সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

একজন বাউলের কথা

সুনামগঞ্জের হাওরবেষ্টিত এক প্রত্যন্ত এলাকার গ্রামের রাখাল বালক থেকে খ্যাতির শিখরে পৌঁছেছিলেন তিনি। ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জন্মেছিলেন আর বাংলা বাউল গানকে অভিভাবহীন করে চলে গেছেন ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর। সুদীর্ঘ এই জীবনে সমৃদ্ধ করে গেছেন বাংলা গানের ভান্ডার। ২০০১ সালে একুশে পদকে ভূষিত হয়েছিলেন তিনি। মানুষটাকে আমরা চিত্রিত করেছি গ্রামবাংলার এক বাউল হিসেবে, যে কিনা গান গায়, তাঁর গানে প্রেম, নিঃসঙ্গতা, সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভালোবাসা, অনুযোগ কিংবা ভালোবেসে প্রচন্ড কষ্ট পাওয়ার হতাশাটুকু ফুটে উঠেছে ঝলমলিয়ে।

বলছি শাহ আব্দুল করিমের কথা। আমরা তাঁর গুণগ্রাহীরা তাকে ‘বাউল সম্রাট’ হিসেবে জানি এবং মানি।

মানুষ আব্দুল করিম কেমন ছিলেন? তাঁর ভাবাদর্শ কেমন ছিল? তাঁর চেতনায় কোন সমাজের-পৃথিবীর স্বপ্ন খেলা করত? এসব আমাদের ভাবার অবসর হয়নি কখনও। তাঁর গানগুলোকে আমরা বিশ্লেষণ করেছি শুধু প্রেমের ভাবধারায়। অথচ কী গভীর দর্শনভাবনা তাঁর গানে লুকায়িত, তা আমরা খুঁজে দেখিনি।

অথচ প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে গান গেয়েই সারাজীবন কাটিয়ে দেয়া শাহ করিম শুধু বাউল ছিলেন না, ছিলেন আপাদমস্তক একজন সাম্যবাদী। হাল জমানার সমাজ-সংস্কারকদের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না তাঁর ভূমিকা।

তৎকালীন কুসংস্কারচ্ছন্ন সমাজ শুধু গান গাওয়ার দায়ে তাঁকে মুরতাদ (ধর্মদ্রোহী) আখ্যা দিয়ে ঈদের দিনে গ্রামছাড়া করেছে। বাউল করিম তাঁর ভাষ্যে বলেছেন, ‘প্রচলিত ধর্ম ব্যবস্থা আমাদের মধ্যে সম্প্রদায়গত বিদ্বেষ তৈরি করে দিয়েছে। কতিপয় হীন মোল্লা-পুরুত আমাদের ভাইয়ে ভাইয়ে বিভাজন নিয়ে এসেছে। এই বিভাজনই যদি ধর্ম হয়, সেই ধর্মের কপালে আমি লাত্থি মারি।’

গান বেঁধেছেন, গান গেয়েছেন, কষ্টেসৃষ্টে জীবন যাপন করেছেন, প্রিয়তমা স্ত্রী বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু বাউল করিম কখনও অর্থ-বিত্ত-খ্যাতির পেছনে ছুটেননি। এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তাঁকে তিন লক্ষ টাকা প্রদানের ঘোষণা দেবার সাথে সাথে মঞ্চ থেকে নেমে গিয়ে ছেলেকে বলেছেন, ‘বাবা জালাল, তিন হাজার টাকা আমি দেখিনি জীবনে। এত টাকা দিয়ে আমি কী করব?’

আত্মঅভিমানে ডুবে থাকা নির্লোভ এমন কয়জন মানুষ আমরা দেখতে পাই? কয়জন মানুষ লোভ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারে?

পানিবেষ্টিত ভাটিবাংলার একজন নিরক্ষর বাউল ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনের সময় ফুঁসে উঠেছেন ক্ষোভে। ‘বাঁচতে চাই’ নাম দিয়ে সংগঠন করে গ্রামে গ্রামে গান গেয়ে বেড়িয়েছেন আর বুঝিয়েছেন কেন বাংলা ভাষা রক্ষা ও স্বীকৃতি জরুরি। সেই সময় গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন বাউল করিম।

পুরো পৃথিবীতেই এমন সামাজিক আন্দোলনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়া, নিজের মতো করে ভাবাদর্শ প্রচার করা কয়জন শিল্পী-এক্টিভিস্ট দেখতে পাই আমরা?

বাউল শাহ আব্দুল করিমের জন্মবার্ষিকীতে শুধু একজন শিল্পী নয়,একজন আপাদমস্তক সাম্যবাদী, দার্শনিক হিসেবে তাঁকে এই অধম গুণগ্রাহীর অন্তর থেকে শ্রদ্ধা। ভাগ্যিস আপনি জন্মেছিলেন, নতুবা আমাদের ক্ষোভ-হতাশা-বেদনার কথাগুলো আমাদের মুখের ভাষায় কে এত সুন্দরভাবে প্রকাশ করত?

লেখক : আঞ্চলিক সমন্বয়কারী, এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইয়ুথ ভলান্টিয়ার্স সোসাইটি।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাউল সাধক চান মিয়া এবং আমার কিছু উপলব্ধি

"রজনী হইসনা অবসান  আজ নিশিতে আসতে পারেবন্ধু কালাচাঁন।। কত নিশি পোহাইলোমনের আশা মনে রইলো রে কেন বন্ধু আসিলোনা জুড়ায়না পরান। আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন।। বাসর সাজাই আসার আশেআসবে বন্ধু নিশি শেষে দারূন পিরিতের বিষে ধরিল উজান। আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন।। মেঘে ঢাকা আঁধার রাতে কেমনে থাকি একা ঘরে সাধক চাঁনমিয়া কয় কানতে কানতে হইলাম পেরেশান আজ নিশিতে আসতে বন্দু কালাচাঁন।"    গভীর নিশিতে ধ্যান মগ্ন হয়ে কালাচাঁনের অপেক্ষা করছেন সাধক।  সাধক চান মিয়ার শিষ্য বাউল সিরাজউদ্দিনের মতে এটি একটি রাই বিচ্ছেদ। কৃষ্ণের অপেক্ষায় রাধা নিশি বা রাতকে অনুরোধ করছেন 'রাত' যেন না পোহায়  কারণ তার কালা চান যে কোন সময় আসতে পারে। শব্দগুচ্ছ গুলো থেকে সহজেই উপলব্ধি হয় সাধক নিজ দেহকে রাধা আর আত্মাকে কৃষ্ণের সাথে তুলনা করেছেন। দেহ আত্মার মিলন ঘটানোই ছিল সাধকের সাধনা।        বাউল সাধক চান মিয়া উপরোক্ত গানটি রচনা করেছেন। নেত্রকোনা জেলার খাটপুরা গ্রামে ১৩২৫ বঙ্গাব্দে সাধক চান মিয়ার জন্ম। পুরো নাম চান্দেজ্জামান আকন্দ হলেও বা...

বাউল, বাউলতত্ব এবং কিছু কথা

একজন ভদ্র বন্ধু বরের সাথে বাউল সম্প্রদায় নিয়ে বেশ তর্ক হলো রাতে। তর্কের সূত্রপাত ছিল বাউলরা ভাববাদী না বস্তুবাদী। ভাবলাম "বাউলতত্ত্ব"র আলোকে বাউলরা ভাববাদী নাকি বস্তুবাদী তা নিয়ে যৌক্তিক আলোচনা আবশ্যম্ভাবী। কয়েকটি ধারাবাহিক পর্ব লিখে নিজের মনোভাব বোঝানোর চেষ্টা করব।  শুরুতেই শক্তিনাথ ঝাঁ এর বস্তুবাদী বাউল বই থেকে কিছু কথা লিখতে চাই; বাস্তব জগত ও জীবনকে এরা কোন আনুমানিক যুক্তি বা আলৌকিক যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে নারাজ। জৈব রাসায়নিক ব্যাখায় এরা নারীর রজঃ এবং পুরুষের বিজে জীবন ও জগত সৃষ্টিকে ব্যাখা করে এবং চার ভূতকে প্রাকৃতিক সৃষ্টি মনে করে। এভাবে মানুষে, প্রকৃতিতে তৈরি করে প্রাণ, প্রাণী। অনুমান ভিত্তিক স্বর্গ, নরক, পরলোক, পুনর্জন্মাদি প্রত্যক্ষ প্রমাণাভাবে বাউল আগ্রাহ্য করে। মানুষ ব্যাতিরিক্ত ঈশ্বরও এরা মানে না। সৃষ্টির নিয়মকে জেনে যিনি নিজেকে পরিচালনা করতে শিখেছেন- তিনিই সাঁই। সুস্থ নিরোগ দীর্ঘজীবন এবং আনন্দকে অনুভব করার বাউল সাধনা এক আনন্দমার্গ।।  বাউলরা ভাববাদী না বস্তুবাদী এর অনেক সূক্ষ বিশ্লেষণ শক্তিনাথের বস্তুবাদী বাউল বইটির মধ্যে আলকপাত করা হয়েছে। সাধারণ সমাজে এ ধা...

ভাইবে রাধারমণ

তখন কলেজের ছাত্র। বাংলা বিভাগের প্রভাষক শ্রদ্ধেয় রেজা স্যারের সাথে খুবই ভালো সম্পর্ক। কলেজের প্রথম দিনই স্যারকে খুব পছন্দ। তারপর স্যারের সাথে গল্প, সমাজ, রাজনীতি, সাহিত্য নিয়ে আলোচনা। রীতিমত ফিজিক্স, বায়োলোজি ক্লাস ফাঁকি দিলেও বাংলা ক্লাস কখনই ফাঁকি দিতাম না। খুব উপভোগ করতাম স্যারের ক্লাস। হোস্টেল সুপার হিসেবে স্যার ( ওহী আলম রেজা) আমাদের সাথেই থাকতেন। আমরা আসার প্রায় নয় মাস পর স্যার এলেন সুপার হিসেবে। প্রতিদিন রাতে খাবার পরেই স্যারের রুমে গিয়ে আড্ডা হত, গানের আসর হত। স্যারের পিসিতে প্রায়ই গান শুনতাম আমরা। একদিন হঠাৎ করেই একটি গান স্যার প্লে করলেন 'আমার বন্ধু দয়াময় তোমারে দেখিবার মনে লয়। তোমারে না দেখলে রাধার জীবন কেমনে রয় বন্ধুরে।। কদম ডালে বইসারে বন্ধু ভাঙ্গ কদম্বের আগা। শিশুকালে প্রেম শিখাইয়া যৌবনকালে দাগা রে।। তমাল ডালে বইসারে বন্ধু বাজাও রঙের বাশি। সুর শুনিয়া রাধার মন হইলো যে উদাসি রে।। ভাইবে রাধা রমন বলে মনেতে ভাবিয়া। নিভা ছিল মনের আগুন কে দিলাই জ্বালাইয়া রে।' গানের কথাগুলো বেশ ভালো লেগে গেলো। পুর গানটি শুনে বুঝলাম গানটি সাধক রাধারম...