সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

কালনীর জলে নিভে যাক যত অশুভ আগুন

উজানধল গ্রাম এখন খুব পরিচিত একটি গ্রামের নাম। বাউল শাহ আবদুল করিমের গ্রাম উজানধল। কালনী নদীর তীরে এই গ্রাম। এই নদীর জলে, এই গ্রামের সবুজ ছায়ায়, হাওরের বিস্তীর্ণ প্রান্তরের হাওয়ায় বাউল হয়েছিলেন করিম। এই গ্রামেরই তার শিষ্য রণেশ ঠাকুরের গানের ঘরে আগুন দেওয়া হয়েছে। এ আগুন তো দেওয়া হল বাংলার বাউল চেতনার ঘরে। কিন্তু এই চেতনা, চিন্তা কি আগুনে পুড়ে?

রুহি ঠাকুর ও রণেশ ঠাকুর দুই ভাই। তারা সারাজীবনই শুদ্ধভাবে গেয়েছেন করিমের গান। রুহি ঠাকুর বেঁচে নেই। রণেশ ঠাকুর এখনো গেয়ে চলেছেন গান। করিমের গান। তাঁদের পিতা ছিলেন উজানধলের কীর্তনীয়া। তাদের পাশের বাড়িই হচ্ছে বাউল শাহ আবদুল করিমের বাড়ি। তাই স্বাভাবিক ভাবেই গানের প্রতি তাদের অনুরাগ। গ্রহণ করেছিলেন বাউল করিমের শিষ্যত্ব। গানই রণেশ ঠাকুরের ধ্যান, সবকিছু। করিমের সেই গানেরই মত “আর কিছু চায় না মনে গান ছাড়া"।

গানই তার নেশা ও পেশা। তাই বোধহয় গানের জন্য তার আলাদা ঘর। গানঘর। সেই ঘরে রাখা ছিল তার বাদ্যযন্ত্র ও গানের বই। সেই সাধনার গানঘর কেউ জ্বালিয়ে দিতে পারে এটা ভাবাই যায় না। খবরে প্রকাশ, ঘরের একপাশে দুটো ভেড়া ছিল। এগুলো বের করে দিয়ে আগুন ধরানো হয়েছে। বুঝাই যাচ্ছে যারা আগুন দিয়েছে তাদের খুব ক্ষোভ রয়েছে বাউলের বেহালায়, দোতরায়।
বিজ্ঞাপন


এই উজানধলের আকাশের নিচের কোন মানুষ বাউলের গানঘরে আগুন দিচ্ছে, এটা কোনভাভেই মেনে নেয়া যাচ্ছে না, মেনে নেয়া যায় না। বাউল করিম গানের মাধ্যামে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনা, শান্তির বার্তা। তিনি গেয়েছেন খেটে খাওয়া মানুষের গান। গানেই ছড়িয়েছেন প্রেম, ভালোবাসা। তার শিষ্য রণেশ ঠাকুর এই চেতনার ধারক, বাহক। রণেশ ঠাকুরের কন্ঠেই প্রতিধ্বনিত হয় করিমের সেই গান “বিপন্ন মানুষের দাবি করিম চায় শান্তির বিধান” কিংবা “শোষক তুমি হও হুশিয়ার”। করিমের গান জনপ্রিয়তার পেছনের রুহী ঠাকুর ও রণেশ ঠাকুরের ভূমিকা অনেক।

বাউল এবং তাদের চেতনার সত্যিকারে ধারক ও বাহক সাধারণত নির্বিবাদী মানুষ হন। ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে হয় তাদের অবস্থান। রণেশ ঠাকুরকে যারা চিনেন তারা একবাক্যে তা স্বীকার করেন। এমন নির্বিবাদী মানুষের গানঘরে আগুন দিল, ওরা কারা? বাউলের দোতরা, বেহালা পুড়িয়ে ফেলা যায়। জোর করে তাদের চুল কেটে ফেলা যায়। গ্রাম ছাড়া করা যায়। কিন্তু বাউল চেতনা ধ্বংস করা যায় না। বাউল করিমকে গানের জন্য উজানধল ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল। কিন্ত আজ উজানধল আর বাউল করিম সমার্থক। রণেশ ঠাকুরের গানঘরে যারা আগুন দিয়েছে তারা যেন এটা ভুলে না যায়।   

উজানধল গ্রামে এখন প্রতি বছর বাউল করিম লোক উৎসব হয়। আধুনিক বাদ্যযন্ত্রে, শব্দযন্ত্রে, আলোর ঝলকানিতে গীত হয় করিমের গান। চারিদিকে শোভা পায় কর্পোরেট বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনের আড়ালে, আলোর ঝলকানিতে যেন হারিয়ে না যায় করিমের গানের মূল বার্তা।

হারিকেনের আলোয় বাউল করিমের উঠানে গানের আসরে যে সুর,বার্তা ছড়িয়ে পড়ত, আমরা সেই সুর ধরতে চাই। জোনাকির আলোয় করিমের গান গেয়ে পথ খুঁজে বাড়ি ফিরত যারা আমরা সেই পথের সন্ধান চাই। বাউল করিমের গানের মুল বার্তা যত প্রচার করা যাবে, অনুভব করা যাবে ততই রুখে দেয়া যাবে যত আসুরিক তৎপরতা।
বাউল করিমের গান ছড়িয়ে আছে কালনীর জলে। সে জলে আজো নৌকা বেয়ে চলেছেন রণেশ ঠাকুর। তিনি বিচার পাবেন কি না জানি না কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি কালনীর সেই জলেই নিভে যাবে যত অশুভ আগুন।

লেখকঃ শ্যামল কান্তি ধর: ব্যাংকার। 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাউল সাধক চান মিয়া এবং আমার কিছু উপলব্ধি

"রজনী হইসনা অবসান  আজ নিশিতে আসতে পারেবন্ধু কালাচাঁন।। কত নিশি পোহাইলোমনের আশা মনে রইলো রে কেন বন্ধু আসিলোনা জুড়ায়না পরান। আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন।। বাসর সাজাই আসার আশেআসবে বন্ধু নিশি শেষে দারূন পিরিতের বিষে ধরিল উজান। আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন।। মেঘে ঢাকা আঁধার রাতে কেমনে থাকি একা ঘরে সাধক চাঁনমিয়া কয় কানতে কানতে হইলাম পেরেশান আজ নিশিতে আসতে বন্দু কালাচাঁন।"    গভীর নিশিতে ধ্যান মগ্ন হয়ে কালাচাঁনের অপেক্ষা করছেন সাধক।  সাধক চান মিয়ার শিষ্য বাউল সিরাজউদ্দিনের মতে এটি একটি রাই বিচ্ছেদ। কৃষ্ণের অপেক্ষায় রাধা নিশি বা রাতকে অনুরোধ করছেন 'রাত' যেন না পোহায়  কারণ তার কালা চান যে কোন সময় আসতে পারে। শব্দগুচ্ছ গুলো থেকে সহজেই উপলব্ধি হয় সাধক নিজ দেহকে রাধা আর আত্মাকে কৃষ্ণের সাথে তুলনা করেছেন। দেহ আত্মার মিলন ঘটানোই ছিল সাধকের সাধনা।        বাউল সাধক চান মিয়া উপরোক্ত গানটি রচনা করেছেন। নেত্রকোনা জেলার খাটপুরা গ্রামে ১৩২৫ বঙ্গাব্দে সাধক চান মিয়ার জন্ম। পুরো নাম চান্দেজ্জামান আকন্দ হলেও বা...

বাউল, বাউলতত্ব এবং কিছু কথা

একজন ভদ্র বন্ধু বরের সাথে বাউল সম্প্রদায় নিয়ে বেশ তর্ক হলো রাতে। তর্কের সূত্রপাত ছিল বাউলরা ভাববাদী না বস্তুবাদী। ভাবলাম "বাউলতত্ত্ব"র আলোকে বাউলরা ভাববাদী নাকি বস্তুবাদী তা নিয়ে যৌক্তিক আলোচনা আবশ্যম্ভাবী। কয়েকটি ধারাবাহিক পর্ব লিখে নিজের মনোভাব বোঝানোর চেষ্টা করব।  শুরুতেই শক্তিনাথ ঝাঁ এর বস্তুবাদী বাউল বই থেকে কিছু কথা লিখতে চাই; বাস্তব জগত ও জীবনকে এরা কোন আনুমানিক যুক্তি বা আলৌকিক যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে নারাজ। জৈব রাসায়নিক ব্যাখায় এরা নারীর রজঃ এবং পুরুষের বিজে জীবন ও জগত সৃষ্টিকে ব্যাখা করে এবং চার ভূতকে প্রাকৃতিক সৃষ্টি মনে করে। এভাবে মানুষে, প্রকৃতিতে তৈরি করে প্রাণ, প্রাণী। অনুমান ভিত্তিক স্বর্গ, নরক, পরলোক, পুনর্জন্মাদি প্রত্যক্ষ প্রমাণাভাবে বাউল আগ্রাহ্য করে। মানুষ ব্যাতিরিক্ত ঈশ্বরও এরা মানে না। সৃষ্টির নিয়মকে জেনে যিনি নিজেকে পরিচালনা করতে শিখেছেন- তিনিই সাঁই। সুস্থ নিরোগ দীর্ঘজীবন এবং আনন্দকে অনুভব করার বাউল সাধনা এক আনন্দমার্গ।।  বাউলরা ভাববাদী না বস্তুবাদী এর অনেক সূক্ষ বিশ্লেষণ শক্তিনাথের বস্তুবাদী বাউল বইটির মধ্যে আলকপাত করা হয়েছে। সাধারণ সমাজে এ ধা...

ভাইবে রাধারমণ

তখন কলেজের ছাত্র। বাংলা বিভাগের প্রভাষক শ্রদ্ধেয় রেজা স্যারের সাথে খুবই ভালো সম্পর্ক। কলেজের প্রথম দিনই স্যারকে খুব পছন্দ। তারপর স্যারের সাথে গল্প, সমাজ, রাজনীতি, সাহিত্য নিয়ে আলোচনা। রীতিমত ফিজিক্স, বায়োলোজি ক্লাস ফাঁকি দিলেও বাংলা ক্লাস কখনই ফাঁকি দিতাম না। খুব উপভোগ করতাম স্যারের ক্লাস। হোস্টেল সুপার হিসেবে স্যার ( ওহী আলম রেজা) আমাদের সাথেই থাকতেন। আমরা আসার প্রায় নয় মাস পর স্যার এলেন সুপার হিসেবে। প্রতিদিন রাতে খাবার পরেই স্যারের রুমে গিয়ে আড্ডা হত, গানের আসর হত। স্যারের পিসিতে প্রায়ই গান শুনতাম আমরা। একদিন হঠাৎ করেই একটি গান স্যার প্লে করলেন 'আমার বন্ধু দয়াময় তোমারে দেখিবার মনে লয়। তোমারে না দেখলে রাধার জীবন কেমনে রয় বন্ধুরে।। কদম ডালে বইসারে বন্ধু ভাঙ্গ কদম্বের আগা। শিশুকালে প্রেম শিখাইয়া যৌবনকালে দাগা রে।। তমাল ডালে বইসারে বন্ধু বাজাও রঙের বাশি। সুর শুনিয়া রাধার মন হইলো যে উদাসি রে।। ভাইবে রাধা রমন বলে মনেতে ভাবিয়া। নিভা ছিল মনের আগুন কে দিলাই জ্বালাইয়া রে।' গানের কথাগুলো বেশ ভালো লেগে গেলো। পুর গানটি শুনে বুঝলাম গানটি সাধক রাধারম...