সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

গুজব মিটারে রঙ চা থানকুনি



ঘুম থেকে উঠার পর থেকেই ইনবক্স ভর্তি মেসেজ। চা নিয়ে হৈ হুল্লুড়। ভাবলাম হয়তো দেশে চা পাতার দাম বেড়ে গেছে। একজন কে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে ? সে জানলো রঙ চা কাহিনী!

‘রঙ চা খেলে নাকি মুক্তি মিলবে প্রাণঘাতী করোনা থেকে।' 'সাথে দিতে হবে আদা, দারুচিনি, লং।' এমন বার্তা দিয়ে জন্মের ৫ মিনিটের পরই নাকি এক নবজাতক মারা গেছে। কেউ কেউ দাবি করছেন সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেল থেকে খবরটি সিলেট শহরে পৌঁছে। আবার কেউ দাবি করেন সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার মীরপুরে নাকি বৃহস্পতিবার (২৬ মার্চ) সন্ধ্যায় একটি নবজাতকের জন্ম হয়েছে। অপর একজন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার আত্বীয় এক মহিলার নবজাতক শিশু এমনটি বলে মৃত্যুবরণ করেছে বলে স্ট্যাটাস দেন। একেক জন একেক এলাকা থেকে সামাজিক যোগাযেগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়ে নিজের এলাকায় ঘটনাটি ঘটেছে বলে দাবি করছেন। এরপর থেকেই সিলেটজুড়ে রঙ চা খাওয়ার হিড়িক পড়ে। অনেকে গুজব জেনেও চা খাচ্ছেন।

ঘটনা শুনে হাসবো না রাগ করব বোঝতে পারছিলাম না! আসলে ভাবছি আমাদের সাধারণ জ্ঞানের পরিধি কতটুকু নিচে নেমে গেছে সেটাই ভেবে পাচ্ছিনা। আমরা যে কি পরিমাণ হুজুগে সমাজে রূপান্তরিত হচ্ছি তার একটি উদাহরণ মাত্র এই রঙ চা কাহিনী। আমরা একটি ক্রান্তিলগ্নে দাঁড়িয়ে আছি। কোথায় আমরা সচেতন হব তা বাদ দিয়ে আমরা গুজবের পিছনে ছুটছি। আমাদের পিছনে আরো একটি দুষ্টচক্র আছে। এরা হচ্ছে গুজব সৃষ্টিকারী চক্র। কোন একটি ক্রাইসিস মোমেন্ট তৈরি হলে কিভাবে সেটিকে কেন্দ্র করে একটি উদ্ভট পরিস্থিতি তৈরি করা যায় এরা এসব নিয়ে ওঁত পেতে থাকে। শুধু সামাজিক ক্রাইসিস মোমেন্টে নয় রাজনৈতিক ক্রাইসিস মোমেন্ট গুলোতেও এরা গুজব ছড়ায় বিভ্রান্তি তৈরি করে। মহান ৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধে দন্ডপ্রাপ্ত আসামী জামায়াত ইসলামী নেতা রাজাকার দেলোওয়ার হোসেন সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে নিয়ে গুজব সৃষ্টি করে দেশের উত্তরাঞ্চল সহ পুর দেশে কি একটা ভয়ানক পরিবেশ তথা রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল মনে আছে কি!

আসলে আমাদের গোড়ামি বিভ্রান্ত হওয়ার মাত্রা "গুজব মিটারে" খুবই পজেটিভ । এটা সেই পুরোনো ইতিহাস থেকেই। একসময় কার্তিক বা অগ্রহায়ণ মাসের দিকে মামস বা গলার ডানপাশে টন্সিলের ব্যাথা হলে আমরা বলতাম " ওলা বিবি আসছে"। সেই ওলা বিবি আসেন খুড়া কুকুরের রূপ ধরে। তখন কুকুর মারার ধুম পড়ে গেলো। আসলে কার্তিক মাসে কুকুরের প্রজনন সময় থাকে। তাই কুকুরের মুভমেন্ট থাকে এগ্রেসিভ। অপরদিকে মানব শরীরে তখন তাপমাত্রা উঠানামা করে কারণ বাংলাদেশের আবহাওয়ায় কার্তিক আগ্রহায়ণ মাসে তাপমাত্রা পরিবর্তন হয়, তখন গরম থেকে শীতকাল আসে। সুতরাং সর্দি কাশি টনসিল ব্যাথা হতেই পারে। ওলা বিবি এখন নাই কিন্তু রঙ চা বাবু এখনো আছে! তাহলে আমরা পরিবর্তন কিভাবে হলাম, কিভাবে আধুনিক হলাম!

রঙ চা কাহিনী শেষ হবার আগে ১৮ মার্চ গুজব উঠে ‘ফজরের নামাজের আগে তিনটা থানকুনি পাতা চিবিয়ে খেলে মুক্তি মিলবে’ এমন গুজব উঠেছে।

আসলে থানকুনি পাতা ক্ষত সারায়, আমাশয় ছাড়ায় এবং কাশির প্রকোপ কমে। এর থেকে আদা আরো বেশি উপকারী। আসলে এখানে আমি দুটি জিনিস ভাবছি। একটি হচ্ছে, কোন ভাবে যদি একটি পণ্যের দাম কোন ভাবেই বাড়ানো যায় তাহলে আমাদের ক্যাশবক্স হুহু করে ভরে  উঠবে। থানকুনি কাজে লাগেনি, এখন কাজে লাগানো হচ্ছে চা পাতা। একটি দুষ্ট চক্র আছেই এসবের পিছনে লেগে, যদি কোন ভাবে অতিরিক্ত মুনাফা লাভ করা যায় কোন একটি পণ্য দিয়ে।

আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতার যদি কথা বলতে হয়, তবে প্রথমেই বলতে হবে আমরা সচেতন নই। আমি নিজেই নই। কোন একটি ব্যাপার হয়তো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখলাম দেখেই বোঝে না বোঝে প্রচারে লেগে গেলাম। খুব সাধারণ জিনিস, একটি জিনিসের উপকারিতা, অপকারিতা সার্চ দিলেই গুগলে পরিষ্কার ভাবে পাওয়া যায় সংবাদ মাধ্যমগুলোতে। সব ব্যাপারের দুটো দিকই পাওয়া যায়। নিজে নিজেই জাস্টিফাই করলেও ত আমরা বোঝতে পারি কোনটি সঠিক বা কোনটি বেঠিক ।

আরেকটি দিক লক্ষ্য করছি , তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে ধর্মীয় সেন্সিভিটি কাজে লাগিয়ে একদল ফায়দা লুটতে চায় । বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া এবং আফ্রিকার দরিদ্র দেশ গুলোতে। কিছুদিন আগে দেখলাম ভারতে গো মূত্র খাবার হিড়িক,খেতে খেতে একবারে হাসপাতাল পর্যন্ত ভর্তি। বাংলাদেশে দেখলাম পোস্টার বিলি হচ্ছে কোভিড ১৯ নাকি কাফেরদের চক্রান্ত, এটা নাকি কোন ভাইরাস নয়। আজ দেখলাম আবার সংবাদপত্রে সাউথ আফ্রিকায় চার্চের ফাদারের কথায় ডেটল লিকুইয়ড খেয়ে মৃত ৫৫। এই সব ঘটনাই হচ্ছে একি সূত্রে বাঁধা । সমস্যাকে সমস্যা বলে চিহ্নিত না করে  গুজব বিভ্রান্তিতে ঘুরতে থাকে আমাদের মানসিকতা ।  এবং এটিও একটি মহামারি আমাদের জন্য।

লিখেছেন- চৌধুরী মারূফ, সাংবাদিক, অনলাইন এক্টিভিস্ট

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাউল সাধক চান মিয়া এবং আমার কিছু উপলব্ধি

"রজনী হইসনা অবসান  আজ নিশিতে আসতে পারেবন্ধু কালাচাঁন।। কত নিশি পোহাইলোমনের আশা মনে রইলো রে কেন বন্ধু আসিলোনা জুড়ায়না পরান। আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন।। বাসর সাজাই আসার আশেআসবে বন্ধু নিশি শেষে দারূন পিরিতের বিষে ধরিল উজান। আজ নিশিতে আসতে পারে বন্ধু কালাচাঁন।। মেঘে ঢাকা আঁধার রাতে কেমনে থাকি একা ঘরে সাধক চাঁনমিয়া কয় কানতে কানতে হইলাম পেরেশান আজ নিশিতে আসতে বন্দু কালাচাঁন।"    গভীর নিশিতে ধ্যান মগ্ন হয়ে কালাচাঁনের অপেক্ষা করছেন সাধক।  সাধক চান মিয়ার শিষ্য বাউল সিরাজউদ্দিনের মতে এটি একটি রাই বিচ্ছেদ। কৃষ্ণের অপেক্ষায় রাধা নিশি বা রাতকে অনুরোধ করছেন 'রাত' যেন না পোহায়  কারণ তার কালা চান যে কোন সময় আসতে পারে। শব্দগুচ্ছ গুলো থেকে সহজেই উপলব্ধি হয় সাধক নিজ দেহকে রাধা আর আত্মাকে কৃষ্ণের সাথে তুলনা করেছেন। দেহ আত্মার মিলন ঘটানোই ছিল সাধকের সাধনা।        বাউল সাধক চান মিয়া উপরোক্ত গানটি রচনা করেছেন। নেত্রকোনা জেলার খাটপুরা গ্রামে ১৩২৫ বঙ্গাব্দে সাধক চান মিয়ার জন্ম। পুরো নাম চান্দেজ্জামান আকন্দ হলেও বা...

বাউল, বাউলতত্ব এবং কিছু কথা

একজন ভদ্র বন্ধু বরের সাথে বাউল সম্প্রদায় নিয়ে বেশ তর্ক হলো রাতে। তর্কের সূত্রপাত ছিল বাউলরা ভাববাদী না বস্তুবাদী। ভাবলাম "বাউলতত্ত্ব"র আলোকে বাউলরা ভাববাদী নাকি বস্তুবাদী তা নিয়ে যৌক্তিক আলোচনা আবশ্যম্ভাবী। কয়েকটি ধারাবাহিক পর্ব লিখে নিজের মনোভাব বোঝানোর চেষ্টা করব।  শুরুতেই শক্তিনাথ ঝাঁ এর বস্তুবাদী বাউল বই থেকে কিছু কথা লিখতে চাই; বাস্তব জগত ও জীবনকে এরা কোন আনুমানিক যুক্তি বা আলৌকিক যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে নারাজ। জৈব রাসায়নিক ব্যাখায় এরা নারীর রজঃ এবং পুরুষের বিজে জীবন ও জগত সৃষ্টিকে ব্যাখা করে এবং চার ভূতকে প্রাকৃতিক সৃষ্টি মনে করে। এভাবে মানুষে, প্রকৃতিতে তৈরি করে প্রাণ, প্রাণী। অনুমান ভিত্তিক স্বর্গ, নরক, পরলোক, পুনর্জন্মাদি প্রত্যক্ষ প্রমাণাভাবে বাউল আগ্রাহ্য করে। মানুষ ব্যাতিরিক্ত ঈশ্বরও এরা মানে না। সৃষ্টির নিয়মকে জেনে যিনি নিজেকে পরিচালনা করতে শিখেছেন- তিনিই সাঁই। সুস্থ নিরোগ দীর্ঘজীবন এবং আনন্দকে অনুভব করার বাউল সাধনা এক আনন্দমার্গ।।  বাউলরা ভাববাদী না বস্তুবাদী এর অনেক সূক্ষ বিশ্লেষণ শক্তিনাথের বস্তুবাদী বাউল বইটির মধ্যে আলকপাত করা হয়েছে। সাধারণ সমাজে এ ধা...

ভাইবে রাধারমণ

তখন কলেজের ছাত্র। বাংলা বিভাগের প্রভাষক শ্রদ্ধেয় রেজা স্যারের সাথে খুবই ভালো সম্পর্ক। কলেজের প্রথম দিনই স্যারকে খুব পছন্দ। তারপর স্যারের সাথে গল্প, সমাজ, রাজনীতি, সাহিত্য নিয়ে আলোচনা। রীতিমত ফিজিক্স, বায়োলোজি ক্লাস ফাঁকি দিলেও বাংলা ক্লাস কখনই ফাঁকি দিতাম না। খুব উপভোগ করতাম স্যারের ক্লাস। হোস্টেল সুপার হিসেবে স্যার ( ওহী আলম রেজা) আমাদের সাথেই থাকতেন। আমরা আসার প্রায় নয় মাস পর স্যার এলেন সুপার হিসেবে। প্রতিদিন রাতে খাবার পরেই স্যারের রুমে গিয়ে আড্ডা হত, গানের আসর হত। স্যারের পিসিতে প্রায়ই গান শুনতাম আমরা। একদিন হঠাৎ করেই একটি গান স্যার প্লে করলেন 'আমার বন্ধু দয়াময় তোমারে দেখিবার মনে লয়। তোমারে না দেখলে রাধার জীবন কেমনে রয় বন্ধুরে।। কদম ডালে বইসারে বন্ধু ভাঙ্গ কদম্বের আগা। শিশুকালে প্রেম শিখাইয়া যৌবনকালে দাগা রে।। তমাল ডালে বইসারে বন্ধু বাজাও রঙের বাশি। সুর শুনিয়া রাধার মন হইলো যে উদাসি রে।। ভাইবে রাধা রমন বলে মনেতে ভাবিয়া। নিভা ছিল মনের আগুন কে দিলাই জ্বালাইয়া রে।' গানের কথাগুলো বেশ ভালো লেগে গেলো। পুর গানটি শুনে বুঝলাম গানটি সাধক রাধারম...