট এবং নিত্য প্রয়োজনীয় দোকান গুলোতে ঘণ্টা দুই বা ৩ ইউরো পারিশ্রমিকে কাজে লেগে যান। এই কারণে নিজ তথা দেশে থাকা পরিবারের আর্থিক যোগান মিটাতে দৈনিক বার তেরো ঘণ্টা কাজ করে থাকেন। এটা স্বভাবত স্বাভাবিক, একজন ব্যক্তি যদি বারো তেরো ঘণ্টা দৈনিক শুধু কাজই করে থাকেন তবে ঐ ব্যক্তির অন্য কোন ক্যারিয়ার ডেভলাপিং , নিজেকে নিয়ে চিন্তা করার কোন সুযোগই থাকেনা । এভাবে প্রতিবছর কার্ড নবায়ন করার জন্য কাজ করে যেতেই হয় এবং দীর্ঘ সময় এভাবে কাজ করতে করতে নিজে উদ্যোক্তা হওয়ার সম্ভাবনা বেশির ভাগই হাতছাড়া করে ফেলেন ।
এ'ত গেলো সহজে উপলব্ধি করা সমস্যা আরো কিছু সমস্যা আছে ফ্রান্সে বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীর মধ্যে, যা নীরব, এন্টার্নাল। উপর থেকে বোঝা যায়না কিন্তু বিষ ফোঁড়ার মত। ফ্রান্সে বিশেষ করে প্যারিসে আবাসন সংকট এক মহা সংকটের নাম। এখানে নিজের একটি বাসা থাকা মানে সোনার হরিণ। বেশির ভাগ ক্ষেত্র্ পঁচাত্তর শতাংশ বাংলাদেশি লোকজন এখানে ম্যাছ বা বাউন্ডিং ব্যাচেলর সিস্টেমে বসবাস করেন। ছোট একটি ঘরে আঁট নয়জন থাকেন ডাব্লিং বেড করে। আর এই পাঁচমিশালি মানুষজন একসাথে থাকার কারণে অভ্যাসগত বিভিন্ন ব্যাপার নিয়ে কলহ লেগেই থাকে, যার প্রভাব পড়ে আমাদের সামাজিক কার্যক্রম গুলোতে। যেমন - বাস্তুহারা বাংলাদেশিকে দুই গ্রুপ সহায়তা করবে যেকোন একটি ব্যাপারে । কিন্তু যে লোককে হেল্প করা হবে যে কোন অঞ্চলের , বাড়ি কোথায় কোন জেলার এসব নিয়ে বৈষম্য হয়। এক এলাকার লোকজন আরেকজনকে ভালো চোখে দেখেনা। শেষমেষ কেউই তাকে আর সাহায্য করেনা। সে তার সমস্যাতেই থেকে যায়, বা কোন কোন ভাবে নিজেকে সেই প্রব্লেম কাভার করে উঠতে হয়।
রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় মত বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব ত আছেই নিজদের মধ্যে। প্রথমে রাজনীতির কথা বলি। বাংলাদেশের যারা আওয়ামীলীগ মতাদর্শের অনুসারী উনারা সবসময় হাইকমিশন কেন্দ্রিক মানুষ। জমিদারশিপ প্রথাটা কেন যেন মনে পড়ে গেলো তাদের কথা মনে হবার সাথে সাথেই, ব্যাপারটা প্যারিসের ক্ষেত্রে। অপরদিকে যারা বিএনপি বা ডানপন্থি কেন্দ্রিক তারা এখানে অর্থাৎ প্যারিসকেও নয়াপল্টন ভাবতে শুরু করেন। এটা আমার ব্যক্তিগত মতামত। শুধু তাই নয়, বিগত দিন গুলোতে সাধারণ নিরীহ বাংলাদেশিরা, বাংলাদেশিদের মাধ্যমে এত পরিমাণ দালালি ফ্রড মানুষের ক্ষপ্পরে পড়েছেন , সহযোগিতার নামে পেছন পেছন ঘুরেছেন কমিউনিটি নেতাদের, যে এখন কাউকে বিশ্বাস করতেই ভয় পান, বা কেউ যদি সহযোগিতার হাত বাড়ায় তাকেও দালাল ভাবতে শুরু করেন! পরিস্থিতি এমন পরিবেশ তৈরি করেছে। ধর্মীয় মতামত কথা চিন্তা করতে গেলে বলতে হবে, যে ধর্মের অনুসারী ঐ টাইপের'ই ম্যাছ বা ব্যাচেলর বাসা খুঁজেন। আমার জানা মতে এখন পর্যন্ত দুই ধর্মের ব্যাচেলরা একসাথে আছেন একটি বাসা ভাড়া নিয়ে টা এখন পর্যন্ত চোখে পড়েনি। ঠিক বাংলাদেশের মত ধর্মগত নীরব দ্বন্দ্ব ত আছেই। এসব এন্টার্নাল বৈষম্য নীরব সংঘাত বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীকে সামনে বাড়ার কোন সুযোগ'ই দিচ্ছেনা।
অপরদিকে প্যারিসে বসবাস করা বিশাল জনগোষ্ঠী হচ্ছে এরাবিয়ান অর্থাৎ আলজেরিয়ান, তিউনিশিয়ান, লেবানন, মরক্কো ইত্যাদি দেশের লোক। আছে আফ্রিকান বিশাল জনগোষ্ঠী । যুগযুগ ধরে তারা এই প্যারিসে বসবাস করছে অপরপক্ষে বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীর দ্বিতীয় স্টেজ বা সেকেন্ড জেনারেশন চলে। সুতরাং ফ্রান্সের ফরাসি ভাষাগত দিক ত অন্যান্যরা জাতিরা পারদর্শী কিন্তু আমাদের বাংলাদেশিরা সেই ক্ষেত্রে প্রায় শূন্যের কোঠায় অবস্থান করার কারণে চাকরির বাজার বা ব্যবসার বাজারে কয়েক লাইন এখনো পেঁছনে।
উপরে বলছিলাম ফ্রান্সে বসবাসরত বাংলাদেশিদের সংস্কৃতি-গত ঘাটতি, ভাষা-গত সমস্যার কথা এখন আসি কোভিড ১৯ ভাইরাসে লক ডাউন ফ্রান্সে বাংলাদেশিদের কিছু কথা নিয়ে।
ফ্রান্সের অভারভিলা শহরের ব্যবসায়ী আহমেদ হোসাইন, চট্টগ্রামের লোক। ফ্রান্সে বসবাস করছেন দীর্ঘ ১১ বছর থেকে। উনার একটি ফাস্টফুড রেস্টুরেন্ট আছে। উনার সাথে কথা হচ্ছিল দুদিন আগে । ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে কথার প্রসঙ্গে বলেছেন, "গড়ে আঁটশ থেকে তেরো'শ ইউরো উনার দৈনিক লোকসান হচ্ছে। করোনা ভাইরাসের কারণে গত ১৬ মার্চ থেকে লক ডাউন। ব্যবসা বাণিজ্য একেবারেই মন্দা"। এখানে আমার আরও একটি বিশ্লেষণ আছে। গত জানুয়ারি মাস পুরোটাই ফ্রান্সের পরিবহন সংগঠন বিভিন্ন দাবীতে পুরো মাস'ই স্ট্রাইক পালন করেছে। সেই জানুয়ারি মাসেই গড়ে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের লোকসান ছিল ৭ থেকে আঁট হাজার ইউরো। একমাস ঘুরতে না ঘুরতেই আবার লক ডাউন। আবার লোকসান। যদিও ফ্রান্সের সরকার বলছে, যে প্রণোদনা দেওয়া হবে। কিন্তু এতে যে খুব একটা লোকসান পুষিয়ে উঠবে তা নয়। এর অন্যতম কারণ হলও, বিভিন্ন ট্যাক্স, ভ্যাট এবং দোকান অনুযায়ী কর্মী নিয়োগে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা খুব একটা ক্লিয়ার নয়। এই ক্লিয়ারনেস না থাকার কারণে কতখানি সরকারি প্রণোদনা সুবিধা পাবেন তা নিয়ে আমি সন্দিহান।
এবার আসি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত একজন বাংলাদেশির কথা নিয়ে। করোনা আক্রান্ত হয়ে তিনি গিয়েছিলেন হাসপাতালে। প্রাইমারি অবস্থা দেখে উনাকে ডোলে-ফিন (প্যারাসিটামল) এবং কিছু ভিটামিন সি প্লাস ক্যাপসুল দিয়ে উনাকে পাঠানো হলও আইসোলেশনে অর্থাৎ একটি হোটেলে। সেখানে তিনি ছিলেন চৌদ্দ দিন। কিন্তু এই চৌদ্দ দিন যা খরচ আসলও হোটেল রুমের উনার নিজেকেই বহন করতে হলও। যেহেতু তিনি ফ্রান্সের ইমিগ্র্যান্ট নন অর্থাৎ অনিয়মিত বাসিন্দা সেহেতু তিনি স্বাস্থ্য সুবিধার খরচ সরকারের নিকট থেকে পাননা। দৈনিক ৩০ ইউরো খরচের এই হোটেল বিল পুরোটাই তিনি বহ্ন করে দিশেহারা। একে ত উনার পার্মানেন্ট কোন কাজ নেই এর মধ্যে ৪২০ ইউরো ভাড়া এরকম শত বাংলাদেশি নীরব অর্থনৈতিক চাপে আছেন। খাওয়া এবং অন্যান্য খরচ ত বাদ দিলাম।
এই হচ্ছে বয়ে যাওয়া ফ্রান্সে থাকা বাংলাদেশিদের অবস্থা। প্রায় আশি শতাংশের মত বাংলাদেশি এই করুণ অবস্থায় আছেন। দূরে থেকে মনে হয় সোডিয়াম আলোর ঝলমলে শহর, আইফেল টাওয়ার , ল্যুভর মিউজিয়ামের দেশ ফ্রান্স কত না রঙিন বিচিত্র। কিন্তু বাস্তবে কষ্ট হাহাকারের নীরব নৈরাজ্য বয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশিদের বুকে।
লেখক-
Chowdhury Maruf, a citizen journalist and writer. publishers and owner "motamot blog"
"প্যারিস শহরের পখ দ্যা লাশাপিল এলাকায় বসবাস করি। ২০১৯ সালের প্রথম দিকে আমি ফ্রান্সে আসি। আমি ফ্রান্সের অনিয়মিত একজন বাসিন্দা। গত ১৬ মার্চ থেকে আমার কাজ বন্ধ রয়েছে। খুবই আর্থিক সমস্যার মধ্যে দিন যাপন করছি। আমি যেহেতু অনিয়মিত বাসিন্দা সেহেতু ফ্রান্স সরকার যে বিশেষ আর্থিক প্রণোদনা দিবে তা থেকে আমি কোন উপকৃত হবও না।"
উনার নিচের বক্তব্যটা প্যারিস তথা ফ্রান্সে বসবাস করা অনিয়মিত বাংলাদেশিদের মনের কথা। এখানে এসে ভাষাগত সংস্কৃতিগত কারণে বাংলাদেশি লোকজন অনেক পেছনে। শুধু পেছনে বললে হবে না রীতিমত সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এই সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার বেশ কিছু কারণ রয়েছে । তন্মোধ্যে সবচেয়ে বড় কারণ হলও এখানে ফরাসী ভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষায় লোকজন কথা বলতে চায়না। বিশেষ করে ইংলিশ ত নয়'ই। বেশ কিছু সরকারী অফিস আদালতে আমি গিয়েছি, দেখেছি, কোনভাবে ইংলিশ ভাষায় কথা বললে উনারা (অফিস কর্মকর্তা/কর্মচারী) কথা বলতে চান না। যেমন আমি ব্যক্তিগত ভাবে উর্দু ভষায় কথা বললে তার সাথে কথা বলতে চাইনা ঠিক এই ভাবেই। ভাষাগত এই বৈষম্যের মূল কারণ আমার কাছে মনে হয়েছে কিছুটা ঐতিহাসিক রাজনৈতিক দ্বন্দ্বগত কারণে। যাই হোক যা বলছিলাম, আমরা বাংলাদেশিরা বাংলার পর মডার্ন ভাষা হিসেবে বা ইন্টারন্যাশনাল-শিপ হিসেবে ইংরেজি শিখি , শিখতে চাই। কিন্তু এখানে সেই ইংরেজি ভাষা সচরাচর ব্যবহৃত হয়না বলেই আমরা অনেক কিছুই বোঝতে পারিনা, বোঝাতে পারিনা। আর এই একটি মাত্র কারণে ফ্রান্সে বাংলাদেশি লোকজন অনেক পিছিয়ে।
অপরদিকে আরেকটি কারণ'ও আছে। ফ্রান্সে বসবাসরত বেশির ভাগ বাংলাদেশিরা এখানে এসে পড়ালেখা করেন না, বা ফ্রান্সে বাংলাদেশিদের স্টুডেন্ট ভিসার সুযোগ সুবিধা খুব কম। কম বলতে কি ১ শতাংশ'ও হবেনা। আর এটা খুবই স্বাভাবিক, কোন দেশ বা অঞ্চলে আপনি জাতিগত ভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে সেইখানের আঞ্চলিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। কিন্তু সে সুযোগ না থাকায় আমরা বাংলাদেশিরা অনেক পিছিয়ে।
তৃতীয় ব্যাপারটি হচ্ছে , ইমিগ্র্যান্ট হওয়ার আশায় ফ্রান্সে থাকা বাংলাদেশিরা আওয়ার সেলারি মেইন্টেইন না করেই যেখানে সেখানে কাজে লেগে যান। বিশেষ করে রেস্টুরেন্ট এবং নিত্য প্রয়োজনীয় দোকান গুলোতে ঘণ্টা দুই বা ৩ ইউরো পারিশ্রমিকে কাজে লেগে যান। এই কারণে নিজ তথা দেশে থাকা পরিবারের আর্থিক যোগান মিটাতে দৈনিক বার তেরো ঘণ্টা কাজ করে থাকেন। এটা স্বভাবত স্বাভাবিক, একজন ব্যক্তি যদি বারো তেরো ঘণ্টা দৈনিক শুধু কাজই করে থাকেন তবে ঐ ব্যক্তির অন্য কোন ক্যারিয়ার ডেভলাপিং , নিজেকে নিয়ে চিন্তা করার কোন সুযোগই থাকেনা । এভাবে প্রতিবছর কার্ড নবায়ন করার জন্য কাজ করে যেতেই হয় এবং দীর্ঘ সময় এভাবে কাজ করতে করতে নিজে উদ্যোক্তা হওয়ার সম্ভাবনা বেশির ভাগই হাতছাড়া করে ফেলেন ।
এ'ত গেলো সহজে উপলব্ধি করা সমস্যা আরো কিছু সমস্যা আছে ফ্রান্সে বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীর মধ্যে, যা নীরব, এন্টার্নাল। উপর থেকে বোঝা যায়না কিন্তু বিষ ফোঁড়ার মত। ফ্রান্সে বিশেষ করে প্যারিসে আবাসন সংকট এক মহা সংকটের নাম। এখানে নিজের একটি বাসা থাকা মানে সোনার হরিণ। বেশির ভাগ ক্ষেত্র্ পঁচাত্তর শতাংশ বাংলাদেশি লোকজন এখানে ম্যাছ বা বাউন্ডিং ব্যাচেলর সিস্টেমে বসবাস করেন। ছোট একটি ঘরে আঁট নয়জন থাকেন ডাব্লিং বেড করে। আর এই পাঁচমিশালি মানুষজন একসাথে থাকার কারণে অভ্যাসগত বিভিন্ন ব্যাপার নিয়ে কলহ লেগেই থাকে, যার প্রভাব পড়ে আমাদের সামাজিক কার্যক্রম গুলোতে। যেমন - বাস্তুহারা বাংলাদেশিকে দুই গ্রুপ সহায়তা করবে যেকোন একটি ব্যাপারে । কিন্তু যে লোককে হেল্প করা হবে যে কোন অঞ্চলের , বাড়ি কোথায় কোন জেলার এসব নিয়ে বৈষম্য হয়। এক এলাকার লোকজন আরেকজনকে ভালো চোখে দেখেনা। শেষমেষ কেউই তাকে আর সাহায্য করেনা। সে তার সমস্যাতেই থেকে যায়, বা কোন কোন ভাবে নিজেকে সেই প্রব্লেম কাভার করে উঠতে হয়।
রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় মত বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব ত আছেই নিজদের মধ্যে। প্রথমে রাজনীতির কথা বলি। বাংলাদেশের যারা আওয়ামীলীগ মতাদর্শের অনুসারী উনারা সবসময় হাইকমিশন কেন্দ্রিক মানুষ। জমিদারশিপ প্রথাটা কেন যেন মনে পড়ে গেলো তাদের কথা মনে হবার সাথে সাথেই, ব্যাপারটা প্যারিসের ক্ষেত্রে। অপরদিকে যারা বিএনপি বা ডানপন্থি কেন্দ্রিক তারা এখানে অর্থাৎ প্যারিসকেও নয়াপল্টন ভাবতে শুরু করেন। এটা আমার ব্যক্তিগত মতামত। শুধু তাই নয়, বিগত দিন গুলোতে সাধারণ নিরীহ বাংলাদেশিরা, বাংলাদেশিদের মাধ্যমে এত পরিমাণ দালালি ফ্রড মানুষের ক্ষপ্পরে পড়েছেন , সহযোগিতার নামে পেছন পেছন ঘুরেছেন কমিউনিটি নেতাদের, যে এখন কাউকে বিশ্বাস করতেই ভয় পান, বা কেউ যদি সহযোগিতার হাত বাড়ায় তাকেও দালাল ভাবতে শুরু করেন! পরিস্থিতি এমন পরিবেশ তৈরি করেছে। ধর্মীয় মতামত কথা চিন্তা করতে গেলে বলতে হবে, যে ধর্মের অনুসারী ঐ টাইপের'ই ম্যাছ বা ব্যাচেলর বাসা খুঁজেন। আমার জানা মতে এখন পর্যন্ত দুই ধর্মের ব্যাচেলরা একসাথে আছেন একটি বাসা ভাড়া নিয়ে টা এখন পর্যন্ত চোখে পড়েনি। ঠিক বাংলাদেশের মত ধর্মগত নীরব দ্বন্দ্ব ত আছেই। এসব এন্টার্নাল বৈষম্য নীরব সংঘাত বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীকে সামনে বাড়ার কোন সুযোগ'ই দিচ্ছেনা।
অপরদিকে প্যারিসে বসবাস করা বিশাল জনগোষ্ঠী হচ্ছে এরাবিয়ান অর্থাৎ আলজেরিয়ান, তিউনিশিয়ান, লেবানন, মরক্কো ইত্যাদি দেশের লোক। আছে আফ্রিকান বিশাল জনগোষ্ঠী । যুগযুগ ধরে তারা এই প্যারিসে বসবাস করছে অপরপক্ষে বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীর দ্বিতীয় স্টেজ বা সেকেন্ড জেনারেশন চলে। সুতরাং ফ্রান্সের ফরাসি ভাষাগত দিক ত অন্যান্যরা জাতিরা পারদর্শী কিন্তু আমাদের বাংলাদেশিরা সেই ক্ষেত্রে প্রায় শূন্যের কোঠায় অবস্থান করার কারণে চাকরির বাজার বা ব্যবসার বাজারে কয়েক লাইন এখনো পেঁছনে।
উপরে বলছিলাম ফ্রান্সে বসবাসরত বাংলাদেশিদের সংস্কৃতি-গত ঘাটতি, ভাষা-গত সমস্যার কথা এখন আসি কোভিড ১৯ ভাইরাসে লক ডাউন ফ্রান্সে বাংলাদেশিদের কিছু কথা নিয়ে।
ফ্রান্সের অভারভিলা শহরের ব্যবসায়ী আহমেদ হোসাইন, চট্টগ্রামের লোক। ফ্রান্সে বসবাস করছেন দীর্ঘ ১১ বছর থেকে। উনার একটি ফাস্টফুড রেস্টুরেন্ট আছে। উনার সাথে কথা হচ্ছিল দুদিন আগে । ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে কথার প্রসঙ্গে বলেছেন, "গড়ে আঁটশ থেকে তেরো'শ ইউরো উনার দৈনিক লোকসান হচ্ছে। করোনা ভাইরাসের কারণে গত ১৬ মার্চ থেকে লক ডাউন। ব্যবসা বাণিজ্য একেবারেই মন্দা"। এখানে আমার আরও একটি বিশ্লেষণ আছে। গত জানুয়ারি মাস পুরোটাই ফ্রান্সের পরিবহন সংগঠন বিভিন্ন দাবীতে পুরো মাস'ই স্ট্রাইক পালন করেছে। সেই জানুয়ারি মাসেই গড়ে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের লোকসান ছিল ৭ থেকে আঁট হাজার ইউরো। একমাস ঘুরতে না ঘুরতেই আবার লক ডাউন। আবার লোকসান। যদিও ফ্রান্সের সরকার বলছে, যে প্রণোদনা দেওয়া হবে। কিন্তু এতে যে খুব একটা লোকসান পুষিয়ে উঠবে তা নয়। এর অন্যতম কারণ হলও, বিভিন্ন ট্যাক্স, ভ্যাট এবং দোকান অনুযায়ী কর্মী নিয়োগে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা খুব একটা ক্লিয়ার নয়। এই ক্লিয়ারনেস না থাকার কারণে কতখানি সরকারি প্রণোদনা সুবিধা পাবেন তা নিয়ে আমি সন্দিহান।
এবার আসি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত একজন বাংলাদেশির কথা নিয়ে। করোনা আক্রান্ত হয়ে তিনি গিয়েছিলেন হাসপাতালে। প্রাইমারি অবস্থা দেখে উনাকে ডোলে-ফিন (প্যারাসিটামল) এবং কিছু ভিটামিন সি প্লাস ক্যাপসুল দিয়ে উনাকে পাঠানো হলও আইসোলেশনে অর্থাৎ একটি হোটেলে। সেখানে তিনি ছিলেন চৌদ্দ দিন। কিন্তু এই চৌদ্দ দিন যা খরচ আসলও হোটেল রুমের উনার নিজেকেই বহন করতে হলও। যেহেতু তিনি ফ্রান্সের ইমিগ্র্যান্ট নন অর্থাৎ অনিয়মিত বাসিন্দা সেহেতু তিনি স্বাস্থ্য সুবিধার খরচ সরকারের নিকট থেকে পাননা। দৈনিক ৩০ ইউরো খরচের এই হোটেল বিল পুরোটাই তিনি বহ্ন করে দিশেহারা। একে ত উনার পার্মানেন্ট কোন কাজ নেই এর মধ্যে ৪২০ ইউরো ভাড়া এরকম শত বাংলাদেশি নীরব অর্থনৈতিক চাপে আছেন। খাওয়া এবং অন্যান্য খরচ ত বাদ দিলাম।
এই হচ্ছে বয়ে যাওয়া ফ্রান্সে থাকা বাংলাদেশিদের অবস্থা। প্রায় আশি শতাংশের মত বাংলাদেশি এই করুণ অবস্থায় আছেন। দূরে থেকে মনে হয় সোডিয়াম আলোর ঝলমলে শহর, আইফেল টাওয়ার , ল্যুভর মিউজিয়ামের দেশ ফ্রান্স কত না রঙিন বিচিত্র। কিন্তু বাস্তবে কষ্ট হাহাকারের নীরব নৈরাজ্য বয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশিদের বুকে।
লেখক-
Chowdhury Maruf, a citizen journalist and writer. publishers and owner "motamot blog"
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন