সময়টা ১৯৯৩ সাল। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এক শীতের সকালে দূরুদূরু বুকে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হই। ভয়ে ভয়ে শিক্ষকরুমে গেলাম। তখনকার প্রধান শিক্ষক ছিলেন মনির স্যার। তিনি আমাদের পারিবারিক আত্বীয় ছিলেন। এই সুবাধে কাছে নিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। আব্বাকে জিজ্ঞেস করলেন- বাচ্চা ছেলে, “গাড়িগোড়ার পথ এতো দূর আসতে পারবে’?। আব্বা বললেন- প্রতিদিন গাড়িতে তুলে দিবেন। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।এরপর শুরু। সুনামগঞ্জের পূর্ব পাগলা থেকে ছাতকের জাউয়া বাজার থেকে পাইগাঁও উচ্চবিদ্যালয়। বাড়ি থেকে ২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে স্কুলে যেতাম। প্রতিদিন স্কুলে
যেথে- এ ছিল বাবার কড়া নির্দেশ। ফাঁকি দেয়ার কোন পথ ছিলনা। প্রতিদিনই গাড়িতে তুলে দেন। বাবা বলতেন- কোনদিন যদি আমি কিংবা তোমার মায়ের মৃত্যুর খবরও স্কুলে যায় তারপরও ক্লাস শেষ করে আসবে। রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে স্কুলে যেথে হবে। কতবার যে ছাতা হারিয়েছি, বৃষ্টিতে বই ভিজিয়েছে তার হিসেব নেই। ইচ্ছে করে নৌকা ডুবিয়েছি কতশত দিন।এক সময় সহপাঠীদের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে যায়। জাউয়া বাজার নামলেই অনেককেই পাওয়া যেতো। দল বেধে আমরা স্কুলে যেতাম। বর্ষায় কাঁদা মাড়িয়ে হেমন্তে ধুলোর সাগর পাড়ি দিয়ে আমরা স্কুলে পৌছতাম। জাউয়াবাজার-ছাতক সড়কের আশে পাশে তখন পর্যন্ত খুব বেশি ঘরবাড়ি হয়নি। স্কুলের পাশে একটি বাড়ি থেকে ফুল চুরি করা প্রতিদিনের কাজ ছিল।স্কুল ছুটি হলে কে কার আগে বাজারে গিয়ে গাড়িতে উঠবে এই প্রতিযোগিতা চলতো। আমরা প্রায়ই দৌড়ে দৌড়ে বাজার পর্যন্ত আসতাম। সেই সময় পর্যন্ত রাস্তায় বড় বাস ছিল (মুড়ির টিন)। আমরা এ বাসগুলোতে একসাথে ১৫/২০ জন উঠে বসতাম।স্যারদের অনেককেই আজ খুব বেশি মনে পড়ছে। আমার বাবার, চাচারও শিক্ষক ছিলেন টুনু স্যার। প্রতিদিনই সবার আগে স্কুলে চলে আসতেন। বয়সের ভারে ন্যুজ স্যার দায়িত্বের প্রতি ছিলেন সচেষ্ঠ। বুলি স্যার আমাদের বাংলা পড়াতেন। এ কারনেই আজ মনে হচ্ছে আমিও বাংলা পড়াচ্ছি। স্যার কানের পাশে চুলের মুঠি ধরে জোরে টান দিতেন। দুষ্ঠুমি একদম সহ্য করতে পারতেন না। জাউয়া বাজারের আশেপাশে থেকে যারা আসতো তাদের স্যার বলতেন- ‘কীতা বেটা জাউয়ার বাতাস লাগছেনি’। দীগেন্দ্র স্যার ইংরেজি পড়াতেন। স্যারকে ভয় লাগতো সবসময়। লতিফ স্যার সমাজ বিজ্ঞান পড়াতেন। একটু পরপর স্যার বলতেন বুছছো- এটা আমরা খুব উপভোগ করতাম। নুরুল আমিন স্যার অংক করাতেন। বৃহস্পতিবার ছিল জ্যামিতি। এই জ্যামিতির জন্য স্যারের হাতে মা’র খেয়েছি। স্যার চুলের মুঠি ধরে দাড় করাতেন। হক স্যার লম্বা বেত নিয়ে ক্লাসে আসলেও কখনো মারতেননা। তবে ভয় দেখানোর জন্য প্রতিদিনই বেত থাকতো হাতে। সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে টি আলী স্যারের কথা। স্যার আমাদের মাস্টর বেটা-মাস্টর বেটি বলে সম্বোধন করতেন। বাস্তব অনেক কথাই স্যার বলতেন তখন বুঝিনি। জীবেনর মুখোমুখি হয়ে এখন বুঝতে পারছি স্যার কী বলতেন। মুজিব স্যারের হাতে নামাজ না পড়ার জন্য অনেকবার মা’র খেয়েছি। বাবুল স্যারকে সবসময় গুরুগম্ভীর মনে হয়েছে। পন্ডিত স্যারের মুখে কখনো হাসি দেখিনি।আমাদের সময়ে এমএলএসএস ছিলেন আসক আলী নামে সত্তোরোর্ধ্ব একজন মানুষ। স্যাররা যখন তাকে- আসক আলী মিয়া বলে ডাকতেন তখন মনে হতো স্যারদের চেয়ে দ্বিগুন বয়সী একজন মানুষকে নাম ধরে ডাকেন কীভাবে?।বন্ধু-সহপাঠী অনেককেই আজ মনে পড়ছে। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী ছিল ফয়সল, জয়ন্ত, শেলী, মমতা, রাসনা, নূর মিয়া, জোবায়ের, মোহাদ্দিছ, ময়নুল, সুমন, ইমরান, শাহীন, লেচু, শাহীনূর।শিক্ষক বাবার সন্তান ফয়সল আমার মতো সেও শিক্ষকতা করছে। জয়ন্ত পুলিশ অফিসার। নিজস্ব যোগ্যতা দিয়ে সে ভালো করছে। ( একদিন আমাকে ভাত খাইয়েছে !)। তার মতো ছেলে পুলিশে আরও দরকার বলে আমি মনে করি। জোবায়ের পরপারে। একদিন হঠাৎ আমাদের এই নীরিহ বন্ধুটি অসুস্থ হয়ে পড়ে। মৃত্যুই তাকে নিয়ে যায় আমাদের কাছ থেকে। শেলী, মমতা, রাসনা এখন সংসারী। ময়নুল, সুমন, ইমরান, শাহীন,লেচু, শাহীনূর এখন বিদেশ বিভুইয়ে। শাহীন, লেচু ছিল জুটি। প্রতি সপ্তাহে তারা সিনেমা দেখতে যেতো। লতিফ স্যার নাম দিয়েছিলেন-লিচু-কাঠাল। নূর মিয়া এখন জাউয়াবাজারের বড় ব্যবসায়ী।ইমরান একটি ব্যাংকে চাকরি করছে। দুষ্টুর শিরোমনি ইমরান প্রায়ই স্কুল থেকে ‘ভাগা দিতো”। পরবর্তীতে সে অনেককেই সিগারেট খাওয়া শিখিয়েছে। শাহীনুরের সব শাখাতেই বিচরণ ছিল। সে ছিল স্কুলের পরিচিত মুখ। টিটু, সুমন, সুরঞ্জিত, মুহিবুর, শোয়েব, সেলিম ছিল আমার এলাকার ছেলে। বড় কাপনের সেলিমকে সবাই ক্ষেপাতো। আনন্দের খোরাক ছিল সেলিম। চেচান থেকে আসতো ফয়জুল। কম কথা বলতো সে।কৈতক থেকে আসতো মিঠু, ওমর, সেলিম, জুয়েল, নিজাম। তাদের অনেকের সাথে আর দেখা হয়নি।অনেক কাছের দূরের বন্ধুদের নাম মনে করতে পারছিনা। যেখানেই থাকিছ ভালো থাকিছ বন্ধু। আজ স্কুলের ৫০ বছর পূর্তিতে সকল শিক্ষক বন্ধু বান্ধবদের সু-স্বাস্থ দীর্ঘায়ু কামনা করছি।
লিখেছেন- ওহী আলম রেজা (ohee alom reza), সাংবাদিক (journalist)
যেথে- এ ছিল বাবার কড়া নির্দেশ। ফাঁকি দেয়ার কোন পথ ছিলনা। প্রতিদিনই গাড়িতে তুলে দেন। বাবা বলতেন- কোনদিন যদি আমি কিংবা তোমার মায়ের মৃত্যুর খবরও স্কুলে যায় তারপরও ক্লাস শেষ করে আসবে। রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে স্কুলে যেথে হবে। কতবার যে ছাতা হারিয়েছি, বৃষ্টিতে বই ভিজিয়েছে তার হিসেব নেই। ইচ্ছে করে নৌকা ডুবিয়েছি কতশত দিন।এক সময় সহপাঠীদের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে যায়। জাউয়া বাজার নামলেই অনেককেই পাওয়া যেতো। দল বেধে আমরা স্কুলে যেতাম। বর্ষায় কাঁদা মাড়িয়ে হেমন্তে ধুলোর সাগর পাড়ি দিয়ে আমরা স্কুলে পৌছতাম। জাউয়াবাজার-ছাতক সড়কের আশে পাশে তখন পর্যন্ত খুব বেশি ঘরবাড়ি হয়নি। স্কুলের পাশে একটি বাড়ি থেকে ফুল চুরি করা প্রতিদিনের কাজ ছিল।স্কুল ছুটি হলে কে কার আগে বাজারে গিয়ে গাড়িতে উঠবে এই প্রতিযোগিতা চলতো। আমরা প্রায়ই দৌড়ে দৌড়ে বাজার পর্যন্ত আসতাম। সেই সময় পর্যন্ত রাস্তায় বড় বাস ছিল (মুড়ির টিন)। আমরা এ বাসগুলোতে একসাথে ১৫/২০ জন উঠে বসতাম।স্যারদের অনেককেই আজ খুব বেশি মনে পড়ছে। আমার বাবার, চাচারও শিক্ষক ছিলেন টুনু স্যার। প্রতিদিনই সবার আগে স্কুলে চলে আসতেন। বয়সের ভারে ন্যুজ স্যার দায়িত্বের প্রতি ছিলেন সচেষ্ঠ। বুলি স্যার আমাদের বাংলা পড়াতেন। এ কারনেই আজ মনে হচ্ছে আমিও বাংলা পড়াচ্ছি। স্যার কানের পাশে চুলের মুঠি ধরে জোরে টান দিতেন। দুষ্ঠুমি একদম সহ্য করতে পারতেন না। জাউয়া বাজারের আশেপাশে থেকে যারা আসতো তাদের স্যার বলতেন- ‘কীতা বেটা জাউয়ার বাতাস লাগছেনি’। দীগেন্দ্র স্যার ইংরেজি পড়াতেন। স্যারকে ভয় লাগতো সবসময়। লতিফ স্যার সমাজ বিজ্ঞান পড়াতেন। একটু পরপর স্যার বলতেন বুছছো- এটা আমরা খুব উপভোগ করতাম। নুরুল আমিন স্যার অংক করাতেন। বৃহস্পতিবার ছিল জ্যামিতি। এই জ্যামিতির জন্য স্যারের হাতে মা’র খেয়েছি। স্যার চুলের মুঠি ধরে দাড় করাতেন। হক স্যার লম্বা বেত নিয়ে ক্লাসে আসলেও কখনো মারতেননা। তবে ভয় দেখানোর জন্য প্রতিদিনই বেত থাকতো হাতে। সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে টি আলী স্যারের কথা। স্যার আমাদের মাস্টর বেটা-মাস্টর বেটি বলে সম্বোধন করতেন। বাস্তব অনেক কথাই স্যার বলতেন তখন বুঝিনি। জীবেনর মুখোমুখি হয়ে এখন বুঝতে পারছি স্যার কী বলতেন। মুজিব স্যারের হাতে নামাজ না পড়ার জন্য অনেকবার মা’র খেয়েছি। বাবুল স্যারকে সবসময় গুরুগম্ভীর মনে হয়েছে। পন্ডিত স্যারের মুখে কখনো হাসি দেখিনি।আমাদের সময়ে এমএলএসএস ছিলেন আসক আলী নামে সত্তোরোর্ধ্ব একজন মানুষ। স্যাররা যখন তাকে- আসক আলী মিয়া বলে ডাকতেন তখন মনে হতো স্যারদের চেয়ে দ্বিগুন বয়সী একজন মানুষকে নাম ধরে ডাকেন কীভাবে?।বন্ধু-সহপাঠী অনেককেই আজ মনে পড়ছে। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী ছিল ফয়সল, জয়ন্ত, শেলী, মমতা, রাসনা, নূর মিয়া, জোবায়ের, মোহাদ্দিছ, ময়নুল, সুমন, ইমরান, শাহীন, লেচু, শাহীনূর।শিক্ষক বাবার সন্তান ফয়সল আমার মতো সেও শিক্ষকতা করছে। জয়ন্ত পুলিশ অফিসার। নিজস্ব যোগ্যতা দিয়ে সে ভালো করছে। ( একদিন আমাকে ভাত খাইয়েছে !)। তার মতো ছেলে পুলিশে আরও দরকার বলে আমি মনে করি। জোবায়ের পরপারে। একদিন হঠাৎ আমাদের এই নীরিহ বন্ধুটি অসুস্থ হয়ে পড়ে। মৃত্যুই তাকে নিয়ে যায় আমাদের কাছ থেকে। শেলী, মমতা, রাসনা এখন সংসারী। ময়নুল, সুমন, ইমরান, শাহীন,লেচু, শাহীনূর এখন বিদেশ বিভুইয়ে। শাহীন, লেচু ছিল জুটি। প্রতি সপ্তাহে তারা সিনেমা দেখতে যেতো। লতিফ স্যার নাম দিয়েছিলেন-লিচু-কাঠাল। নূর মিয়া এখন জাউয়াবাজারের বড় ব্যবসায়ী।ইমরান একটি ব্যাংকে চাকরি করছে। দুষ্টুর শিরোমনি ইমরান প্রায়ই স্কুল থেকে ‘ভাগা দিতো”। পরবর্তীতে সে অনেককেই সিগারেট খাওয়া শিখিয়েছে। শাহীনুরের সব শাখাতেই বিচরণ ছিল। সে ছিল স্কুলের পরিচিত মুখ। টিটু, সুমন, সুরঞ্জিত, মুহিবুর, শোয়েব, সেলিম ছিল আমার এলাকার ছেলে। বড় কাপনের সেলিমকে সবাই ক্ষেপাতো। আনন্দের খোরাক ছিল সেলিম। চেচান থেকে আসতো ফয়জুল। কম কথা বলতো সে।কৈতক থেকে আসতো মিঠু, ওমর, সেলিম, জুয়েল, নিজাম। তাদের অনেকের সাথে আর দেখা হয়নি।অনেক কাছের দূরের বন্ধুদের নাম মনে করতে পারছিনা। যেখানেই থাকিছ ভালো থাকিছ বন্ধু। আজ স্কুলের ৫০ বছর পূর্তিতে সকল শিক্ষক বন্ধু বান্ধবদের সু-স্বাস্থ দীর্ঘায়ু কামনা করছি।
লিখেছেন- ওহী আলম রেজা (ohee alom reza), সাংবাদিক (journalist)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন