সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

একজন ব্লগার হত্যাকাণ্ডের সালতামামি


১.
২০১১ সাল। কক্সবাজার ট্যুরে গিয়েছিলাম। সাথে আমার শিক্ষক সাংবাদিক অহী আলম রেজা। ট্রেনের সিডিউল ভয়াবহ বিপর্যয়। চট্রগ্রাম থেকে সিলেট ফিরলাম ১০ ঘন্টা লেইট ট্রেনে করে। ট্রেনে করে ফেরার সময় অনন্ত বিজয় দাশের সাথে প্রথম পরিচয়৷ মূলত আমি এবং অহী আলম রেজা স্যার ড.হুমায়ুন আজাদ স্যারকে নিয়ে আলোচনা করছিলাম। কথার প্রসঙ্গ বসত অনন্ত বিজয় আমাদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন আলোচনায়, সেই থেকে পরিচয়৷
২০১৫ সাল। সকালে ঘুম থেকে উঠলাম আনুমানিক ৮ টার দিকে। নিউজের কাজ শুরু করব। এক বড় ভাই কল দিয়ে বললেন সিলেট শহরের সুবিদ বাজার এলাকায় নাকি একজন লেখক খুন হয়েছেন, জানি নাকি কিছু! সাথে সাথে কল দিলাম আমার পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদককে। কল রিসিভ করেই তিনি দ্রুত সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের জরুরি বিভাগে যেতে বললেন। ১৫ মিনিটের মধ্যেই চলে গেলাম। হায়! স্ট্রেচারে নিথর দেহ পড়ে আছে ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশের। দুদিন আগেও যার সাথে দেখা হয়েছে, আড্ডা হয়েছে তার রক্তাক্ত নিথর দেহ। খুনিদের চাপাতির আঘাতে থেঁথলে যাওয়া মাথা থেকে টপ টপ করে তাজা রক্ত এখনো পড়ছে!  কি ভয়াবহ করুণ দৃশ্য!










২.
আজ ১২ মে। ২০১৫ সালের এই দিনে সিলেটে নিজ বাসার সামনে খুন হন বিজ্ঞান লেখক অনন্ত বিজয় দাশ। আজ তার হত্যাকাণ্ডের পাঁচ বছর পূর্ণ হতে চলছে। তবে পাঁচ বছরেও শেষ হয়নি চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার বিচার কাজ। ফলে এখনও জানা যায়নি অনন্তর খুনি কারা।
মামলার সাক্ষীদের আদালতে উপস্থিত করতে না পারায় বারবার পিছিয়ে যাচ্ছে শুনানির তারিখ। যদিও এই মামলার বিচার কার্যক্রম ৬ মাসের মধ্যে সম্পন্ন করার নির্দেশনা দিয়েছিলো হাই কোর্ট।
এ অবস্থায় বিচার নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনন্ত বিজয়ের পরিবারের সদস্য ও সহযোদ্ধারা। ইতোমধ্যে ছেলে হত্যার বিচার না দেখেই মারা গেছেন অনন্ত'র বাবা। তবে মামলার আইনজীবীরা জানিয়েছেন, সিলেটের অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত থেকে সম্প্রতি মামলাটি সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়েছে। এতে মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির আশা করছেন তারা।
২০১৫ সালের ১২ মে সকালে সিলেট নগরীর সুবিদবাজারে নিজ বাসার সামনে অনন্ত বিজয় দাশকে কুপিয়ে হত্যা করে একদল দুর্বৃত্ত। পেশায় ব্যাংকার অনন্ত বাসা থেকে অফিসে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হলে তাকে হত্যা করা হয়। বিজ্ঞান ও যুক্তিনির্ভর লেখালেখির কারণে ধর্মীয় উগ্রবাদীরা অনন্তকে হত্যা করেছে বলে প্রথম থেকেই দাবি করে আসছেন তার সহযোদ্ধারা।
অনন্ত বিজয় বিজ্ঞান বিষয়ক লেখালেখির পাশাপাশি 'যুক্তি' নামে একটি ছোটকাগজ সম্পাদনা করতেন। এছাড়া বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদি কাউন্সিল নামে বিজ্ঞান চর্চার একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন গণজাগরণ মঞ্চ সিলেটের সাথেও সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি।
অনন্ত বিজয় হত্যার পর তার ভাই রত্নেশ্বর দাশ বাদি হয়ে নগরীর বিমানবন্দর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। ধর্মীয় উগ্রবাদীদের সন্দেহ করেই এগিয়ে চলে এই মামলার তদন্ত।  দীর্ঘ তদন্ত শেষে মান্নান ইয়াহিয়া, আবুল খয়ের রশিদ আহমদ, শফিউর রহমান ফারাবী, আবুল হোসেন, ফয়সল আহমদ, হারুন অর রশিদকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেয় পুলিশ। এদের মধ্যে মান্নান ইয়াহিয়া কারাগারে আটক অবস্থায় মারা যান। তিনি এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছিলেন। বর্তমানে আবুল খয়ের রশিদ আহমদ ও শফিউর রহমান ফারাবী কারাগারে আটক এবং অপর আসামিরা শুরু থেকেই পলাতক রয়েছেন।
বিজ্ঞাপন
সিলেটের অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারধীন থাকা অবস্থায় সাক্ষীদের উপস্থিত করতে না পারায় সর্বশেষ তিনবার পিছিয়েছে মামলাটির শুনানির তারিখ। সর্বশেষ গত ১৩ ফেব্রুয়ারি সাক্ষীরা না আসায় শুনানির তারিখ পিছিয়ে দেন সিলেটের অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মমিনুন নেসা। এ অবস্থায় সিলেটে সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন হলে গত মার্চের প্রথম সপ্তাহে মামলাটি এই আদালতে স্থানন্তর করা হয়। এরপর করোনাভাইরাসের কারণে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় আর শুনানির তারিখ দেওয়া হয়নি।
(মামলার বর্তমান অবস্থা সিলেটটুডে নিউজ জার্নাল থেকে গৃহীত)

লেখক- চৌধুরী মারূফ, সাংবাদিক, ব্লগার


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাউল সাধক চান মিয়া এবং আমার কিছু উপলব্ধি

"রজনী হইসনা অবসান  আজ নিশিতে আসতে পারেবন্ধু কালাচাঁন।। কত নিশি পোহাইলোমনের আশা মনে রইলো রে কেন বন্ধু আসিলোনা জুড়ায়না পরান। আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন।। বাসর সাজাই আসার আশেআসবে বন্ধু নিশি শেষে দারূন পিরিতের বিষে ধরিল উজান। আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন।। মেঘে ঢাকা আঁধার রাতে কেমনে থাকি একা ঘরে সাধক চাঁনমিয়া কয় কানতে কানতে হইলাম পেরেশান আজ নিশিতে আসতে বন্দু কালাচাঁন।"    গভীর নিশিতে ধ্যান মগ্ন হয়ে কালাচাঁনের অপেক্ষা করছেন সাধক।  সাধক চান মিয়ার শিষ্য বাউল সিরাজউদ্দিনের মতে এটি একটি রাই বিচ্ছেদ। কৃষ্ণের অপেক্ষায় রাধা নিশি বা রাতকে অনুরোধ করছেন 'রাত' যেন না পোহায়  কারণ তার কালা চান যে কোন সময় আসতে পারে। শব্দগুচ্ছ গুলো থেকে সহজেই উপলব্ধি হয় সাধক নিজ দেহকে রাধা আর আত্মাকে কৃষ্ণের সাথে তুলনা করেছেন। দেহ আত্মার মিলন ঘটানোই ছিল সাধকের সাধনা।        বাউল সাধক চান মিয়া উপরোক্ত গানটি রচনা করেছেন। নেত্রকোনা জেলার খাটপুরা গ্রামে ১৩২৫ বঙ্গাব্দে সাধক চান মিয়ার জন্ম। পুরো নাম চান্দেজ্জামান আকন্দ হলেও বা...

বাউল, বাউলতত্ব এবং কিছু কথা

একজন ভদ্র বন্ধু বরের সাথে বাউল সম্প্রদায় নিয়ে বেশ তর্ক হলো রাতে। তর্কের সূত্রপাত ছিল বাউলরা ভাববাদী না বস্তুবাদী। ভাবলাম "বাউলতত্ত্ব"র আলোকে বাউলরা ভাববাদী নাকি বস্তুবাদী তা নিয়ে যৌক্তিক আলোচনা আবশ্যম্ভাবী। কয়েকটি ধারাবাহিক পর্ব লিখে নিজের মনোভাব বোঝানোর চেষ্টা করব।  শুরুতেই শক্তিনাথ ঝাঁ এর বস্তুবাদী বাউল বই থেকে কিছু কথা লিখতে চাই; বাস্তব জগত ও জীবনকে এরা কোন আনুমানিক যুক্তি বা আলৌকিক যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে নারাজ। জৈব রাসায়নিক ব্যাখায় এরা নারীর রজঃ এবং পুরুষের বিজে জীবন ও জগত সৃষ্টিকে ব্যাখা করে এবং চার ভূতকে প্রাকৃতিক সৃষ্টি মনে করে। এভাবে মানুষে, প্রকৃতিতে তৈরি করে প্রাণ, প্রাণী। অনুমান ভিত্তিক স্বর্গ, নরক, পরলোক, পুনর্জন্মাদি প্রত্যক্ষ প্রমাণাভাবে বাউল আগ্রাহ্য করে। মানুষ ব্যাতিরিক্ত ঈশ্বরও এরা মানে না। সৃষ্টির নিয়মকে জেনে যিনি নিজেকে পরিচালনা করতে শিখেছেন- তিনিই সাঁই। সুস্থ নিরোগ দীর্ঘজীবন এবং আনন্দকে অনুভব করার বাউল সাধনা এক আনন্দমার্গ।।  বাউলরা ভাববাদী না বস্তুবাদী এর অনেক সূক্ষ বিশ্লেষণ শক্তিনাথের বস্তুবাদী বাউল বইটির মধ্যে আলকপাত করা হয়েছে। সাধারণ সমাজে এ ধা...

ভাইবে রাধারমণ

তখন কলেজের ছাত্র। বাংলা বিভাগের প্রভাষক শ্রদ্ধেয় রেজা স্যারের সাথে খুবই ভালো সম্পর্ক। কলেজের প্রথম দিনই স্যারকে খুব পছন্দ। তারপর স্যারের সাথে গল্প, সমাজ, রাজনীতি, সাহিত্য নিয়ে আলোচনা। রীতিমত ফিজিক্স, বায়োলোজি ক্লাস ফাঁকি দিলেও বাংলা ক্লাস কখনই ফাঁকি দিতাম না। খুব উপভোগ করতাম স্যারের ক্লাস। হোস্টেল সুপার হিসেবে স্যার ( ওহী আলম রেজা) আমাদের সাথেই থাকতেন। আমরা আসার প্রায় নয় মাস পর স্যার এলেন সুপার হিসেবে। প্রতিদিন রাতে খাবার পরেই স্যারের রুমে গিয়ে আড্ডা হত, গানের আসর হত। স্যারের পিসিতে প্রায়ই গান শুনতাম আমরা। একদিন হঠাৎ করেই একটি গান স্যার প্লে করলেন 'আমার বন্ধু দয়াময় তোমারে দেখিবার মনে লয়। তোমারে না দেখলে রাধার জীবন কেমনে রয় বন্ধুরে।। কদম ডালে বইসারে বন্ধু ভাঙ্গ কদম্বের আগা। শিশুকালে প্রেম শিখাইয়া যৌবনকালে দাগা রে।। তমাল ডালে বইসারে বন্ধু বাজাও রঙের বাশি। সুর শুনিয়া রাধার মন হইলো যে উদাসি রে।। ভাইবে রাধা রমন বলে মনেতে ভাবিয়া। নিভা ছিল মনের আগুন কে দিলাই জ্বালাইয়া রে।' গানের কথাগুলো বেশ ভালো লেগে গেলো। পুর গানটি শুনে বুঝলাম গানটি সাধক রাধারম...