সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

'আমি একজন ভাষাশিক্ষার ছাত্র'

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২১ ফেব্রুয়ারি। ভাষা দিবসে কি হঠাৎ করেই ভাষা প্রেমিক হয়ে গেলাম! না, একদম তা নয়। ভাষা শিক্ষার গুরুত্ব এবং কেন শিখতে হচ্ছে একটি ভাষা, বা না শিখলে কি হবে সেই ব্যপার গুলো চিন্তা করছিলাম। 

প্রথমেই বলে নেই,  ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনে রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য পাকিস্তানি শাসকদের পালিত পুলিশের গুলিতে নিহত বাংলার দামাল ছেলেদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। তাঁদের সেই রক্তের ঋণ আমি বা আমরা কখনোই শোধ করতে পারবো না। তাদের প্রাণ বিসর্জনের কারণে আজ হয়তো কথাগুলো বাংলা অক্ষরে লিখতে পারছি, নয়তবা মায়ের মুখের ভাষা বাদ দিয়ে আজও লিখতে হতো, পড়তে হতো, বলতে হতো উর্দু ভাষা। উর্দু যাদের মায়ের ভাষা তারা উর্দুতে কথা বলুক সেই পেশোয়ার বা রয়েল পিণ্ডির মানুষেরা কিন্তু সুনামগঞ্জ থেকে সুন্দরবন,  তেতুলিয়া থেকে টেকনাফ বয়ে ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের বেশি ভূমিতে যারা জোর পূর্বক উর্দু চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল সেই কায়েদে আজম জিন্নাহ সহ উনাদের প্রতি রইল একগুচ্ছ ঘৃণা। ভাষাগত রেসিস্টরা নিপাত যাক। 

শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতের শিলচরে মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য, ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে যে শিলচর স্টেশনে আর তার পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে আসাম পুলিশের গুলিতে এক নারীসহ ১১ জন প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের জন্য তাদের প্রতিও বিনম্র শ্রদ্ধা। শুধু তাই নয় আফ্রিকার দেশ সিয়েরা লিওনে যারা বাংলাকে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন সম্মান পূর্বক ভাবে তাদের প্রতিও আমার ভালোবাসা অনবরত বহমান। 

আমি যে ভূমিতে বসে কথাগুলো লিখছে সেটি ফ্রান্স অর্থাৎ ফরাসী ভাষার আদিস্থল। অন্যান্য রোমান্স ভাষার মত ফরাসি ভাষারও উৎপত্তি রোমান সাম্রাজ্যের লাতিন ভাষা থেকে। লাতিন ছাড়াও রোমান গল সাম্রাজ্যের সময়কার স্থানীয় কেল্টীয় ভাষাসমূহ এবং রোমান-পরবর্তী ফ্রাংকীয় হানাদারদের জার্মানীয় ভাষাগুলিও ফরাসি ভাষাকে প্রভাবিত করেছে। সমসাময়িক আধুনিক ফরাসি (১৯শ শতক-বর্তমান): আধুনিক আদর্শ ফরাসি ভাষার বর্তমান উচ্চারণের ধরন এই পর্বে এসে স্থির হয়, মূলত ১৭৮৯ ও ১৯১৮ সালের মধ্যবর্তী সময়ে। ফ্রান্স ও বেলজিয়ামের আফ্রিকান উপনিবেশগুলিতে ফরাসি ভাষাকে মূল সরকারি ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়।

ফরাসী ভাষার ইতিহাস খুব একটা লিখলাম না, অন্য সময়ে বিস্তর আলোচনা করব। একজন বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কেন ফ্রান্স ভুখন্ডে কেন ফরাসী শিখব? সে উত্তর দিলো- ফরাসী ভূখন্ডে আছি তাই ফরাসী শিখতে হবে। সে হয়তো ভেবেছিলো আমি কি একতরফা প্রশ্ন করলাম?  আসলে তা নয়, মূলত তার উত্তরের সাথে আমি একমত, ফ্রান্স আছি তাই ফরাসী শিখতে হবে। ফরাসী মানুষজন এমন তারা জোর করে আপনাকে কোন কিছু চাপিয়ে দেবেনা, কিন্তু এমন একটি সাংস্কৃতিক এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু করে রেখেছে, যে আপনাকে ফরাসি শিখতে হবে জানতে হবে। আসলে তাদের এই জানানো বা শিখানোর ব্যাপারটা আসলেই চোখে পড়ার মত। ফরাসী আদালত,  প্রশাসনিক অধিদপ্তর, পরিদপ্তর গুলো সম্পূর্ণ ভাবে ফ্রেঞ্চ ভাষার উপর ভিত্তি করেই চলে। এমনকি হাসপাতাল গুলো'ও। সেখানে দু একটা অধিক স্মার্ট স্বরূপ আপনি অন্য ভাষার শব্দ ব্যবহার করলে তারা যে খুব খুশি হয় তা নয়। তারা যে চাপিয়ে দিচ্ছে তা নয়, অনুবাদকের ব্যবস্থা করে রেখেছে। কিন্তু এই অনুবাদকের ব্যবস্থা করে তারা আপনাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে 'আপনি এখানে থাকতে হলে, জীবিকা নির্বাহ করতে হলে অবশ্যই আমাদের (ফরাসি) ভাষা শিখতে হবে।' নয়ত আপনি নির্ভরশীল পরজীবী উদ্ভিদ স্বর্ণলতার মত পরিগণিতো হবেন। খুব সুন্দর এবং সুকৌশল ভাবে তারা তাদের ভাষার বিস্তর ঘটাচ্ছে। এটা নেগেটিভ ভাবে উপস্থাপিত করছে না বরং ভাষার ব্যাপক প্রচারে তাদের সাংস্কৃতিক চলমান বিপ্লব এটি। আমার কাছে এটি'ই মনে হচ্ছে।

যা বলছিলাম, একটি দেশে থাকতে হলে তাদের ভাষা শিখতে হবে জীবন যাপন করতে হলে। এই জীবন যাপন মানে হলো ভাষাবিহীন আপনি একমিনিট ও সামনে এগুতে পারবেন না।আপনার মুখে উচ্চারণে আসুক বা না আসুক শিখতেই হবে। এমনকি ফার্মেসিতে গিয়ে একটি ওষুধ বা মুদি দোকানে গিয়ে এক হালি ডিম কেনার জন্য হলেও। দ্বিতীয়ত, এখানে ভাষা না শিখলে আমার নিজের ই ক্ষতি৷ জীবন ধারণের একজন সাথে অনুবাদক নিয়ে ত আর সারাক্ষণ ঘুরাফেরা করা যায় না। তবে আমাদের বাংলাদেশিদের সমস্যা হচ্ছে এখানে বসবাসরতরা শিখার জন্য সাহায্য না করে, দু লাইন শিখে আট লাইন অন্যের উপর চাপিয়ে দেই৷ এই হচ্ছে বর্তমান ভাষা শিক্ষার বাস্তবতা। সুতরাং আমরাও আমাদের বাংলা এভাবে বাস্তবিক ভাবে সর্বক্ষেত্রে চালু করতে পারি। অফার বা এপস বা সংবাদের প্রেস রিলিজে নয়, বরং সর্বক্ষেত্রে।

বাস্তবিক ভাবে নিজেই একজন ভাষাশিক্ষার ছাত্র, ফরাসী শিখতে হচ্ছে।  তা ক্লাস করে হোক, বই পড়ে হোক, সোস্যাল মিডিয়ার সাহায্যে হোক বা গুগল বা মাইক্রোসফট ট্রান্সলেটে হোক, শিখতে হবে। সবশেষে এটাই কথা, ভাষা শিখতে হবে, জানতে হবে, এর বিকল্প নেই। হোক বাংলা, হোক ফরাসী বা অন্যকোন ভাষা। এটাই সারমর্ম। শুদ্ধভাবে ভাষা চর্চা আমার এবং আমাদের অব্যাহত থাকুক। লিখায় বাংলা হরফে ইংলিশ শব্দগুলো অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবহার করেছি। সুতরাং আমারও বাংলা ভাষা চর্চা সার্বিক নয়, সুতরাং ব্যাপকভাবে শিখতেই হবে। পরিশেষে ধন্যবাদ জানালাম।


লিখেছেনঃ চৌধুরী মারূফ, সাংবাদিক 



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাউল সাধক চান মিয়া এবং আমার কিছু উপলব্ধি

"রজনী হইসনা অবসান  আজ নিশিতে আসতে পারেবন্ধু কালাচাঁন।। কত নিশি পোহাইলোমনের আশা মনে রইলো রে কেন বন্ধু আসিলোনা জুড়ায়না পরান। আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন।। বাসর সাজাই আসার আশেআসবে বন্ধু নিশি শেষে দারূন পিরিতের বিষে ধরিল উজান। আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন।। মেঘে ঢাকা আঁধার রাতে কেমনে থাকি একা ঘরে সাধক চাঁনমিয়া কয় কানতে কানতে হইলাম পেরেশান আজ নিশিতে আসতে বন্দু কালাচাঁন।"    গভীর নিশিতে ধ্যান মগ্ন হয়ে কালাচাঁনের অপেক্ষা করছেন সাধক।  সাধক চান মিয়ার শিষ্য বাউল সিরাজউদ্দিনের মতে এটি একটি রাই বিচ্ছেদ। কৃষ্ণের অপেক্ষায় রাধা নিশি বা রাতকে অনুরোধ করছেন 'রাত' যেন না পোহায়  কারণ তার কালা চান যে কোন সময় আসতে পারে। শব্দগুচ্ছ গুলো থেকে সহজেই উপলব্ধি হয় সাধক নিজ দেহকে রাধা আর আত্মাকে কৃষ্ণের সাথে তুলনা করেছেন। দেহ আত্মার মিলন ঘটানোই ছিল সাধকের সাধনা।        বাউল সাধক চান মিয়া উপরোক্ত গানটি রচনা করেছেন। নেত্রকোনা জেলার খাটপুরা গ্রামে ১৩২৫ বঙ্গাব্দে সাধক চান মিয়ার জন্ম। পুরো নাম চান্দেজ্জামান আকন্দ হলেও বা...

বাউল, বাউলতত্ব এবং কিছু কথা

একজন ভদ্র বন্ধু বরের সাথে বাউল সম্প্রদায় নিয়ে বেশ তর্ক হলো রাতে। তর্কের সূত্রপাত ছিল বাউলরা ভাববাদী না বস্তুবাদী। ভাবলাম "বাউলতত্ত্ব"র আলোকে বাউলরা ভাববাদী নাকি বস্তুবাদী তা নিয়ে যৌক্তিক আলোচনা আবশ্যম্ভাবী। কয়েকটি ধারাবাহিক পর্ব লিখে নিজের মনোভাব বোঝানোর চেষ্টা করব।  শুরুতেই শক্তিনাথ ঝাঁ এর বস্তুবাদী বাউল বই থেকে কিছু কথা লিখতে চাই; বাস্তব জগত ও জীবনকে এরা কোন আনুমানিক যুক্তি বা আলৌকিক যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে নারাজ। জৈব রাসায়নিক ব্যাখায় এরা নারীর রজঃ এবং পুরুষের বিজে জীবন ও জগত সৃষ্টিকে ব্যাখা করে এবং চার ভূতকে প্রাকৃতিক সৃষ্টি মনে করে। এভাবে মানুষে, প্রকৃতিতে তৈরি করে প্রাণ, প্রাণী। অনুমান ভিত্তিক স্বর্গ, নরক, পরলোক, পুনর্জন্মাদি প্রত্যক্ষ প্রমাণাভাবে বাউল আগ্রাহ্য করে। মানুষ ব্যাতিরিক্ত ঈশ্বরও এরা মানে না। সৃষ্টির নিয়মকে জেনে যিনি নিজেকে পরিচালনা করতে শিখেছেন- তিনিই সাঁই। সুস্থ নিরোগ দীর্ঘজীবন এবং আনন্দকে অনুভব করার বাউল সাধনা এক আনন্দমার্গ।।  বাউলরা ভাববাদী না বস্তুবাদী এর অনেক সূক্ষ বিশ্লেষণ শক্তিনাথের বস্তুবাদী বাউল বইটির মধ্যে আলকপাত করা হয়েছে। সাধারণ সমাজে এ ধা...

ভাইবে রাধারমণ

তখন কলেজের ছাত্র। বাংলা বিভাগের প্রভাষক শ্রদ্ধেয় রেজা স্যারের সাথে খুবই ভালো সম্পর্ক। কলেজের প্রথম দিনই স্যারকে খুব পছন্দ। তারপর স্যারের সাথে গল্প, সমাজ, রাজনীতি, সাহিত্য নিয়ে আলোচনা। রীতিমত ফিজিক্স, বায়োলোজি ক্লাস ফাঁকি দিলেও বাংলা ক্লাস কখনই ফাঁকি দিতাম না। খুব উপভোগ করতাম স্যারের ক্লাস। হোস্টেল সুপার হিসেবে স্যার ( ওহী আলম রেজা) আমাদের সাথেই থাকতেন। আমরা আসার প্রায় নয় মাস পর স্যার এলেন সুপার হিসেবে। প্রতিদিন রাতে খাবার পরেই স্যারের রুমে গিয়ে আড্ডা হত, গানের আসর হত। স্যারের পিসিতে প্রায়ই গান শুনতাম আমরা। একদিন হঠাৎ করেই একটি গান স্যার প্লে করলেন 'আমার বন্ধু দয়াময় তোমারে দেখিবার মনে লয়। তোমারে না দেখলে রাধার জীবন কেমনে রয় বন্ধুরে।। কদম ডালে বইসারে বন্ধু ভাঙ্গ কদম্বের আগা। শিশুকালে প্রেম শিখাইয়া যৌবনকালে দাগা রে।। তমাল ডালে বইসারে বন্ধু বাজাও রঙের বাশি। সুর শুনিয়া রাধার মন হইলো যে উদাসি রে।। ভাইবে রাধা রমন বলে মনেতে ভাবিয়া। নিভা ছিল মনের আগুন কে দিলাই জ্বালাইয়া রে।' গানের কথাগুলো বেশ ভালো লেগে গেলো। পুর গানটি শুনে বুঝলাম গানটি সাধক রাধারম...