'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন' শুনলেই মনে হবে যেন আপনি কিছু একটা অনলাইনে লিখে ফেলেছেন এরজন্য আপনি আজ জেলে বন্দি- এমন একটি চিত্র আমাদের চোখে ভাসতে থাকে। বর্তমানে এমন একটি অবস্থা দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশে যে কিছু লিখলেই আপনাকে জেলে যেতে হবে। আসলেই কি জেলে যেতে হচ্ছে? কেন'ই বা যেতে হচ্ছে?
স্থানীয় কিছু আলোচনা দিয়ে শুরু করি। স্থানীয় পর্যায়ে সংবাদকর্মী বা লেখকদের এমন এক অবস্থায় আছেন নিউজ প্রকাশ ত দূরের কথা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে যদি কিছু লিখেন অর্থাৎ তার লিখাটা যদি স্থানীয় কোন প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের বিপক্ষে যায় তাহলেই তাকে রাতের আঁধারে তুলে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ৷ দিনের পর দিন তাকে নির্জনে বেঁধে রেখে করা হয় মানসিক নির্যাতন, অথবা গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে প্রেরণ। প্রশ্ন হচ্ছে এই নির্যাতিত মানুষগুলো কারা, এই নির্যাতিত মানুষ হচ্ছেন এমন কেউ কেউ যারা স্থানীয় পর্যায়ে দুর্নীতি বা কোন ক্রাইমের ব্যাপারে এক বাক্যের স্ট্যাটাস দিয়ে স্থানীয় কোন প্রভাবশালী ব্যক্তি বা মহলের আক্রোশের শিকার হয়েছেন। নির্যাতিত ব্যক্তি হতে পারেন যেকোন রাজনৈতিক মতাদর্শের। তিনি হতে পারেন আওয়ামীলীগপন্থী, হতে পারেন বিএনপি বা ইসলামপন্থী, বামপন্থী বা নাস্তিক। এই আইনে যখন মামলা হয় তখন মানুষ কে কোন পন্থী বা কি মতবাদ খতিয়ে দেখা ত হয়'ই না বরং যার বিপক্ষে লেখাগুলো গেলো তিনি একরকম জোর করে যেমন সহজ বাংলায় মানহানি বা মিথ্যা প্রচার বলেই মামলা করে দিলেন থানায়৷ উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ভিন্ন মত য় অনেক দূরের কথা ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ দলীয় তাদের সহযোগী সংগঠন বা তাদের অনুসারী অনেক গণমাধ্যমের সম্পাদক বা সাংবাদিক এই মামলায় জেল খেঁটেছেন অনেক দিন। কেইস স্টাডি করে জানতে পারলাম, ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্যের বিপরীত গ্রুপের অনুসারী তিনি ছিলেন। সুতরাং দেখা গেলো একমাত্র স্থানীয় সাংসদের আক্রোশেই তাকে জেলে থাকতে হলো দীর্ঘদিন। উপরে প্রথমে দুটি প্রশ্ন রেখেছিলাম আসলেই কি জেলে যেতে হচ্ছে? কেন যেত হচ্ছে? উপরের ছোট কথা গুলোই প্রশ্ন দুটির সরল উত্তর।
বলা হচ্ছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হচ্ছে জনগণের ডিজিটাল ভাবে নিরাপত্তার জন্য। আমরা কি নিরাপত্তা পাচ্ছি? ছোট একটা উদাহরণ দেই-- মনে করুন ফেসবুকে আমি একটা স্ট্যাটাস দিলাম। একদল উঠে পড়ে লেগে গেলো! রিপোর্ট করে আইডিটা বন্ধ করে দিলো! এখন আমার এই আইডিটা আমি রিকোভার করতে পারলাম না। অথবা আমার ছবি দিয়ে অন্য একটা একাউন্ট খুলে রান করা হলো! তাহলে আমি কিভাবে নিরাপত্তা পেলাম! যেখানে আমার কথা বলা বা লিখার অধিকার ছিল সেই প্লাটফর্ম টায় আমি নিরাপত্তা ত পেলাম ই না বরং আমি হারালাম। তবে কিভাবে আমি ডিজিটাল প্লাটফর্মে নিরাপদ!
বাংলাদেশে কোন সরকারের আমলেই মুক্তচর্চা হয়নি। ২০০৬ সাল থেকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন দিয়ে সেটা রুখে দেওয়া আছে। সোজা বাংলায় কোন সরকার'ই চান না উনাদের বিপক্ষে কোন লিখা আসুক। ২০১৩ সালে সংশোধন করে এই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন আরও কঠোর হলো। সর্বশেষ ২০১৮ সালের অক্টোবর এ এলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন।
এই আইনে লেখক সাংবাদিক ব্লগার কার্টুনিস্ট প্রকাশক অনলাইন এক্টিভিস্ট অনেকেই আটক হয়েছেন, গ্রেফতার হয়েছেন, কারাবরণ করেছেন।ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হওয়ার দুই বছরের মধ্যে এ আইনে মামলার সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে ৭৩৪টি মামলা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন থানায় করা আরও ৩৩০টি মামলা বিচারের জন্য এ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়েছে।
এসব মামলার মধ্যে বেশির ভাগই হয়েছে আইনটির ২৫ ও ২৯ ধারায়। মূলত রাষ্ট্র বা ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন এবং মানহানির অভিযোগে এ দুটি ধারায় মামলাগুলো হয়েছে। এ আইন হওয়ার আগে একই রকম অভিযোগে মামলা হয়েছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারায়। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গত বছর সারা দেশে ৭৩২টি মামলায় ১ হাজার ১৩৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০১৯ সালের বছরের প্রথম দুই (জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি) মাসে ১৬৫ মামলায় ৩৩৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন উপজেলা এবং জেলা পর্যায়ের সাংবাদিক লেখক এবং অনলাইন এক্টিভিস্টরা। জাতীয় পর্যায়ের ব্যাপারগুলো উঠে আসলেও মিডিয়াতে স্থান পায়না রুরাল অঞ্চলের ভুক্তভোগীদের সংবাদ। দিনের পর দিন তারা অজস্র যন্ত্রণা এবং দুর্ভোগে পার করে যান সময়। মৌলবাদ তথা দেশ রাষ্ট্রবিরোধী কাজ রুখে দেওয়ার কথা থাকবে আইন দিয়ে, যেখানে নিরাপত্তা পাওয়ার কথা সাধারণ মানুষ সেখানে নিরাপত্তার বলয়ে 'যা ইচ্ছে তাই' করে যান প্রভাবশালী মহল। সুতরাং এই আইন রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর নয়। আমি তাই এই আইন বাতিল চাই।
লেখকঃ চৌধুরী মারূফ, সাংবাদিক, ব্লগার
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন