আমাদের এ সমাজে যে কয়েকটি অবেহেলিত শ্রেণি আছে যারা তাদের কর্মক্ষেত্রের কোন দাম পাননি এখন পর্যন্ত তারা হচ্ছেন হরিজন সম্প্রদায় এবং চা শ্রমিক। আমি চা বাগান এলাকার সন্তান৷ আমার বাড়ি চা বাগানের কোলঘেঁষা সুবৃস্তিত সবুজের সমারোহে। কিশোর যৌবন শিশুকাল আমার কেটেছে চা বাগান দেখে দেখে। যৌবনের দীর্ঘ সময় আমার কেঁটেছে চা শ্রমিকদের সাথে। শুরু করার আগে বাংলাদেশের একটি অধিদপ্তরের পরিপত্রের ঘোষণা তুলে ধরি৷
"স্মারক নং-৪০.০২.০০০০.১০৬.১৬.০০৩.২০১৮-১৩৪
বিষয়ঃ সরকার কর্তৃক ঘােষিত সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে সাধারণ ছুটি প্রসঙ্গে।
উপযুক্ত বিষয়ে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন, রেজি. নং-বি-৭৭ এর ২৪/৩/২০২০ খ্রি. তারিখের পত্রের
প্রেক্ষিতে জানানাে যাচ্ছে যে, করােনা ভাইরাস রােগ (কোভিড-১৯) এবং এর বিস্তার প্রতিরােধকল্পে সতর্কতামূলক
ব্যবস্থা হিসেবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের গত ২৪/৩/২০২০ খ্রি. তারিখের এক প্রজ্ঞাপনে আগামী ২৬/৩/২০২০ খ্রি.
তারিখ হতে ০৪/১০/২০২০ খ্রি. তারিখ পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘােষণা করা হয়েছে। ঘােষিত সাধারণ ছুটির বিষয়ে
মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের ২৪/৩/২০২০ খ্রি. তারিখের প্রেস বিজ্ঞপ্তির ক্রমিক নং- ১ অনুযায়ী এ দুটি বন্ধ সরকারী-
বেসরকারী অফিস আদালতের জন্য প্রযােজ্য এবং ক্রমিক নং- ৪ অনুযায়ী ঔষধ/খাদ্য প্রস্তুত, ক্রয়-বিক্রয়সহ অন্যান্য
শিল্প কারখানা/প্রতিষ্ঠান/বাজার/দোকানপাট নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চলবে বলে উল্লেখ রয়েছে (কপি সংযুক্ত)।
| এমতাবস্থায়, মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের ২৪/৩/২০২০ খ্রি. তারিখের প্রেস বিজ্ঞপ্তির ক্রমিক নং- ৪ অনুযায়ী পরবর্তী।
নির্দেশনা না আসা পর্যন্ত চা বাগানের ক্ষেত্রে উক্ত সাধারণ ছুটি প্রযােজ্য হবে না।"
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় সবধরনের কর্ম প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা পর তারা চা শ্রমিকদের কাজ বন্ধ করার দাবীতে একটি আবেদন করেছিলেন। পরবর্তীতে গত ২৫ তারিখ তাদের এই আবেদনের প্রদুত্তর দেওয়া হয় অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে যেখানে স্পষ্ট বলা হয় নির্দেশনা আসা পর্যন্ত ছুটি প্রযোজ্য হবেনা।
চা বাগানের কান্না কেউ শুনেন বা না শুনেন আমি শুনি, আমি জানি। চা শ্রমিকদের জীবন কিভাবে অতিবাহিত হয় বা হচ্ছে তা আমি খুব ভালো করেই জানি। তাদের জীবন যাত্রা নিয়ে বলতে গেলে শতাধিক পৃষ্ঠা লিখতে হবে। শুধু চা বাগানের একজন শ্রমিকের জবানবন্দি তুলে ধরছি--"আমি লেবার সংঘের সভাপতি। আমার ঘরেই গরু বাছুর নিয়া থাকতে হয়। কোন মতে টিন দিয়ে ঘর ঠিক করেছি। কিন্তু জায়গা ত নাই।" একজন চা শ্রমিক তার নাম মধু মৃধার ঘরের এই অবস্থা। একবার চিন্তা করলে আমি ভাষ্য হারিয়ে ফেলি এক ঘরে কিভাবে মানুষ এবং গোবাদি পশু একসাথে রাত কাটাতে হয়! এটা একজন শ্রমিক নেতার ঘরের অবস্থা, বাদবাকি লেবারের কি অবস্থা। আর আমার বলার প্রয়োজন নেই।
করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় যেখানে সবধরনের জনসমাগম, একত্রিত হওয়া সরকার বন্ধ ঘোষণা করেছে সেখানে বাংলাদেশের চা বাগান গুলো এখনো বন্ধ হয়নি। ছোট একটি হিসাব মতে, দিন শেষে চা তোলে সেটি ফ্যাক্টরি র গাড়িতে জমা দিতে কম হলেও ৩০ থেকে ৩৫ জন চা শ্রমিক একসাথে মিলিত হোন। একটি চা বাগানে যদি তিনটি করে গাটিতে (ট্রাক্টরে) তোলা চা পাতা জমা নেওয়া হয় তবে একটি বাগানে মিনিমাম একশ শ্রমিক একসাথে মিলিত হচ্ছেন। তবে চিন্তা করে দেখুন সারা বাংলাদেশের প্রত্যেকটি বাগানে কতজন শ্রমিক একসাথে মিলিত হচ্ছেন।
গত দুইদিন মুঠোফোনের মাধ্যমে বেশ কয়েকজন চা শ্রমিকের সাথে কথা বলেছি, জেনেছি। তাদের ভাষ্যমতে ভাইরাস রোধ ত অনেক দূরের ব্যাপার, কোম্পানি থেকে একটি ৮ টাকা দামের বল সাবান ও দেওয়া হয়নি। মাস্ক আর গ্লাভস ত মহাকাশের মহাকল্পনা, তাদেরকে এই ভয়াবহ পরিস্থিতে একটি প্যারাসিটামল ঔষধ দেওয়ার কেউ নাই।
১৯৬২ সালের টি প্ল্যান্টেশন লেবার অর্ডিন্যান্স এবং ১৯৭৭ সালের প্ল্যান্টেশন রুলসে চা-বাগানগুলোতে শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা মালিকের দায়িত্ব থাকলেও এখন পর্যন্ত করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় কোন পদক্ষেপ নেয়নি বাগান মালিক কর্তৃপক্ষ। একবার যদি চা বাগান গুলোতে মহামারি ছড়ায় তবে অতীতের কলেরা রোগের মহামারির চিত্র শুধু মনে করিয়ে দিলাম।
আজকের তথ্য থেকে জানা,মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের চা বাগানসমূহে শ্রমিকদের ছুটি দেওয়া হয়নি। তাই কমলগঞ্জ উপজেলার ৫টি চা বাগানের শ্রমিকরা কাজ বর্জন করেছেন। ছুটি না দিলে শ্রমিকদের এই সিধান্তকে আমার সাধুবাদ। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি চা বাগানে ছুটি ঘোষণা এবং মহামারি ঠেকাতে দ্রুত পদক্ষেপ নেবার জোর দাবী জানাই।
লিখেছেন- চৌধুরী মারূফ, সাংবাদিক, অনলাইন এক্টিভিস্ট (ছবি- ০৯-০২-২০১৭)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন