থমকে যাওয়া জীবন যেন ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে ফ্রান্সে। গত ১১ মে লক-ডাউন শিথিল হবার পর থেকে মানুষ বেরিয়েছেন ,কাজে যাচ্ছেন, জীবনের তাগিদে ছুটছেন কর্মের পিছনে। ফ্রান্সের বুল-বার্ড (চৌরাস্তা) গুলোর মোড়ে মোড়ে বাড়তে শুরু করেছে জনসমাগম।
১৬ মে স্থানীয় সময়ে বিকেল ৭ টায় অভারভিলা শহরের এন্দ্রি কারমান বাস স্টপে কথা হচ্ছিল ফ্রান্সে বসবাস করা বাংলাদেশের কুলাউড়া উপজেলার এস কে হোসাইন রাহাতের সাথে। কুশল বিনিময়ের প্রসঙ্গে তিনি জানালেন, গত ১২ মে থেকে উনার কাজ শুরু হয়েছে। ফ্রান্সের পর্যটন খ্যাত এলাকা এনভার্সের একটি রেস্টুরেন্টে তিনি কাজ করেন। তিনি জানালেন তিনি যে রেস্টুরেন্টে কাজ করেন সেখানে শুধু পার্সেল সার্ভিস দেওয়া হচ্ছে খাবারের। সে জন্য তাকে কাজে যেতে হচ্ছে। ফ্রান্স সরকারের নিকট থেকে যে প্রণোদনা সুবিধা পাচ্ছেন বিভিন্ন রেস্টুরেন্টের কর্মচারীরা, তা তিনি পাবেন কিনা এমন প্রশ্নে তিনি জানালেন, "হয়তো" পাবেন। কিন্তু তার রেস্টুরেন্টের মালিক এখন পর্যন্ত কোন কিছু কনফার্ম করেন নি।
১৫ মে গিয়েছিলাম ফ্রান্সের সাইন্স ইন্ড্রাস্টি খ্যাত পর্যটন এলাকা 'পার্ক দ্যু পখ দ'লা ভিলা' তে। দেখা গেলো পুরো পার্ক এখনো পর্যটন শূন্য। পার্কের পাশে থাকা ছোট ছোট দোকান গুলো এখনো বন্ধ রয়েছে। পার্কের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া ফ্রান্সে বসবাস করা একজন রোমানিয়ান নাগরিক ক্যথরিন আলভিনা নামক একজন নাগরিকের সাথে। তিনি জানালেন, উনার দুইজন বাচ্চা আছে, যাদের বয়স সাড়ে ৫ এবং ৩ বছর। লক-ডাউন জনিত কারণে ঘরে বসে থাকতে বাচ্চারা মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাই তিনি বাচ্চাদের নিয়ে হাঁটতে বের হয়েছিলেন।
১১ মে লক ডাউন শিথিল হবার ফ্রান্সে বসবাস করা বাংলাদেশিদের আনাগোনাও বেড়েছে। প্যারিস, অভারভিলা, লাকরনভ, সেইন্ট ডেনিস প্রভৃতি এলাকা গুলোতে বসবাস করা বাংলাদেশিরাও ঘর থেকে বের হচ্ছেন, কেনাকাটা করছেন। ব্যস্ততা বাড়ছে জীবনের।
১৫ মে থেকে ফ্রান্সে ২০১৯-২০ সালের সরকারী ট্যাক্স ফর্ম ফিলাপ (ইম্পোটস) শুরু হওয়ার কারণে অঞ্চল ভিত্তিক ট্যাক্স অফিস গুলোতে বাংলাদেশি জনসাধারণের চলাচল ছিল চোখে পড়ার মত।
তবে সকল কিছু যে সুখ বা শান্তির তা একদম নয়। এই দীর্ঘ লক-ডাউনের কারণে অনেকে হারিয়েছেন কাজ, অনেকে পাননি এখনো বিভিন্ন ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ মাসের বেতন। ফ্রান্সে অবস্থান করা বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের অশিষ দাশের সাথে কথা বলে জানা গেলো, তিনি একটি ট্যাক্সি ফোন দোকানে কাজ করতেন। কিন্তু করোনা প্রভাবের কারণে লক ডাউন হয়ে যাবার কারণে উনি কাজ হারিয়েছেন। ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ মাসের অর্ধেক তিনি কাজ করেছিলেন তাও মালিক এখনো তাকে পরিশোধ করে নি। তিনি ফ্রান্সের অনিয়মিত বাসিন্দা হওয়ায় সরকারের কোন প্রণোদনা সুবিধাও পাবেন না।
তবে হাহাকারের পিছনে আছে কিছু মানবতাবাদীদের ও কথা। গত ১৬ মার্চ থেকে লক ডাউন শুরু হবার পর থেকে ফ্রান্সে বাংলাদেশি কমিউনিটি ভিত্তিক ছোট বড় অনেক সংগঠন লক ডাউনে বাসায় অবস্থান করা বাংলাদেশিদের মাঝে পৌঁছে দিয়েছেন খাদ্য সামগ্রী।
লক ডাউন শিথিল হবার পর ফ্রান্সে খুলে দেয়া হয়েছে বেশ কিছু এয়ারলাইন্স। তবে এয়ারলাইন্সে গুলো বেশ কিছু কড়াকড়ি নিয়ম মেনে তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে। এয়ার ফ্রান্সও জানিয়েছে, তাদের নানা বিধিনিষেধের কথা। এয়ার ফ্রান্সে বোর্ডিং পাশ নিতে যাত্রীদের বাধ্যতামূলক তাপমাত্রা পরিমাপ করতে হবে। তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে হলে বোর্ডিং পাস মিলবে না।
করোনা প্রভাবের পর লক ডাউন শিথিল হয়ে গেলোও শতভাগ চালু হচ্ছেনা গণ পরিবহন। ১১ মে'র পর থেকে ৩০২ টি স্টেশনের মধ্যে ৬০ টি পাতাল রেল স্টেশন বন্ধ এবং বাকিগুলো খুলা রয়েছে। এদিন রাজধানী জুড়ে ৭৫ শতাংশ মেট্রো, আরইআর, ট্রাম ও বাস চলাচল করবে। প্রতি ৪ টি মেট্রোর মধ্যে ৩টি চলাচল করবে। ১ ও ১৪ নং মেট্রো শতভাগ চলাচল করলেও ১৩ নং মেট্রো চলবে ৮৫ ভাগ। এছাড়া ট্রাম চলবে শতকরা ৮০ থেকে ১০০ ভাগ। এছাড়া আরইআর প্রতি ৪ টিতে ৩টি। এছাড়া বাস চলাচল করবে ৭৫ শতাংশ।
করোনা ভাইরাসের প্রভাবে স্থবির হইয়ে যাওয়া জীবন এভাবেই চলতে শুরু করেছে আবার। থমকে যাওয়া জীবনকে কর্মের প্লাটফর্মে হাঁটাচ্ছেন ফ্রান্সে বসবাস করা বাংলাদেশিরা। জীবন এভাবেই, মানুষ খোঁজে করে ব্যস্ততার প্রয়াস , চলে জীবনের বাঁকে বাঁকে।
লেখকঃ চৌধুরী মারূফ, সাংবাদিক
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন